ডাঃ ইমাম হোসাইন : শরীআাতের পরিভাষায় সাওম বা রোজার অর্থ সুবহে সাদেক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত খানা-পিনা ও যৌন ক্রিয়াকর্ম থেকে বিরত থাকা। রোযা ফরয হওয়ার হুকুম: হিজরতের দেড় বছর পর রমযানের রোযা মুসলমানদের ওপর ফরয করা “হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোযা ফরয করা হলো।” (সূরা বাকারা,আয়াত:১৮৩) রোযা ফরযে আইন। যে তা অস্বীকার করবে সে কাফের
ডাঃ ইমাম হোসাইন : শরীআাতের পরিভাষায় সাওম বা রোজার অর্থ সুবহে সাদেক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত খানা-পিনা ও যৌন ক্রিয়াকর্ম থেকে বিরত থাকা।
রোযা ফরয হওয়ার হুকুম:
হিজরতের দেড় বছর পর রমযানের রোযা মুসলমানদের ওপর ফরয করা
“হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোযা ফরয করা হলো।” (সূরা বাকারা,আয়াত:১৮৩) রোযা ফরযে আইন। যে তা অস্বীকার করবে সে কাফের এবং বিনা ওযরে যে রাখবে না সে ফাসেক ও কঠিন গোনাহগার ।
রোযার গুরুত্ব:
কুরআন এ সাক্ষ্য দেয় যে, সকল আসমানী শরীয়াতের অধীন রোযা ফরয ছিল এবং প্রত্যেক উম্মতের ইবাদাতের মধ্যে তা ছিল একটা অপরিহার্য অংশ।
“যেমন রোযা ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের ওপরে।” (সূরা বাকারা, আয়াত:১৮৩) এ আয়াত শুধু একটা ঐতিহাসিক ঘটনা বর্ণনার জন্যে নয়, বরঞ্চ এ গুরুত্বপূর্ণ সত্যটি তুলে ধরার জন্যে যে, মানুষের প্রবৃত্তির পরিশুদ্ধির সাথে রোযার বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে এবং তাযকিয়ায়ে নফসে তার একটা স্বাভাবিক অধিকার রয়েছে। বরঞ্চ এমন মনে হয় যে, তরবিয়ত ও তাযকিয়ার প্রক্রিয়া ছাড়া তা পূর্ণই হতে পারে না। অন্য কোনো ইবাদাত তার বিকল্প হতেই পারে না। এজন্যেই রোযা সকল নবীগণের শরীয়াতে ফরয ছিল।
রোযার গুরুত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে নবী (স) বলেন, “যে ব্যক্তি কোনো শরয়ী ওযর অথবা রোগ ছাড়া রমযানের একটি রোযা ছেড়ে দেবে সে যদি সারা জীবন ধরে রোযা রাখে তবুও তার ক্ষতি পূরণ হবে না।” -(আহমদ, তিরমিযি, আবু দাউদ)
অর্থাৎ রমযানের রোযার মহত্ব, কল্যাণ, বরকত ও গুরুত্ব এই যে, যদি কোনো উদাসীন ব্যক্তি স্বেচ্ছায় কোনো রোযা নষ্ট করে বা না রাখে, তার ফলে তার যে ক্ষতি হলো তা জীবনব্যাপী রোযা রাখলেও তার ক্ষতি পূরণ হবে না, তবে তার আইনগত কাযা হতে পারে।
রোযার নিয়তের মাসয়ালা:
১. নিয়ত করার অর্থ মনে মনে এরাদা করা, মুখে উচ্চারণ করে নিয়ত করা জরুরী নয়, শুধু মনের মধ্যে ইচ্ছা করাই যথেষ্ট। বরঞ্চ সিহরী খাওয়াটাই নিয়তের স্থলাভিষিক্ত। এজন্যে যে রোযার জন্যেই সেহরী খাওয়া হয় । অবশ্যি যারা ঐ সময়ে খেতে সাধারণত অভ্যস্ত অথবা যেসব নাদান নিয়মিত সিহরী খায় কিন্তু রোযা রাখে না, তাদের জন্যে নিয়ত করা জরুরী।
২. রমযানের প্রত্যেক রোযার জন্যে আলাদা নিয়ত করা জরুরী। গোটা রমযানের জন্যে একবার নিয়ত করা যথেষ্ট নয়।
৩. রমযানের চলতি রোযার জন্যে ফরয বলে নিয়ত করা জরুরী নয়—শুধু রোযার নিয়ত করাই যথেষ্ট। কিন্তু কোনো রোগী রমযানের রোযা রাখলে সে ফরযের নিয়ত করবে। কারণ তার ওপর রমযানের রোযা ফরয নয়। যদি শুধু রোযার নিয়ত করে অথবা নফল রোযার নিয়ত করে তাহলে তার রোযা রমযানের রোযা হবে না।
৪. মুসাফিরের জন্যে জরুরী যে রমযানে সে যেন অন্য কোনো ওয়াজিব রোযার নিয়ত না করে, যেন রমযানের ফরয রোযার নিয়ত করে অথবা নফল রোযার নিয়ত করে তা দুরস্ত হবে।
৫. রমযানের কাযা রোযার জন্যে নির্দিষ্ট করে ফরযের নিয়ত করা জরুরী।
৬. কেউ রাতে রোযার নিয়ত করতে ভুলে গেল দিনের বেলায় মনে হলো, তাহলে তিন ধরনের রোযায় দুপুরের পূর্বে নিয়ত করলে দুরস্ত হবে। অর্থাৎ সূর্যাস্তের পূর্বে দুপুর পর্যন্ত যে কোনো সময়ে নিয়ত করলে দুরস্ত হবে :
ক. রমযানের চলন্ত রোযার জন্যে।
খ. মানতের ওসব রোযার জন্যে যার দিন তারিখ নির্দিষ্ট করা হয়েছে।
গ. নফল রোযার জন্যে।
৭. নিম্নের চার প্রকারের রোযার জন্যে সূর্যাস্ত থেকে সুবেহ সাদেক পর্যন্ত নিয়ত করা জরুরী—সুবেহ সাদেকের পর নিয়ত করা যথেষ্ট নয়।
ক. রমযানের কাযা রোযায়।
খ. মানতের ঐসব রোযায় যার দিন তারিখ নির্দিষ্ট নয়। না,
গ. কাফ্ফারার রোযায়।
ঘ. ঐসব নফল রোযার কাযায় যা শুরু করার পর কোনো কারণে নষ্ট হয়েছে।
৮. রাতে রোযা রাখার নিয়ত ছিল না। সকালেও রোযা রাখার খেয়াল তারপর দুপুরের আগে হঠাৎ মনে পড়লো যে, রমযানের রোযা ছাড়া ঠিক নয় এবং তড়িঘড়ি করে নিয়ত করে ফেললো, তাহলে রোযা দূরস্ত হবে। কিন্তু সকালে যদি কিছু খেয়ে থাকে তাহলে তো নিয়ত করার কোনো অবকাশই রইলো না।
৯. রমযান মাসে কেউ ফরয রোযার পরিবর্তে নফল রোযার নিয়ত করলো এবং মনে করলো যে পরে ফরয রোযার কাযা করে নেবে। তথাপি সে রোযা রমযানের রোযাই হবে। নফল রোযা হবে না। এমনি নফল রোযার পরিবর্তে ওয়াজিব রোযার যদি নিয়ত করে, তথাপি রমযানের রোযা হবে। নীতিগত কথা এই যে, রমযানে শুধু রমযানের ফরয রোযাই হবে, অন্য
রোযা হবে না ।
১০. রোযা সুবেহ সাদেক থেকে শুরু হয়। অতএব সুবেহ সাদেকের পূর্বে এ সকল কাজ জায়েয যার থেকে বিরত থাকা রোযার মধ্যে ফরয। কেউ মনে করে যে, রোযার নিয়ত করার পর কিছু খাওয়া দাওয়া করা জায়েয নয় । একথা ঠিক নয়। সুবেহ সাদেকের পূর্বে খাওয়া দাওয়া প্রভৃতি জায়েয—যদিও সূর্যাস্তের পরই পরের দিনের রোযার নিয়ত করা হয়ে থাকে ।
১১. নফল রোযার নিয়ত করলে তা ওয়াজিব হয়ে যায়। সকালে নিয়ত করার পর যদি তা ভেঙে ফেলা হয় তাহলে সে রোযার কাযা ওয়াজিব হবে।
১২. কেউ রাতে এরাদা করলো যে, পরদিন রোযা রাখবে। কিন্তু সকাল হওয়ার পূর্বেই ইচ্ছা পরিবর্তন করলো এবং রোযা রাখলো না। এ অবস্থায় কার্যাওয়াজিব হবে না।
১৩. রাতে নিয়ত করলে বলবে ‘আমি আগামীকাল মাহে রমযানের রোযা রাখার নিয়ত করলাম। দিনে নিয়ত করলে বলবে ‘মাহে রমযানের আজকের দিনের রোযার নিয়ত করছি।’ আরবীতে নিয়ত করা জরুরী নয়, যে কোনো ভাষায় বলা যায় ।
রোযার সুন্নাত ও মুস্তাহাব
১. সিহরীর ব্যবস্থা করা সুন্নত, কয়েকটি খেজুর হোক বা এক চুমুক পানি হোক।
২. সিহরী শেষ সময়ে খাওয়া মুস্তাহাব – সুবহে সাদেক হতে যখন সামান্য বাকী।
৩. রোযার নিয়ত রাতেই করে নেয়া মুস্তাহাব।
৪. ইফতার তাড়াতাড়ি করা মুস্তাহাব। অর্থাৎ সূর্য অস্ত যাওয়ার পর অযথা বিলম্ব না করা ।
৫. খুরমা খেজুর অথবা পানি দিয়ে ইফতার করা মুস্তাহাব।
৬. গীবত, চোগলখুরী, মিথ্যা বলা, হৈ হাংগামা, রাগ এবং বাড়াবাড়ি না করা সুন্নত। এ কাজ অবশ্যি অন্য সময়ে করাও ঠিক নয়। কিন্তু রোযার সময়ে তার থেকে দূরে থাকার চেষ্টা বেশী করা উচিত। কি কি কারণে রোযা নষ্ট হয় রোযা অবস্থায় তিনটি বিষয় থেকে দূরে থাকা ফরয, যথা : (১) কিছু না খাওয়া (২) কিছু পান না করা এবং (৩) যৌনবাসনা পূর্ণ না করা। এসব থেকে বিরত থাকা ফরয। অতএব উপরোক্ত তিনটি ফরযের খেলাপ কাজ করলেই রোযা নষ্ট হয়।
যে যে অবস্থায় রোযা কাযা ও কাফ্ফারা উভয়ই ওয়াজিব হয়:
১. কেউ রোযার মধ্যে উত্তেজনা বসে যৌনক্রিয়া করে বসলো, সে নারী হোক বা পুরুষ অথবা কোনো পুরুষ সমমৈথুন করলো, তাহলে কাযা কাফ্ফারা উভয়ই ওয়াজেব হবে।
২. কোনো নারী পুরুষের শয্যা সংগিনী হলো এবং পুরুষাঙ্গের মাথা তার লজ্জাস্থানে প্রবেশ করলো, এমন অবস্থায় বীর্যপাত হোক বা না হোক, কাযাও ওয়াজিব হবে এবং কাফ্ফারাও।
৩. কোনো নির্বোধ তার স্ত্রীর পাশে শয়ন করে তার পশ্চাদ্বারে তার পুরুষাঙ্গ ঢুকালো, তাহলে উভয়ের রোযা নষ্ট হবে এবং কাযা ও কাফ্ফারা উভয়ই ওয়াজিব হবে।
৪. কেউ রোযা রেখে এমন কিছু খেলো বা পান করলো যা খাওয়া এবং পান করা হয়, অথবা এমন জিনিস খেলো যা আহার হিসেবে ব্যবহার করা হয় না, কিন্তু ওষুধ হিসেবে খেলো, তাহলে রোযা নষ্ট হবে এবং কার্যা কাফ্ফারা উভয়ই ওয়াজিব হবে।
৫. স্ত্রী ঘুমিয়ে আছে অথবা বেহুঁশ হয়ে আছে, স্বামী তার সাথে সহবাস করলো, তাহলে স্বামী বা পুরুষের কাযা ও কাফ্ফারা ওয়াজিব হবে।
৬. কেউ এমন কিছু কাজ করলো যাতে রোযা নষ্ট হয় না। কিন্তু মনে করলো যে রোযা নষ্ট হয়েছে এবং তারপর খানাপিনা করলো, তাহলে রোযা নষ্ট হবে এবং কাযাও করতে হবে, কাফ্ফারাও করতে হবে। যেমন ধরুন, কেউ সুরমা লাগালো, অথবা মাথায় তেল দিল, অথবা মেয়ে মানুষকে বুকে জড়িয়ে ধরলো অথবা চুমো দিল, তারপর মনে করলো যে রোযা
নষ্ট হয়েছে এবং সে তারপর ইচ্ছা করেই খানা-পিনা করলো, তাহলে এ অবস্থায় কাযা ও কাফ্ফারা উভয়ই ওয়াজিব হবে।
যেসব জিনিসে রোযা মাকরূহ হয়: অর্থাৎ ঐসব জিনিসের বর্ণনা যার দ্বারা রোযা নষ্ট হয় না বটে কিন্তু মাকরূহ হয়। এসব মাকরূহ তানযিহী, তাহরীমি নয় ।
১. কোনো জিনিসের আস্বাদ গ্রহণ করা। তবে যদি কোনো মেয়েলোক বাধ্য হয়ে খাবার জিনিস চেখে দেখে অথবা বাজার থেকে খরিদ করার সময় এ জন্যে চেখে দেখে যে, তাঁর স্বামী বড়ো বদমেজাজী এবং কঠোর অথবা কোনো চাকরানী তার মনিবের ভয়ে চেখে দেখে, তাহলে রোযা মাকরূহ হবে না।
২. মুখে কোনো কিছু চিবানো অথবা এমনি দিয়ে রাখা, যেমন কোনো মেয়ে মানুষ ছোটো বাচ্চাকে খাওয়াবার জন্যে মুখে নিয়ে কোনো কিছু চাবায় অথবা নরম করার জন্যে বা ঠাণ্ডা করার জন্যে মুখে রাখে তাহলে রোযা মাকরূহ হবে না। অবশ্যি বাধ্য হয়ে এসব করা জায়েয। যেমন কারো বাচ্চার খিদে পেয়েছে এবং সে শুধু সে জিনিসই খায় যা মুখে দিয়ে চিবিয়ে দিতে হয় এবং বেরোযা লোকও নেই, তাহলে এ অবস্থায় চিবিয়ে দিলে রোযা মাকরূহ হবে না।
৩. কোনো মেয়েলোকের ওষ্ঠ (ঠোঁট) মুখের মধ্যে নেয়া অথবা উলংগ অবস্থায় জড়িয়ে ধরা মাকরূহ — বীর্যপাত হওয়ার ও সহবাস করার আশংকা থাক বা না থাক ।
৪. রোযা রেখে এমন কোনো কাজ করা মাকরূহ যার দ্বারা শরীর এতোটা দুর্বল পড়ে যে, রোযা ভেঙে ফেলার আশংকা হয়।
৫. কুল্লি করার সময় বা নাকে পানি দেয়ার সময় প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানি ব্যবহার করা।
৬. বিনা কারণে মুখে থুথু জমা করে গিলে ফেলা।
৭. অস্থিরতা প্রকাশ করা, ঘাবড়িয়ে যাওয়া এবং মানসিক ভারসাম্যহীনতা প্রকাশ করা।
৮. গোসলের প্রয়োজন হলো এবং সুযোগও ছিল কিন্তু বিনা কারণে সুবেহ সাদেকের পর পর্যন্ত গোসল করলো না। তাহলে রোযা মাকরূহ হবে।
৯. মাজন, পেষ্ট অথবা কয়লা প্রভৃতি চিবিয়ে দাঁত মাজলে রোযা মাকরূহ হবে।
১০. রোযা রেখে গীবত করলে, মিথ্যা বললে, গালিগালাজ ও মারপিট অথবা কারো প্রতি বাড়াবাড়ি করলে রোযা মাকরূহ হবে।
১১. ইচ্ছা করে মুখের মধ্যে ধুয়া অথবা ধূলাবালি গ্রহণ করা মাকরূহ। আর যদি লোবান জ্বালিয়ে তার ঘ্রাণ নেয়া হয় অথবা হুক্কা, বিড়ি, সিগারেট খাওয়া হয় তাহলে রোযা নষ্ট হয়ে যাবে।
সেহরী ও ইফতার:
রোযা রাখার উদ্দেশ্যে সুবেহ সাদেকের পূর্বে যে খাওয়া দাওয়া করা হয় তাকে সিহরী বলে । নবী (স) স্বয়ং সিহরীর ব্যবস্থাপনা করতেন এবং অন্যকেও সিহরী খাওয়ার তাকীদ করতেন। হযরত আনাস (রা) বলেন, নবী (স) সিহরীর সময় আমাকে বলতেন, আমার রোযা রাখার ইচ্ছা, আমাকে কিছু খেতে দাও । তখন আমি তাঁকে কিছু খেজুর এবং এক বাটি পানি খেতে দিতাম । নবী (স) সিহরীর তাকীদ করতে গিয়ে বলেন, সিহরী খেয়ো এজন্যে যে, এতে বিরাট বরকত রয়েছে। বরকত বলতে এই যে, দিনের কাজকর্মে এবং ইবাদাত বন্দেগীতে দুর্বলতা মনে হবে না এবং রোযা সহজ হবে। একবার নবী (স) বলেন : দিনে রোযা রাখার জন্যে সিহরী খাওয়া দ্বারা সাহায্য নাও এবং রাতের ইবাদাতের জন্যে কায়লুলা দ্বারা সাহায্য নিও। সিহরী খাওয়া সুন্নত। মুসলমান এবং ইহুদী-নাসারাদের রোযার মধ্যে পার্থক্য এই যে, তারা সিহরী খায় না, মুসলমান খায়, ক্ষিধে না হলে কিছু মিষ্টি, অথবা দুধ অথবা পানি খেয়ে নেয়া উচিত এজন্যে সিহরী খাওয়ার মধ্যে বিরাট সাওয়াব আছে । নবী (স) বলেন-সিহরী খাওয়া প্রত্যক্ষ বরকত। সিহরী খেতে ভুলো না, তা এক চুমুক পানি হোক না কেন। কারণ সিহরী যারা খায় তাদের ওপর আল্লাহ রহমত বর্ষণ করেন এবং ফেরেশতাগণ তাদের জন্যে এস্তেগফার করেন ।
সিহরী বিলম্বে করা সুবেহ সাদেক হতে সামান্য বাকী আছে এতোটা বিলম্ব করে সিহরী খাওয়া মুস্তাহাব। অনেকে সাবধানতার জন্যে অনেক আগে সিহরী খায় । এটা ভালো নয় । বিলম্বে খাওয়াতে সওয়াব আছে।
ইফতার তাড়াতাড়ি করা:
ইফতার তাড়াতাড়ি করা মুস্তাহাব। অর্থাৎ সূর্য ডুবে যাওয়ার পর সাবধানতার জন্যে বিলম্ব করা মুনাসিব নয়, বরঞ্চ তৎক্ষণাৎ ইফতার করা উচিত। এভাবে অপ্রয়োজনীয় সাবধানতার ফলে দীনী মানসিকতা লোপ পায়।
এটা দীনদারি নয় যে, লোক অযথা নিজেদেরকে কষ্টে ফেলবে। বরঞ্চ দীনদারি হচ্ছে এই যে, বিনা বাক্য ব্যয়ে আল্লাহর হুকুম মেনে চলতে হবে। নবী (স) বলেন, তিনটি বিষয় পয়গম্বরসুলভ আচরণের শামিল :
১ সিহরী বিলম্বে খাওয়া ।
২. ইফতার তাড়াতাড়ি করা।
৩. নামাযে ডান হাত বাম হাতের ওপর রাখা।
হযরত ইবনে আবি আওফা (রা) বলেন, আমরা একবার সফরে নবী (স)-এর সাথী ছিলাম। তিনি রোযা ছিলেন। যখন সূর্য দৃষ্টির আড়াল হলো তখন তিনি একজনকে বললেন, ওঠ আমার জন্যে ছাতু গুলে দাও। লোকটি বললো, ইয়া রাসূলাল্লাহ, আর একটু দেরী করুন সন্ধ্যা হয়ে গেলে ভালো হয়।
এরশাদ হলো—সওয়ারী থেকে নাম এবং আমাদের জন্যে ছাতু গুলে দাও। সে আবার বললো, ইয়া রাসূলাল্লাহ, এখনো দিন আছে বলে মনে হচ্ছে। আবার এরশাদ হলো—সওয়ারী থেকে নেমে পড় এবং আমাদের জন্যে ছাতু তৈরী করে দাও। তখন সে নামলো এবং সকলের জন্যে ছাতু তৈরী করলো। নবী (স) ছাতু খেয়ে বললেন, তোমরা যখন দেখবে যে রাতের কালো ছায়া ওদিক থেকে ছেয়ে আসছে তখন রোযাদারের রোযা খোলা উচিত।-(বুখারী)
নবী (স) বলেন, আল্লাহর এরশাদ হচ্ছে, আমার বান্দাদের মধ্যে সবচেয়ে ঐ বান্দাহকে আমার পসন্দ হয়, যে ইফতার তাড়াতাড়ি করে।-(তিরমিযি) (অর্থাৎ সূর্য ডুবে যাওয়ার পর কিছুতেই বিলম্ব করো না)।
নবী (স) আরও বলেন, লোক ভালো অবস্থায় থাকবে যতোক্ষণ তারা ইফতার তাড়াতাড়ি করতে থাকবে।-(বুখারী, মুসলিম)
কোন্ জিনিস দিয়ে ইফতার করা মুস্তাহাব:
খেজুর এবং খুরমা দিয়ে ইফতার করা মুস্তাহাব তা না হলে পানি দিয়ে ইফতার করা মুস্তাহাব। নবী (স) স্বয়ং এসব দিয়ে ইফতার করতেন।
হযরত আনাস (রা) বলেন, নবী (স) মাগরিবের নামাযের পূর্বে কয়েকটি ভিজানো খেজুর দিয়ে ইফতার করতেন। তা না হলে খুরমা দিয়ে । তাও না হলে কয়েক চুমুক পানি পান করতেন।-(তিরমিযি, আবু দাউদ)
এসব জিনিস দিয়ে ইফতার করার জন্যে নবী (স) সাহাবায়ে কেরামকে উদ্বুদ্ধ করতেন। তিনি বলতেন, তোমাদের কেউ রোযা রাখলে খেজুর দিয়ে ইফতার করবে। তা না হলে পানি দিয়ে। আসলে পানি অত্যন্ত পবিত্র। (আহমদ, তিরমিযি, আবু দাউদ)
খেজুর ছিল আরবের উপাদেয় খাদ্য এবং ধনী গরীব সকলেই তা সহজেই লাভ করতো। আর পানি তো সর্বত্র প্রচুর পাওয়া যায়। এসব দিয়ে ইফতার করার জন্যে প্রেরণা দেয়ার তাৎপর্য এই যে, উম্মত যেন কোনো কষ্ট বা অসুবিধার সম্মুখীন না হয়, সময় মতো সহজেই রোযা খুলতে পারে। পানির একটা বৈশিষ্ট্য নবী (স) বলেন যে, তা এতোটা পাক যে তার দ্বারা সবকিছু পাক করা যায়। বাহ্যিক পাক তো অনুভবই করা যায়। তার সাথে রুহানী পবিত্রতাও হয়। রোযাদার যখন আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে সচেতন ঈমানের সাথে সারাদিন তৃষ্ণার্ত থেকে এবং সূর্যাস্তে ঠাণ্ডা পানি দিয়ে তৃষ্ণা নিবারণ করে তখন
স্বতস্ফূর্তভাবে তার মধ্যে শোকর গুযারির প্রেরণা সৃষ্টি হয় যার দ্বারা তার বাতেন বা আধ্যাত্মিক দিক আলোক্তি করার সৌভাগ্য হয়।
কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে যে, এ ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করা এবং অন্য কোনো জিনিস দিয়ে ইফতার করা তাকওয়ার খেলাপ মনে করা একেবারে ভুল। এমনি এ ধারণা করাও ভুল যে—লবণ দিয়ে ইফতার করা বড়ো সওয়াবের কাজ।
ইফতারের দোয়া:
“আল্লাহুম্মা লাকা সুমতু ওয়া আলা রিযক্বিকা আফত্বরতু”
“আয় আল্লাহ! তোমার জন্য রোযা রেখেছিলাম এবং তোমার দেয়া রিযিক দিয়ে ইফতার করলাম।”
ইফতার করাবার সওয়াব:
অন্যকে ইফতার করানোও পসন্দনীয় আমল এবং ইফতার যে করায় তাকেও ততোটা সওয়াব দেয়া হয় যতোটা দেয়া হয় রোযাদারকে। তা রোযাদারকে দু লোকমা খানা খাইয়ে দেয়া হোক অথবা একটা খেজুর দিয়েই ইফতার করানো হোক ।
নবী (স) বলেন, যে ব্যক্তি কোনো রোযাদারকে ইফতার করাবে সে রোযাদারের মতোই সওয়াব পাবে।-(বায়হাকী)
সেহরী ছাড়া রোযা:
রাতে সিহরীর জন্যে যদি ঘুম না ভাঙে, তবুও রোযা রাখা উচিত। সিহরী খাওয়া না হলে রোযা না রাখা কাপুরুষের কাজ। সিহরী না খাওয়ার জন্যে রোযা ছেড়ে দেয়া বড় গোনাহের কাজ।
যদি কখনো দেরীতে ঘুম ভাঙে এবং মনে হয় যে, রাত বাকী আছে এবং কিছু খানা-পিনা করা হলো। তারপর দেখা গেল যে, সুবেহ সাদেকের পর খানাপিনা করা হয়েছে। তাহলে এ অবস্থায় যদিও রোযা হবে না, তথাপি রোযাদারের মতোই থাকতে হবে কিছু পানাহার করা যাবে না।
Leave a Comment
Your email address will not be published. Required fields are marked with *