
৬৯’র বিক্ষুব্ধ ঢাকা নগরীর নাখালপাড়ার ৪৮৪ নম্বর বাসায় দুই মেয়ে ও স্বামীকে নিয়ে সুখের সংসার আনোয়ারা বেগমের। বড় মেয়ে নাজনিন ফরিদা আক্তারের বয়স আড়াই বছর এবং সদ্য জন্ম নেয়া ছোট মেয়ে নার্গিস ফাহমিদা আক্তারের বয়স মাত্র তিন বা চার মাস হলো। দিকে দিকে যখন স্বৈরশাসন বিরোধী গণঅভ্যুত্থান চলছিল, তখন আনোয়ারা বেগম বা তার স্বামী মোহাম্মদ ইসহাক শহীদ আসাদ, শহীদ মতিউর বা শহীদ রুস্তমের মতো কখনো স্বৈরাচার বিরোধী মিছিল নিয়ে রাজপথে নামেননি। তাদের কণ্ঠে ছিল না বিদ্রোহের সুর। মিটিং সমাবেশে স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে কখনো কোন রাজনৈতিক উত্তাপ বাড়ানোর চেষ্টাও করেননি তারা। আনোয়ারা বেগমের ছিলো একটি প্রাণবন্ত সংসার অথচ শান্ত জীবন।
কিন্তু নিরাপরাধ আনোয়ারা’র শান্ত সংসারটিকে অশান্ত করে দিয়েছিল স্বৈরতন্ত্রের আক্রোশ। যে সংসারে প্রতিবাদের কোনো হুঙ্কার ছিল না, যে ঘরে ছিল না স্লোগানে স্লোগানে ভেসে যাওয়া শব্দের অনুরণন, সেই ঘরে পাকিস্তানি পিশাচের ভয়াল থাবা ঢুকে রক্তাক্ত করে দেয় নির্বিবাদী আনোয়ারা বেগমকে। দিনটি ছিল ২৫ জানুয়ারি, গণঅভ্যুত্থানের দ্বিতীয় দিন। ৪ মাসের শিশু সন্তান নার্গিসকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছিলেন মা আনোয়ারা বেগম। তার নাখালপাড়ার ৪৮৪ নম্বর বাসার সন্নিকটেই ছাত্র-জনতার একটি দল প্রতিবাদ সমাবেশ করলে পাকিস্তানি টহলরত বাহিনী গুলি বর্ষণ শুরু করে। এমন সময় টিনের বেড়া ভেদ করে স্বৈরাচারী সরকারের সেনাবাহিনীর রাইফেলের একটি বুলেট হঠাৎ বিদ্ধ হয় আনোয়ারা বেগমের পিঠে। মুহূর্তেই রক্তে লাল হয় আনোয়ারা বেগমের সাজানো গোছানো ঘর, সংসার। একটি সুখী পরিবারের সকল সুখ, স্বপ্ন, কামনা-বাসনা মাত্র একটি বুলেটে চিরদিনের মতো থেমে যায়। মায়ের শরীরের কাঁচা রক্তের গন্ধ তো লেগেছিল নার্গিসের কচি নাকেও। কী ভয়ংকর! কী বিভৎস! মুহূর্তেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করে আনোয়ারা বেগম। ধীরে ধীরে উষ্ণ শরীরটিও হয়তো বরফের মতোই ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিল। ২৪ বছর বয়সী আনোয়ারা বেগমের পিঠ ছিদ্র হয়ে একই বুলেটের আঘাতে আহত হয় তার কোলের সন্তান নার্গিস। সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া মাতৃহারা কচি শিশুটিকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কোলের সেই শিশুটি এখন তার জীবনের অর্ধশত বছরেরও বেশি পূর্ণ করছে। সেদিনের ৪ মাসের শিশু নার্গিস ফাহমিদার চোখে এখনও সেই গুলির চিহ্ন রয়ে গেছে।
ইনিই সেই আনোয়ারা বেগম যিনি বাংলাদেশের স্বাধীকার আন্দোলনে শহীদ হওয়া প্রথম নারী। আসাদ যে কারণে গণআন্দোলনে প্রথম শহীদ, আনোয়ারা বেগমও সে কারণে প্রথম নারী শহীদ। তিনি এ আন্দোলনের পথিকৃৎ হয়তো না, কিন্তু পাকিস্তানি স্বৈরশাসক দ্বারা নির্বিচার মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন— এটি তো অস্বীকার করা যায় না। ১৯৬৯-এর আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে তার আত্মদান বিপুলভাবে প্রেরণা জুগিয়েছিল। স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে আসাদ, মতিউর, রুস্তমের তাজা রক্ত ধারার সঙ্গে শহীদ আনোয়ারার রক্ত ধারা মিশে এক দুর্বার গণ আন্দোলনের পরিবেশ তৈরি করে। জনস্রোত আর গণবিদ্রোহে কেঁপে ওঠে গোটা শহর। সান্ধ্য আইনের বেড়াজাল ভেঙে পাল্টা প্রতিরোধ তৈরি করে বিক্ষুব্ধ জনতা। ঢাকার রাজপথে মিছিলের পর মিছিলে উচ্চারিত হয় প্রতিবাদী হুঙ্কার। নাখালপাড়ার ৪৮৪ নম্বর বাড়ির ঘটনাটি কোনো প্রচারযন্ত্র ছাড়াই ঢাকার অলিতে গলিতে ছড়িয়ে পড়ে। আনোয়ারা বেগমের নিথর লাশ দেখে আরেকবার প্রতিবাদে ফুঁসে উঠেছিল ঢাকার জনতা। আনোয়ারা বেগমের মৃত্যুর খবর দৈনিক সংবাদপত্রগুলোতে পরদিনই ছাপা হয়েছিল। চারদিকে জ্বলে উঠেছিল প্রতিবাদী চোখ। আসাদুজ্জামান, মতিউর রহমান ও আনোয়ারা বেগমের মৃত্যু আন্দোলনকে নিয়ে যায় নতুন পর্যায়ে। সবার মনে প্রশ্ন- আইয়ুব খান সরকারের সেনাবাহিনীর গুলিতে কেন একজন গৃহবধূ নিজের ঘরে বসে সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ানোর সময় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বেন? পরবর্তীতে এই ঘটনায় ক্ষুব্দ হয়ে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ রাজপথে নেমে এসেছিল ছাত্রদের আহ্বানে।
২৫ জানুয়ারি, ১৯৭১ সালে ‘শহীদ আনোয়ারা দিবস’ উপলক্ষে নাখালপাড়া আওয়ামী লীগ মহিলা শাখার উদ্যোগে ৫০৭নং নাখালপাড়ায় এক জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভানেত্রীত্ব করেন বেগম জেবুন্নেছা এবং প্রধান অতিথির আসন গ্রহণ করেন নগর আওয়ামী লীগ মহিলা সম্পাদিকা বেগম সাজেদা চৌধুরী। এছাড়া ‘শহীদ আনোয়ারা দিবস’ উপলক্ষে সকাল সাতটায় শহীদ আনোয়ারার বাসভবনে কালো পতাকা উত্তোলন, কালো ব্যাজ ধারণপূর্বক খালি পায়ে মিছিল করে শহীদ আনোয়ারার মাজারে গমন এবং সেখানে ফুল দেওয়ার পর মোনাজাত করা হয়। পরবর্তীতে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাহাত্তর, তিয়াত্তর, চুয়াত্তরের ও ছিয়াত্তরের সংবাদপত্রে ছোট করে হলেও ছাপা হতো শহীদ আনোয়ারার খবর। শিরোনামেও লেখা হতো ‘শহীদ আনোয়ারা দিবস আজ’ আনোয়ারার নাখালপাড়ার বাসায় স্মৃতিচারণ ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজনও করা হতো। সেসব খবর একটু একটু করে আসতো খবরের কাগজে। এরপর আর তেমন কোন স্মৃতিচারন বা স্মরণসভা দেখা যায়না। শহীদ আনোয়ারা দিবসের খবরও আর পাওয়া যায় না। প্রতিবছর ছোট ছোট প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে যা ছাপা হয় তার শিরোনাম— ‘আজ শহীদ আনোয়ারা বেগমের …তম মৃত্যুবার্ষিকী’, ‘শহীদ আনোয়ারা স্মরণে আজ মিলাদ মাহফিল’, ‘শহীদ আনোয়ারা বেগমের মৃত্যুবার্ষিকী আজ’। এ রকম শিরোনামে ক্রমশ আমাদের চেতনা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে শহীদ আনোয়ারা বেগম। আনোয়ারা বেগমকে স্মরণীয় করে রাখতে চেয়ে সরকারিভাবে কিছু কাজ হয়েছে, যেমন ফার্মগেটে আছে শহীদ আনোয়ারা পার্ক। তবে সে সম্পর্কেও খুব বেশি কিছু আমরা জানি না, যেমনটা জানি না অবহলায় পড়ে থাকা ধুলোপড়া পুরনো সংবাদপত্রের স্তূপ থেকে বারবার উঠে আসা শহীদ আনোয়ারা বেগমের নাম।