আরিফ খাদেম : বেশ কয়েক বছর আগে কথা। সিডনির একটি ন্যাশনাল টিভি চ্যানেলে অস্ট্রেলিয়ার শীর্ষস্থানীয় পত্রিকা এবং টিভির কিছু জনপ্রিয় সাংবাদিক ও কলামিস্টদের নিয়ে আয়োজিত একটি অনুষ্ঠান উপভোগ করছিলাম। অনুষ্ঠানে অস্ট্রেলিয়ার রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি, ধর্মসহ বিভিন্ন বিষয়ের ওপর আলোচনা হচ্ছিল। আলোচনায় প্রত্যেকেরই বিভিন্ন বিষয়ে মতপার্থক্য ছিল। আবার যুক্তি-তর্কের মাধ্যমে একজন অন্যজনের কথা বা যুক্তি
আরিফ খাদেম : বেশ কয়েক বছর আগে কথা। সিডনির একটি ন্যাশনাল টিভি চ্যানেলে অস্ট্রেলিয়ার শীর্ষস্থানীয় পত্রিকা এবং টিভির কিছু জনপ্রিয় সাংবাদিক ও কলামিস্টদের নিয়ে আয়োজিত একটি অনুষ্ঠান উপভোগ করছিলাম। অনুষ্ঠানে অস্ট্রেলিয়ার রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি, ধর্মসহ বিভিন্ন বিষয়ের ওপর আলোচনা হচ্ছিল। আলোচনায় প্রত্যেকেরই বিভিন্ন বিষয়ে মতপার্থক্য ছিল। আবার যুক্তি-তর্কের মাধ্যমে একজন অন্যজনের কথা বা যুক্তি মেনেও নিচ্ছিলেন। তাদের আলোচনা থেকে এটাই শিখলাম এবং বুঝলাম যে, তারা কোনো বিশেষ দল বা সরকারের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেন না। যখন যে সরকার বা দলই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, তাদের আদর্শ সত্য বা ন্যায়ের পক্ষে, দেশের জনগণের স্বার্থ আদায়ের লক্ষ্যে। জাতীয় দৈনিকে তাদের লেখা পড়লে বা বিভিন্ন চ্যানেলে তাদের রিপোর্ট দেখলে তা-ই মনে হয়। আর এজন্যই তাদের আলোচনার (টকশো) একটা সুন্দর ইতি দেখতে পাই, যা আমাদের বাংলাদেশের প্রায় অধিকাংশ টকশোতেই দেখা যায় না; বিশেষ করে রাজনীতি বিষয়ক শো’গুলোতে।
আওয়ামীলীগ-বিএনপির মতই অস্ট্রেলিয়ার প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল হচ্ছে লেবার পার্টি ও লিবারেল পার্টি। নির্বাচনের আগে বা পরে কোনো পত্রিকা বা টিভি চ্যানেল কোনো বিশেষ দলের হয়ে তোষামোদি করে না। যদি সরকারি দল কোনো সংবাদ মাধ্যমে বিরোধী দলের সমালোচনা করে, তাহলে একই মাধ্যমে সরকারের বিরুদ্ধে বিরোধী দলের মন্তব্যও স্বাধীনভাবে স্থান পায়। এমনকি প্রত্যেকটি মিডিয়ায় সরকারের বিরুদ্ধে বেশিরভাগ রিপোর্ট প্রকাশ করে-এটা লেবার পার্টির সরকারই হোক বা লিবারেলের। কারণ সরকার ক্ষমতায় থাকলে জনগণের প্রতি তারা দায়বদ্ধ থাকে এবং বাস্তবে তাদের দেয়া অঙ্গীকারের কতটা প্রতিফলন ঘটছে, সেগুলোই বিভিন্ন মিডিয়ার সাংবাদিকরা জনগণের সামনে তুলে ধরেন। সিডনির সবচেয়ে জনপ্রিয় পত্রিকা হচ্ছে ‘সিডনি মর্নিং হেরাল্ড’। আমার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা—পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন দল ক্ষমতায় এসেছে, পত্রিকায় নতুন নতুন লেখক এসেছেন। দীর্ঘদিন একই পত্রিকা বা মিডিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকায় জুনিয়র থেকে হয়েছেন সিনিয়র লেখক, কলামিস্ট বা রিপোর্টার; কিন্তু কাউকে দেখিনি সরকার বা বিরোধী দলকে খুশি করতে বা কোনো সুবিধা ভোগ করতে কোনো লেখা লিখতে বা রিপোর্ট প্রকাশ করতে।
অন্যদিকে বাংলাদেশে চার ধরনের সাংবাদিক বা লেখকের বাস—১. এ গ্রুপের সাংবাদিক বা লেখকরা সরাসরি সরকারি দলের হয়ে কাজ করেন। সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে তাদের নীতি-আদর্শ বদলে যায়। অর্থাত্ যখন যে সরকার ক্ষমতায় আসছে, তারা ওই সরকারের আজ্ঞাবহ হয়ে কাজ করেন। সরকার দেশের ভালো করছে না খারাপ করছে, জনগণকে দেয়া ওয়াদা মোতাবেক কাজ করছে কি না, সেসব দিক পুরোপুরি উপেক্ষা করেন। সরকারকে খুশি করতে পারলে তারা কিছু ফায়দা লুটতে পারবেন, এটাই তাদের মুখ্য উদ্দেশ্যে। ২. তারা কিছুদিন নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করলেও হঠাত্ করেই নীতি বদলে ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধারে সরকারের বা বিশেষ কোনো রাজনৈতিক দলের এজেন্ডা বাস্তবায়নে কাজ শুরু করেন। এর পেছনে যুক্তি থাকুক আর না থাকুক, ব্যক্তিগত সমস্যাটাই প্রধান। এককথায়, তারা সুযোগসন্ধানী। ৩। তারা আজীবন বিশেষ কোনো রাজনৈতিক দল বা গোত্রের হয়ে লিখে যান। তারা কখনও ওই বিশেষ দলের মন্দ কাজের সমালোচনা না করে তাদের বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির সমালোচনায় মগ্ন থাকেন। ৪. সাংবাদিকদের একটি অংশ নিঃস্বার্থভাবে দেশ, ধর্ম, সংস্কৃতি ও জনগণের হয়ে কাজ করেন। তারা সর্বদা দেশ ও স্বাধীনতার পক্ষে লেখেন। সরকার বা বিরোধী দলের দেয়া হুমকিও তাদের কোণঠাসা করতে পারে না। নীতি তাদের এক ও অভিন্ন আদর্শ। ফলে দেশে ও বিদেশে তারা অধিকাংশ মানুষের ভালোবাসা পেলেও রাজনৈতিক সন্ত্রাসের শিকার হন। কারণ আমাদের দেশে উচিত কথার ভাত নেই।
উল্লিখিত চার ধরনের সাংবাদিক বা লেখকের মধ্যে আমাদের দেশে চতুর্থ বা শেষ গ্রুপের লেখকের বড়ই অভাব। অন্যদিকে উন্নত বিশ্বে এর ঠিক উল্টোটা ঘটে। প্রথম থেকে তৃতীয় গ্রুপের লেখক পাওয়া বেশ মুশকিল হবে। একই লেখক সরকার ও বিরোধী দলের তীব্র সমালোচনা করছেন। মানুষের সামনে দু’দলেরই ভালো-মন্দ তুলে ধরছেন। কেনো মন্ত্রী বা এমপি যদি কোনো অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়েন, সব মিডিয়া অকুতোভয়ে এর ওপর সংবাদ প্রকাশ করে। মন্ত্রী বা এমপিকে তার স্বীয় কাজের জবাবদিহি করতে হয়। যদি তা করতে ব্যর্থ হন, তত্ক্ষণাত্ পদত্যাগ করেন। লেখককে কখনও ভাবতে হয় না, তিনি কার বিরুদ্ধে লিখছেন। কারণ একজন মন্ত্রীর ক্ষমতা তার মন্ত্রণালয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আরও মজার বিষয় হচ্ছে, স্বয়ং দেশের প্রধানমন্ত্রীও পরামর্শ দেন পদ ছেড়ে দিতে। কোনো মিডিয়ায় নিরপেক্ষ সংবাদ পরিবেশন করার ফলে কোনো সাংবাদিক বা রিপোর্টারকে লাঞ্ছিত হতে দেখিনি।
কথায় আছে, ‘একজন বিদ্বান বা লেখকের কলমের কালি একজন শহীদের রক্তের চেয়েও উত্তম।’ কারণ একজন শহীদ তার রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা আনেন; অন্যদিকে একজন লেখক ওই স্বাধীনতাকে নস্যাতের হাত থেকে সর্বদা রক্ষা করেন। উন্নত দেশের সাংবাদিক ও লেখকদের মাঝে এ সততাটুকু আছে বলেই ক্ষমতাসীনদের বেশ বুঝে শুনে তাদের দেয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী দেশ চালাতে হয়। কারণ মিডিয়ার প্রতি তাদের প্রবল আস্থা আছে এবং তারা জানেন, এ সংবাদের ভিত্তিতে তারা জনগণের আস্থা হারাবেন ও ঘৃণার পাত্র হবেন। তাই তারা বেশ সতর্ক থাকেন এবং ক্ষমতার অপব্যবহার করেন না। এ কারণে উন্নত দেশগুলোতে দুর্নীতি কম হয়। অথচ আমাদের দেশের একশ্রেণীর অসাধু লেখকের কারণে অনেক রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা সুযোগ পান। একদল দুর্নীতিবাজদের পক্ষে লেখেন, আর অন্য এক দল লেখেন বিপক্ষে। এতে অনেকেই দুর্নীতি করেও পার পেয়ে যান। তাছাড়া দীর্ঘদিন থেকে দেখছি, তাদের লেখার মধ্যে তেমন বৈচিত্র্য নেই। একই বিষয়ের ওপর দিনের পর দিন লিখে যাচ্ছেন। অথচ তারা সবাই নিজেদের বেশ নামকরা সাংবাদিক বা লেখক বলে মনে করেন।
আমাদের দেশের যে কোনো সময়ের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলের নেতাসহ জাতীয় নেতাদের উচিত সাংবাদিকদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা। নিরপেক্ষ লেখালেখির জন্য যদি একটি দেশের সরকারপ্রধানরাই সাংবাদিকদের লালকার্ড দেখান, তাহলে একশ্রেণীর মানুষ সাংবাদিকদের গালি বা হুমকি দিতে সাহস পাবেই। সুদিন-দুর্দিনের ওপর ভিত্তি করে আজ এক পত্রিকার সাংবাদিককে হুমকি দেয়া হচ্ছে, কাল দেয়া হবে অন্য পত্রিকার সাংবাদিককে। একজনের লেখা অন্যজনের পছন্দ না হলে যুক্তিতর্কের মাধ্যমে কলমযুদ্ধেই জবাব দেয়া উচিত। গালি, হুমকি, গ্রেফতার, নির্যাতন বা রক্তপাতের মাধ্যমে নয়; যা শুধু অগণতান্ত্রিকই নয়, ছেলেমানুষিরও শামিল। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীও বাংলাদেশ সফরকালে এ অভিমত ব্যক্ত করে গেছেন। ২০১১ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা অস্ট্রেলিয়া সফরে এলে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জুলিয়া গিলার্ড তার সম্মানে ক্যানবেরায় এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন। অনুষ্ঠানের শুরুতেই প্রধানমন্ত্রী গিলার্ড অত্যন্ত হাস্যোজ্জ্বলভাবে ওবামা ও তার প্রতিনিধিদের সঙ্গে একে একে প্রথম সারির সাংবাদিকদের নাম, পদবি ইত্যাদি বিস্তাতিরভাবে বলে যেভাবে পরিচয় করিয়ে দিলেন, তা সত্যিই সভ্য ও সুস্থ পরিবেশের পরিচয় বহন করে।
যদি একটি দেশের অধিকাংশ সাংবাদিক সত্ ও ন্যায়ের পক্ষে থাকেন, তাহলে কোনো অপশক্তিই সাংবাদিক নির্যাতন দূরের কথা, তাদের বিরুদ্ধে সামান্য কটূক্তি করার আগে হাজারবার ভাববে। সাগর-রুনির মতো কোনো সাংবাদিককেও অকালে প্রাণ দিতে হবে না। আর যারা দুর্নীতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা আত্মসাত্ করে জনগণের আমানতের খেয়ানত করছেন এবং বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করছেন, তারা নিজেদের সোজা পথে চালাতে বাধ্য হবেন। এতে দেশে দুর্নীতি কমে যাবে। তাই সাংবাদিক সমাজের উচিত, দল-মত নির্বিশেষে শুধুমাত্র দেশ, ধর্ম, সংস্কৃতি ও জনগণের কথা মাথায় নিয়ে নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে যাওয়া। যখন যে দলই ক্ষমতায় বা বিরোধী দলে থাকুক, তাদের সম্পর্কে সত্য কথা প্রকাশ করা। কারণ আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, সুস্থ সাংবাদিকতাও (শিক্ষার মতোই) একটি জাতির মেরুদণ্ডস্বরূপ।
সিডনি প্রবাসী লেখক
Leave a Comment
Your email address will not be published. Required fields are marked with *