প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউসুফ আলী: রোজার শাব্দিক অর্থ হলো না খেয়ে থাকা বা উপোস থাকা। একজন মুমিন বান্দা শুধুমাত্র আল্লাহর রেজামন্দীর জন্য রোজা রাখে। রোজার মাধ্যমে মহান খোদা তায়ালার ইবাদত তো হয়েই যায়, সাথে সাথে অগণিত শারিরীক উপকারিতা লাভ করে থাকে। শুধু ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতেও রোজার রয়েছে অপরিসীম স্বাস্থ্যগত উপকারিতা। আসুন আমরা
প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউসুফ আলী: রোজার শাব্দিক অর্থ হলো না খেয়ে থাকা বা উপোস থাকা। একজন মুমিন বান্দা শুধুমাত্র আল্লাহর রেজামন্দীর জন্য রোজা রাখে। রোজার মাধ্যমে মহান খোদা তায়ালার ইবাদত তো হয়েই যায়, সাথে সাথে অগণিত শারিরীক উপকারিতা লাভ করে থাকে। শুধু ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতেও রোজার রয়েছে অপরিসীম স্বাস্থ্যগত উপকারিতা। আসুন আমরা দেখি রোজা শরীরের জন্য কতটা উপকারী-
১। বিষাক্ত পদার্থ দূরিকরণ: রোজায় পানাহার থেকে বিরত থাকার ফলে দেহ দূষিত পদার্থ বের করার জন্য পর্যাপ্ত সময় ও সুযোগ পায়। এর ফলে পরিপাকতন্ত্র সচল হয় এবং রক্ত সঞ্চালন স্বাভাবিক থাকে। একই সাথে দেহ থেকে যাবতীয় বিষাক্ত পদার্থ দূর করে। এই প্রক্রিয়ার নাম ডিটক্সিফিকেশন। ডিটক্সিফিকেশন প্রক্রিয়ায় দেহকোষে জমে থাকা ফ্যাট বার্ন বা দহনের পাশাপাশি দেহের যাবতীয় টক্সিন অর্থাৎ বিষাক্ত পদার্থও ধ্বংস হয়ে যায়।
২। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি: আমাদের দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা মূলত শ্বেত রক্তকণিকা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। রোজা রাখার ফলে পুরানো শ্বেত রক্তকণিকাগুলো পুনরায় উজ্জেবিত হয় এবং আগের চেয়েও শক্তিশালী হয়ে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলে।
৩। কোলেস্টেরলের মাত্রা কমায়: আজকাল স্বাস্থ্যসচেতন বন্ধুরা রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়া নিয়ে চরম উদ্বিগ্ন। রোজা তাদের জন্য সুসংবাদ। সম্প্রতি কার্ডিওলজিস্টের গবেষণা মোতাবেক, রোজা রাখার ফলে দেহে হাই ডেনসিটি লাইপোপ্রোটিন কোলেস্টেরল এর মাত্রা হ্রাস পায়। এই গবেষণায় প্রমান করা হয়েছে, যারা নিয়মিত রোজা থেকেছেন তাদের দেহের লিপিড প্রোফাইল একদম স্বাভাবিক। অর্থাৎ, তাদের রক্তে খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রা কম। দেহে কোলেস্টেরলের মাত্রা স্বাভাবিক থাকলে যেকোন হৃদরোগ, স্ট্রোক এবং হার্ট অ্যাটাকের মত ঝুঁকি অনেক কম।
৪। ওজন কমাতে কার্যকরী: স্থুল মেদ ও দেহের মাত্রাতিরিক্ত ওজন একটি রুটিন সমস্যা। রোজা থাকার ফলে আমাদের দেহ তার প্রয়োজনীয় শক্তি আহরণের জন্য দেহের বিভিন্ন ফ্যাটি টিস্যু এবং মাংসপেশী ও লিভারে জমে থাকা অতিরিক্ত গ্লুকোজ বার্ন করে দেয়। এর ফলে দেহের ওজন হ্রাস পায় এবং শারীরিক গঠন স্বাভাবিক ও সুঠাম হয়। জর্ডানের ৬০ জন স্বাস্থ্যবান মুসলিম ব্যক্তির উপর চালানো গবেষণা থেকে দেখা গিয়েছে যে, এক মাস রোজা থাকার ফলে তাদের দেহের ওজন হ্রাস পেয়েছে।
৫। বিপাকে সহায়ক: রোজা রাখার ফলে আমাদের লিভারে থাকা এনজাইমগুলো ভেঙে কোলেস্টেরলে পরিণত হয়। একই সাথে দেহে জমে থাকা ফ্যাট বার্ন হয়ে বাইল এসিড এ রূপান্তরিত হবার ফলে দেহে তাপ উৎপন্ন হয়। এর ফলে দেহে মেটাবলিজম বুস্ট হয় এবং ক্ষুধা কম লাগে। জেনে রাখা দরবার, বাইল এসিড হচ্ছে লিভার বা যকৃত দ্বারা তৈরি একপ্রকার এসিড। এটি পিত্তের সাথে কাজ করে দেহের ফ্যাট বার্ন করতে সাহায্য করে।
৬। পুষ্টি শোষণে উপকারী: দীর্ঘসময় ধরে রোজা রাখায় এবং গভীর রাতে সাহরী করার ফলে আমাদের দেহে অ্যাডিপোনেক্টিন নামক একটি হরমোন তৈরি হয়। এর ফলে আমাদের বিপাকক্রিয়ার কার্যকারিতা আরো সচল হয় এবং আমাদের দেহ এবং মাংসপেশী খাদ্য থেকে বেশি পুষ্টি শোষণে সক্ষম হয়। স্বাস্থ্য-বিজ্ঞানী তার “সুপিরিয়র নিউট্রিশন” গ্রন্থে ডা. শেলটন বলেছেন, উপবাসকালে শরীরের মধ্যকার প্রোটিন, চর্বি, শর্করা জাতীয় পদার্থগুলো স্বয়ং পাচিত হয়। যার কারণে গুরুত্বপূর্ণ কোষগুলোর পুষ্টি বিধান হয়।
৭। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ: সারাদিন না খেয়ে থাকার কারণে শরীরের গ্লুকোজ ও শর্করা জাতীয় খাবারের দ্রুত ক্ষয় হয় এবং তা দেহের জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি যোগান দেয়। ফলে ইনসুলিনের উৎপাদন কমে যায় এবং তা প্যানক্রিয়াসকে খানিকটা বিশ্রাম দেয়। গ্লুকোজ ক্ষয়ের ফলে শরীরে ব্লাডসুগার কমে ডায়বেটিস প্রতিরোধে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। বিশেষ করে, রোজা টাইপ টু ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে বেশ উপকারী।
৮। রক্তচাপ স্বাভাবিক রাখে: রোজায় সাধারণ খাদ্যাভ্যাস পরিহারের মাধ্যমে খাবারের সাথে অতিরিক্ত লবণ গ্রহণের মাত্রাও কমে যায়। এছাড়াও রেচন প্রক্রিয়ায় দেহের অতিরিক্ত লবণ বের হয়ে যায় বলে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে।
৯। অকাল বার্ধক্যের ঝুঁকি হ্রাস: রোজা রাখার ফলে আমাদের দেহের অপ্রয়োজনীয় কোষগুলো ধ্বংস হয় এবং পুনরায় দেহের জন্য প্রয়োজনীয় কোষ এবং টিস্যু গঠিত হয়। এই সাধারণ প্রক্রিয়ার ফলে দেহে কোলাজেন উৎপাদনের হার বৃদ্ধি পায় এবং দেহত্বক আরো উজ্জ্বল ও প্রাণবন্ত হয়।
১০। মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি: গবেষণায় দেখা গেছে, রোজায় পর্যাপ্ত মানসিক বিকাশ অর্জনের ফলে মস্তিষ্কের প্রয়োজনীয় নিউরোট্রফিক ফ্যাক্টরের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। এর ফলে মস্তিষ্কের কোষের বৃদ্ধিসাধন হয় এবং মস্তিষ্ক আরো কর্মক্ষম হয়।
১১। স্মরণ শক্তি বৃদ্ধি পায়: হাজারো পীর-মাশায়েক এবং অভিজ্ঞ ডাক্তারা দের মতে রোজার ফলে স্মরণ শক্তি বৃদ্ধি পায়। বিখ্যাত ডাক্তার দেওয়ান এ,কে,এম, আব্দুর রহীম বলেছেন, রোজাব্রত পালনের কারণে মস্তিস্ক এবং স্নায়ুতন্ত্র সর্বাধিক উজ্জীবিত হয়। ফলে স্মরণশক্তি বেড়ে যায়।
১২। মানসিক স্বাস্থ্যের বিকাশ নিশ্চিতকরণ: বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের মতে, রোজার ফলে মস্তিষ্কের সেরিবেলাম ও লিমরিক সিস্টেমের ওপর নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধির কারণে মনের অশান্তি ও দুশ্চিন্তা দূর হয়, যা উচ্চ রক্তচাপের জন্য মঙ্গলজনক। রোজার সামগ্রিক প্রক্রিয়ায় আমাদের দেহ এন্ডোরফিন নামক রাসায়নিক উপাদানে পরিপূর্ণ থাকে। এর ফলে আমাদের দেহে মানসিক সুস্থতা নিশ্চিত হয় এবং দীর্ঘসময় পর্যন্ত আমাদের মন প্রফুল্ল থাকে। তাছাড়া, রোজা রাখার ফলে এড্রেনাল গ্রন্থি থেকে উৎপাদিত কর্টিসল হরমোন এর হার তুলনামূলকভাবে কমে যাওয়ায় একজন ব্যক্তি কম মানসিক চাপ অনুভব করেন। এর ফলে মন দুশ্চিন্তামুক্ত থাকে এবং ইতিবাচক প্রভাব পড়ে।
১৩। বহুমূত্র রোগে কার্যকরী: বহুমূত্র রোগের প্রাথমিক পর্যায়ে রোজা খুবই উপকারী। ডাক্তারী পরীক্ষায় দেখা গেছে, একাধারে ১৫-৩০ দিন রোজা রাখলে বহুমূত্র রোগের অত্যন্ত উপকার হয়।
১৪। খারাপ খাদ্যাভ্যাস থেকে মুক্তি: রোজা রাখার সাথে জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের বেশ দারুণ একটি সম্পর্ক আছে। প্রথমত, রোজা রাখার ফলে আমরা দীর্ঘসময় পর্যন্ত পানাহার থেকে বিরত থাকি। এর ফলে ধূমপান, জাংক ফুড এবং মদ্যপান থেকেও বিরত থাকা সম্ভব।
১৫। গ্যাসটিকের ব্যাথা প্রশমন: রোজা রাখলে অনেকটা সময় না খাওয়ার ফলে পাকস্থলীর অ্যাসিড নিঃসরণও কিছুটা কমে, ফলে গ্যাসট্রিকের ব্যাথাও কিছুটা হ্রাস পায়।
১৬। লিভার টনিকের কাজ করে: নোবেল পুরস্কার বিজয়ী মেডিসিন ও শল্য চিকিৎসার প্রখ্যাত ডাক্তার অ্যালেকসিস বলেছেন, উপবাসের মাধ্যমে লিভারে রক্ত সঞ্চালন দ্রুত হয়। এর ফলে ত্বকের নিচে সঞ্চিত চর্বি, পেশীর আমিষ, গ্রন্থিসমূহ এবং লিভারে কোষসমূহ আন্দোলিত হয়। অভ্যন্তরীণ দেহ যন্ত্রগুলোর সংরক্ষণ এবং হ্নদপি-ের নিরাপত্তার জন্য অন্য দেহাংশগুলোর বিক্রিয়া বন্ধ রাখে। এক কথায়, রোজা লিভার টনিকের কাজ করে।
১৭। কিডনী রোগে উপকারী: কিডনী সমস্যায় আক্রান্ত রোগীরা রোজা রাখলে এ সমস্যা আরো বেড়ে যাবে ভেবে রোজা রাখতে চান না। অথচ আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা বলছেন, রোজা রাখলে কিডনীতে সঞ্চিত পাথর কণা ও চুন দূরীভূত হয়।
১৮। অজীর্ণ ও হাঁপানিতে কার্যকর: স্বাস্থ্যবিজ্ঞানী ডা. আব্রাহাম জে হেনরি রোজা সম্পর্কে বলেছেন, “রোজা হলো পরমহিতৈষী ওষুধ বিশেষ। কারণ, রোজা পালনের ফলে বাতরোগ, অজীর্ণ, হৃদরোগ ও রক্তচাপজনিত ব্যাধিতে মানুষ কম আক্রান্ত হয়।” গবেষণায় দেখা গেছে, রোজাদার পেপটিক আলসারের রোগীরা রোজা রাখলে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। হাঁপানি রোগীদের জন্যও রোজা উপকারী।
১৯। ফুসফুসের রোগ সারাতে সক্ষম: বিশ্বখ্যাত চিকিৎসা বিজ্ঞানী নাষ্টবারনার প্রমান করেছেন যে, ফুসফুসের কাঁশি, কঠিন কাঁশি, সর্দি এবং ইনফ্লুয়েঞ্জা কয়েকদিনের রোজাতেই নিরাময় হয়। করোনা ভাইরাসও যেহেতু সর্দি-ইনফ্লুয়েঞ্জার মত একটি রোগ, সে কারণে করোনা নিয়ন্ত্রণেও রোজার যে ভূমিকা থাকবে সেটা গবেষণা না করেও বলা যায়।
ছোট-খাঁটো অজুহাত দেখিয়ে আমরা অনেকেই রোজা রাখি না। কিন্তু রোজার উপকারিতা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমান করেই ২০১৬ সালে চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন জাপানি জীব বিজ্ঞানী ইয়োশিনরি ওসুমি। মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলকে রোজা রাখার তৌফিক দান করুন।
(লেখক: মৎস্য-বিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, ভিজিটিং ফেলো ইউনিভার্সিটি অব নিউ সাউথ ওয়েলস, সিডনী)
1 Comment
MD FIROJ AHAMED
January 20, 2024, 11:35 pmধন্যবাদ অনেক সুন্দর লিখেছেন
REPLY