কায়সার আহমেদ: বিশ্বের ইতিহাসে প্রথম শ্রেণীর যত রাজনীতিবিদ জন্মগ্রহণ করেছেন, হযরত ওমর ফারুক (রা:) তাঁদের অন্যতম। তিনি ছিলেন ইসলামের ইতিহাসের ও খেলাফতে রাশেদীন এর দ্বিতীয় খলিফা। তার পূর্বপুরুষ কোনো রাজ্য শাসক ছিলেন না। ওমর (রা:) নিজেই তার রাজত্বকালে বলতেন ‘আমার বাবা উটের রাখাল ছিলেন, আমিও বাবার উটের রাখাল ছিলাম। মরুভূমিতে উট আর ভেড়া পালন করে
কায়সার আহমেদ: বিশ্বের ইতিহাসে প্রথম শ্রেণীর যত রাজনীতিবিদ জন্মগ্রহণ করেছেন, হযরত ওমর ফারুক (রা:) তাঁদের অন্যতম। তিনি ছিলেন ইসলামের ইতিহাসের ও খেলাফতে রাশেদীন এর দ্বিতীয় খলিফা। তার পূর্বপুরুষ কোনো রাজ্য শাসক ছিলেন না। ওমর (রা:) নিজেই তার রাজত্বকালে বলতেন ‘আমার বাবা উটের রাখাল ছিলেন, আমিও বাবার উটের রাখাল ছিলাম। মরুভূমিতে উট আর ভেড়া পালন করে জীবিকা অর্জন করেছি। আলেকজান্ডারের মত ওমর ফারুক (রা:) এর রক্তে রাজ্য শাসনের ইতিহাস ছিলো না। কিন্তু তার নেতৃত্ব ছিলো প্রবল শক্তিশালী, তিনি এমন একজন শাসক ছিলেন, যার গুণকীর্তন করতে তার চরম শত্রুরাও কখনো সংকোচ বোধ করেনি। । তার সুশাসন, ন্যায়বিচার, জনগনের প্রতি তার সার্বক্ষনিক দায়বদ্ধতা, সুনজর, সরল সহজ জীবন যাপন এবং চরিত্রের কাঠিন্যতা ও কোমলতা, তাকে কিংবদন্তি করে রেখেছে। ইসলামের প্রিয় নবী (সা:) নবুওত প্রাপ্তির ২৩ বছর গোপনে গোপনে ইসলাম প্রচার করেছিলেন। আত্মঘাতি শক্তি ও কাফিরদের ষড়যন্ত্রে তিনি সর্বদা শঙ্কিত ছিলেন । হযরত ওমর ফারুক (রা:) ছিলেন তাদের অন্যতম। তখনো তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন নাই। যৌবনের সুগঠিত দেহ ও অপূর্ব বীরত্ব সম্পন্ন তরুণ যুবক একদিন কোরআনের কালাম এর সুমধুর বাণী শ্রবণ করে মোহিত হয়ে পড়েন ও ইসলাম গ্রহণ করেন, এতদিন হযরত মোহাম্মদ (স.) গোপনে ইসলাম ধর্ম প্রচার করছিলেন, তাই যখন দেখলেন ওমর ফারুক (রা:) ইসলাম গ্রহন করেছেন তখন আর তাঁর ইসলাম প্রচারে কোন বাধা থাকতে পারেনা। ইসলামের প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) তার বিষয়ে বলেছেন “প্রত্যেক নবীর জন্যেই দু’জন আসমানী ও দু’জন জমিনী উজির আছেন। অমার দু’জন আসমানী উজির জিব্রাইল ও মিকাইল এবং দু’জন জমিনী উজির আবুবকর ও ওমর ফারুক (রা:)। তিনি আরো বলে গেছেন যে, তার পরে যদি কেহ নবী হতেন তাহলে সে হতো ওমর ফারুক (রা:)।
ওমর ফারুক (রা:) এর মেধাবী নেতৃত্ব, দায়িত্ববোধ এবং সততা মুসলমানদের ভৌগলিক সীমানার চেহারা পাল্টে দিয়েছিলো। শুধু তাই না, ওমর তার সকল সেনাবাহিনী প্রধানকে কড়া নির্দেশ দিয়েছিলেন যে বিজিত অঞ্চলের স্থানীয় লোকজনের কোন ভূখন্ড জবর দখল করা যাবে না, জোর পূর্বক কাউকে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করা যাবে না। ওমরের শাসন ব্যবস্থা ও রাজ্য জয়ের ইতিহাসকে বলা হয়ে থাকে ইসলাম ধর্মের প্রবল বিস্তারের ইতিহাস। তিনি ছিলেন তীক্ষèবুদ্ধি সম্পন্ন দূরদর্শী, বীর যোদ্ধা ও আল্লাহ তায়ালার প্রতি বিশ্বস্ত মহামানব মাত্র দশ বছরের শাসনামলে পবিত্র মক্কা হতে উত্তর দিকে ১৩৬০ মাইল, পূর্ব পর্যন্ত জয় করে প্রায় সাড়ে বাইশ লক্ষ্য বর্গমাইল এলাকা জুড়ে ইসলামের আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিলেন। আরবের মরুপ্রান্তর থেকে ওমর শাসনকালীন সময়ে ইসলাম প্রবেশ করেছিলো ইউরোপের সবুজ প্রান্তরে। দামেস্ক থেকে আরম্ভ করে কনসটান্টিনোপল, আলেকজান্ড্রিয়া, মিশর, পারস্য সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে ইসলামের মিলিশিয়ারা।
ইসলাম ধর্ম গ্রহনের পূর্বে, একদা উগ্র মূর্তিতে ওমর ফারুক (রা:) পথ চলছিলেন, পথিমধ্যে এক বন্ধুর সাথে দেখা হলে কোথায় যাচ্ছেন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছিলেন, চলছি মোহাম্মদের (সা:) গর্দান আনতে। তার বন্ধু নাঈম আব্দুল্লাহ বললেন বন্ধু আগে ঘর সামলাও। তোমার চাচাত ভাই সাইদ ও তার স্ত্রী তোমার বোন, উভয়ে মুসলমান হয়ে গেছেন সে খবর কি রাখো? তিনি বললেন তাই নাকি? তবেতো তাদেরকেই আগে শায়েস্তা করতে হয়। এই বলে তিনি আরো উগ্রমূর্তি ধারন করে সোজা চলে গেলেন সাইদ এর বাড়ীর দিকে। ঘরের কাছে পৌছতেই তিনি শুনতে পেলেন তারা কোরান শরীফ পাঠে রত আছেন। দরজায় করাঘাত করলেন। ভগ্নি ফাতেমা দরজা খুলে দিলে, তিনি সঙ্গে সঙ্গে মাথায় আঘাত করে রক্ত ঝরালেন এবং তার স্বামী সাইদকে মাটিতে ফেলে বেদম প্রহার করতে লাগলেন। সাইদ এর শরীর রক্তাক্ত হয়ে গেলো। মারধোর ও গর্জন অনেকক্ষন চললে, ফাতেমা তেজোদৃপ্ত কণ্ঠে ওমর ফারুককে লক্ষ করে বলে উঠলেন ভাইয়া আমরা ইসলাম ধর্ম গ্রহন করে মুসলমান হয়েছি, এই আমাদের অপরাধ। এই অপরাধেই আপনি যদি আমাদেরকে মারতে পারেন যত খুশী মারুন, মারতে মারতে মেরে ফেললেও আমরা আমাদের ধর্ম বিশ্বাস থেকে বিন্দু বিসর্গ বিচ্যুত হবো না।
ভগ্নির এমন জ্বালাময়ী কথায় ওমর (রা:) এর মধ্যে কেমন একটা অপূর্ব ভাবের সৃষ্টি হলো। একটু দুরেই পরে থাকা খোলা কোরান শরীফের পাতাটির আয়াতের দিকে তার নজর পড়লে তিনি তার ভগ্নিকে বললেন ঐ আয়াতে কি বর্ণিত আছে একটু পড়ে শোনাও। আয়াতটি ফাতেমা তার সুমধুর সুললায়িত কণ্ঠে পাঠ করলেন। আয়াতটির অর্থ: “একমাত্র আমি আল্লাহ! আমি ছাড়া আর কোন উপাস্য নেই। আতএব একমাত্র আমারই ইবাদত করো এবং আমাকে স্মরণের নিমিত্ত নামাজ প্রতিষ্ঠা করো। নিশ্চয়ই কেয়ামত আসবে। প্রতিটি মানুষ যে স্বীয় কৃতকর্মেও ফল লাভ করে সেই উদ্দেশ্যে আমি উহার তারিখ গোপন রেখেছি। যারা কেয়ামত বিশ্বাস করে না এবং নিজেদের প্রবৃত্তির দাসত্ব করে, তারা যেনো উহার প্রতি বিশ্বাস করে না এবং নিজেদের প্রবৃত্তির দাসত্ব করে, তারা যেনো উহার প্রতি বিশ্বাস পথচারী হতে আপনাকে বিরত রাখতে না পারে; অন্যথায় আপনি ধ্বংস হয়ে যাবেন।”
পবিত্র কোরানের এই অমোঘ বাণী ওমরের সঠিক জ্ঞানের দুয়ারে সজোরে আঘাত করলো। শান্ত, ধীর, মধুর ও কোমল কন্ঠে ওমর ফারুক (রা:) ফাতেমাকে বললেন “আমাকে মুহাম্মদ (সা:) এর নিকট নিয়ে চলো। তখন ওমরের ভয়ে চৌকির নিচে লুকিয়ে থাকা ফাতেমার শিক্ষক খাব্বার বিন আরাত বের হয়ে আসেন এবং তাকে ছাফা পর্বতের কাছে হযরত আরফাম ছাহাবীর ঘরে নিয়ে গেলেন, যেখানে তখন বিশ্ব নবী (সা:) প্রায় চল্লিশজন সাহাবীর মজলিশে নানাবিদ হিতোপদেশ দিচ্ছিলেন। এমন সময় ওমর ফারুক (রা:) গিয়ে দরজায় ধাক্কা দিলেন। জানালা দিয়ে সাহাবায়ে আকরাম হযরত ওমর (রা:) কে কোমড়ে ঝুলানো খোলা তরবারীসহ দরজায় দন্ডয়মান দেখে ভয়ে কম্পমান হয়ে পড়লেন। হযরত হামজাও সেই মজলিশে উপস্থিত ছিলেন। তিনি বললেন ওমর ফারুক (রা:) সৎ উদ্দেশ্যে এসে থাকলে তারই মঙ্গল আর সে যদি অন্য কোন কুমতলবে এসে থাকে তাহলে তার তরবারীর দ্বারাই তাকে দ্বি-খন্ডিত করে ফেলবো। আল্লাহ’র নবী কিন্তু বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে বললে “ওকে ভিতরে আসতে দাও”। তখন তিনি স্বয়ং দরজার কাছে গিয়ে ওমরের গায়ে হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলেন কি উদ্দেশ্যে এসেছো ওমর ফারুক (রা:)?
অতি নরম সুরে ওমর ফারুক (রা:) উত্তর দিলেন “ঈমান লাভের উদ্দেশ্যে। উত্তর শুনে ভাবাবেগে নবী করীম (রা:)-এর পবিত্র মুখ থেকে সজোরে “আল্লাহু আকবর” ধ্বনি বের হয়ে আসলো। সেই ধ্বনি সেই নির্জন পর্বত প্রান্তরকে প্রকম্পিত করে তুলেছিলো। হযরত ওমরের (রা:) ইসলাম গ্রহনের ফলে মুসলমানদের নবুওতের সুচনা হলো। বিধর্মীদের ভয়ে মুসলমানগন হেরেম শরীফের মসজিদে নামাজ আদায় করতে পারতেন না। পাহাড় পর্বতের আড়ালে, লোক চক্ষুর অন্তরালে লুকিয়ে লুকিয়ে নামাজ পড়তে হতো। ওমর (রা:) বললেন ইয়া রাসুলুল্লাহ বিধর্মীরা প্রকাশ্যে মূর্তি পূজা করবে। আর আমরা মুসলমান হয়ে সর্ব শক্তিমান আল্লাহতাআলার এবাদত বন্দেগী পালিয়ে পালিয়ে করবো, তাতো হতে পারে না। আল্লাহ রাব্বুলের এবাদত সবার সম্মুখে প্রকাশ্যভাবে হওয়া উচিৎ। এর পর থেকে হযরত ওমর ফারুক (রা:) ও হযরত হামজা (রা:), নবী করীম (সা:)-এর দেহরক্ষী হিসেবে সাথে যেতেন এবং নির্ভিঘেœই হেরেম শরীফের তাওয়াফ ও দুপুরের নামাজ পড়ে আসতেন। শুধু এটুকুতেই ওমর ফারুক (রা:) ক্ষান্ত হলেন না, বরং তিনি সংগ্রামের মাধ্যমে মুসলমানদের জন্য হেরেম শরীফে নামাজ পড়ার এমন অধিকার প্রতিষ্ঠা করলেন যার ফলে মক্কার মুসলমানগণ সম্মিলিতভাবে সেখানে যথারীতি নামাজ আদায় করে যেতে লাগলেন। বিধর্মীরা যে বাধা দিবে এমন সাহস তাদের হলো না।
বিশ্ব ঐতিহাসিকগণ ইতিহাসের বিখ্যাত বীর আলেকজান্ডারের সাথে ওমর ফারুক (রা:) খুব আকর্ষণীয় তুলনামূলক উদাহরন টেনেছেন। তাদের মতে আলেকজান্ডার বিশ বছর বয়সে রাজ্য শাসনের ভার গ্রহণ করার পর তার সেনাবাহিনীর সবচেয়ে তুখোর প্রশিক্ষকদের কাছ থেকে তীর আর তরবারি চালানো শিখেছিলেন। যুদ্ধের সমস্ত কলাকৌশল করায়ত্ব করেছেন। শুধু তাই নয় তার শিক্ষক ছিলেন স্বয়ং এরিস্টোটল। বিশ বছর বয়সে ক্ষমতা গ্রহন করে পরবর্তী দশ বছরে আলেকজান্ডার ১৮ লক্ষ্য বর্গমাইল এলাকা বিজয় করেছিলেন। এই বিজয়ের ইতিহাসে তার নির্দেশে নিজ সেনাবাহিনীর অসংখ্য সেনাপ্রধানকে গুপ্তঘাতকের হাতে প্রাণ দিতে হয়েছিলো। স¤্রাটের বিরুদ্ধে ক্ষোভের কারণে সেনাবহিনীর বড় একটা অংশকে ধ্বংসের মুখে পড়তে হয়েছিলো।
অন্যদিকে খলিফা হযরত ওমর ফারুক (রা:) দশ বছরের শাসনের সময় মুসলমানরা বিজয় করে ২২ লক্ষ্য বর্গমাইল এলাকা। খলিফার শাসনকালে তাকে কোনো বিদ্রোহের মুখোমুখি হতে হয়নি। বরং তার সততা দূরদর্শিতা ও নেতুত্বের কারণে পারস্য থেকে শুরু করে আলেকজান্দ্রিয়া পর্যন্ত মুসলিম বাহিনী খলিফা ওমরের নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে চলতো। শুধু তাই নয়, ইয়ারমুকের যুদ্ধে মহাবীর খালিদকে তিনি এক কথায় সেনাপ্রধানের পদ থেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন। খালিদ বিনা বাক্যে খলিফার নির্দেশ মেনে নিয়ে বাক্য ব্যয় না করে মুহূর্তেই নিজেকে সাধারণ সৈনিকদের কাতারে নামিয়ে এনেছেন এবং নতুন নিয়োজিত সেনাপ্রধানকে অভিবাদন জানিয়ে খালিদ বলেছিলেন যে এখন থেকে একজন সৈনিক হিসেবে আপনি আমাকে আরো বেশী সক্রিয় দেখতে পাবেন।
খেলাফত রাশেদীনের প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর (রা:) মৃত্যু শয্যায় তার প্রিয় বড় কন্যা আসমাকে বললেন ’মা আসমা লোক পাঠাও আমার প্রিয় সাথিদের আসতে বলো। ওমর, আলী, ওসমান, তালহা সকলকে আসতে বলো আমার কাছে। কিছুক্ষন পরে আবু বকর (রা:) এর দরজা দিয়ে ওমর (রা:) প্রবেশ করেন এবং বললেন ’হে রসুলের প্রিয় খলিফা আবুবকর আপনার শরীর তো খুব খারাপ। একজন চিকিৎসক নিয়ে আসি।
আবুবকর মৃদু হেসে বললেন, ‘যাবার সময় এসে গেছে। যিনি সমস্ত ডাক্তারদের ডাক্তার তিনি আমাকে দেখছেন। তিনি যা ইচ্ছে তাই করেন। তিনি সর্বশক্তিমান।
অসুস্থ আবুবকরকে দেখে ওমর খুব মন খারাপ করে বসে থাকলেন। একটু পরেই ওসমান, তালহা, আলি, আব্দুর রহমান ইবনে আওফ সহ অন্যান্য সম্মানিত বয়োজ্যেষ্ঠ সাহাবিরা খলিফার বাসায় আসতে থাকেন। তারা সবাই খলিফাকে ঘিরে চারপাশে বসেন। আবুবকর তা দীর্ঘদিনের সহচরদের পাশে দেখে একটু সুস্থ বোধ করেন।
তিনি সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলেন,‘তোমরা সবাই আমার অবস্থা দেখতে পাচ্ছো, আমি আর বেশি দিন বাঁচবো না। আল্লাহ তাআলা আমার বন্ধন থেকে তোমদেরকে মুক্ত করে দিয়েছেন এবং তোমাদের দায়িত্ব থেকে আমাকেও রেহাই দিয়েছেন। তোমাদের নেতৃত্বের ভার আমি তোমাদের কাছে ফিরিয়ে দিতে চাই। তোমরা নিজেদের পছন্দ মত একজন আমির নিযুক্ত করো। তোমাদের নেতা নির্বাচিত করো। আমার জীবদ্দশায় নেতা নির্বাচিত করতে পারলে সেটা হবে সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্ত। তাহলে আমি মারা যাওয়ার পর তোমরা মতবিরোধে জড়াতে পারবে না।
ওমর বললেন আল্লাহ’র রসুলের প্রিয় খলিফা এটা কি পরবর্তী খলিফা নির্বাচনের উপযুক্ত সময়? আপনি দারুন অসুস্থ, আপনার চিকিৎসা প্রয়োজন। আবুবকর (রা:) বললেন হে ওমর আল্লাহ’র শপথ করে বলছি এটাই উপযুক্ত সময়। তোমরা সবাই পরামর্শ করে এসে আমাকে জানাও। এখন তোমরা যাও। এক সাথে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে আসো।
বাড়ি বের হয়ে খলিফার সাথিরা রওয়ানা হলেন মসজিদে নববীর দিকে। পথিমধ্যে ওমর দাড়িয়ে পড়লেন এবং সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন তোমাদের এই আলোচনায় আমি নাই। আল্লাহ’র রসুলের প্রিয় খলিফা আবুবকর এখনো বেঁচে আছেন। তার জায়গায় কে খলিফা হবেন আমি জানি না। তবে একটা জেনে রাখো তোমরা সবাই অনেক যোগ্যতাবান মুসলিম বিশ্বের নেতা হবার জন্যে। নবি মোহাম্মদ (সা:) এর প্রিয় সাথি তোমরা। তোমাদের মধ্য থেকে যাকে তোমরা খলিফা নির্বাচিত করবে আমি তার পাশে আছি। কিন্তু এখন আমি এর মধ্যে থাকতে পারবো না। এই বলে তিনি স্থান ত্যাগ করলেন। দুপুর পর্যন্ত সাহাবিরা আলোচনা করলেন কিন্ত কোন সিদ্ধান্তে পৌছতে পারলেন না। তাদের মতে নিজে ব্যতিত সবাই খলিফা হওয়ার জন্যে অধিকতর যোগ্য। সবাই খলিফা আবুবকর এর নিকট গেলেন এবং তারা বললেন হে খলিফা আপনিই সিদ্ধান্ত নিন কে আপনার উত্তরসুরি খলিফা হবেন। আপনি যাকে খলিফা বানাবেন আমরা এক বাক্যে তা মেনে নিবো। আপনার সিদ্ধান্তই আমাদের সিদ্ধান্ত। অত:পর আবুবকর বললেন, তোমাদের ওমরকে কেমন মনে হয়? তখন এক বাক্যে সেটাই মেনে নেয়। হযরত ওমর ফারুক (রা:) হলেন খেলাফতে রাশেদীনের দ্বিতীয় খলিফা।
হযরত ওমর ফারুক (রা:) খুবই সাধারন জীবন যাপন করতেন। তিনি কোন প্রাসাদে থাকতেন না। মসজিদে নববী থেকে তিন মাইল দুরে কোবা এলাকায় ওমর (রা:) বসতি। মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করে আসার পর আনসার সাহাবি রেফায়া ইবনে মুনজির তার নিজের বাড়ি ওমর (রা:) কে থাকার জন্যে ছেড়ে দেন। হিজরতের পর থেকে তিনি এই রাড়িতেই অবস্থান করতেন। কাঠ, লাল মাটি, আর পাথরের তৈরি ছিলো ওমর (রা:) এর বাড়ি। মোটা শুকনো খেজুর গাছের গুড়ি দিয়ে মাটিতে ঢাকা বাড়ির মূল গম্বুজুগুলো। বাড়ির দেয়ালগুলো নরম লাল মাটির প্রলেপ দিয়ে ঢাকা। মাটির ভেতর আহামরি কোন দ্রব্য নেই। সর্বমোট তিনটে ঘর। ভেতরের ঘরে ওমর (রা:) থাকতেন। দুই ঘরের মাঝখানে ছোট্ট একটু হাঁটার জায়গা ছিলো। মেঝে খেজুরের পাটি দিয়ে ঢাকা। ভেতরে যে ঘরে অতিথিরা এসে বসবেন তার মেঝে মোটা সুতি কাপড়ে ঢাকা থাকতো।
তেমনি খেলাফতে রাশেদীনের প্রতাপশালী খলিফার এক রাতের গল্প। রাতের খাবার খেতে বসেছেন ওমর (রা:)। বাইরে আঁধার রাত। ঘরের ভেতর বেশ শীত। ঝিঁঝি পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে। দূরে কোথাও মরুভুমিতে হয়তো একটা শেয়াল ডেকে যাচ্ছে। মদিনার ঠান্ডা বাতাসে শেয়ালের করুন ডাক ভেসে আসছে।
রাতের খাবারে যবের রুটির সাথে ভেড়ার শুকনো মাংস, মধু আর ডুমুর ফল ওমর (রা:) এর খুবই প্রিয়। সব সময় অবশ্য এ ধরনের খাবারের আয়োজন সম্ভব হয়ে উঠে না। আজ খেতে বসে দেখলেন কেবল শুকনো ঠান্ডা রুটি আর কয়েকটুকরো খেজুর। ওমর (রা:) আহত চোখে স্ত্রীর দিকে তাকান।
ঘরে আর কিছু নেই?
‘না সব শেষ হয়ে গেছে। নতুন করে বাজার থেকে সব আনতে হবে।
ওমর বিসমিল্লাহ বলে খাওয়া শুরু করেন। এক লোকমা খাওয়ার পর স্ত্রীর দিকে তাকান।
‘আতিকা তুমি খেয়েছো?’ ওমর বলেন।
‘আপনি খাওয়ার পর আমি খাব।’
ওমর রুটি টুকরো ছিঁড়ে আতিকার মুখে তুলে দেন।
‘ঘরে কি মধু ছিলো না?’
‘সব শেষ হয়ে গেছে। আপনাকে বলেছিলাম দারুস সাদের বাজার থেকে সব কিছু নিয়ে আসতে।’
‘খুব ভুল হয়ে গেছে আতিকা। আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ যা রিজিকে রেখেছেন তাতেই আমি কৃতজ্ঞ।’
‘শুধু আল্লাহকে খুশি করলেই হবে মাঝেমাঝে ঘরের মানুষকেও খুশি রাখতে হয়।’
আতিকার অভিমানী কথা ওমর এর কান স্পর্শ করে।
‘এমনটা কেনো বলছো আতিকা? আমি কি তোমাকে খুশি রাখতে পারিনি? তুমি অখুশি হলে কি জবাব দিবো আল্লাহর কাছে?’
আতিকা অভিমানী সুরে বলে, ’আপনাকে জায়তুনের তেলে ভেজানো জলপাই নিয়ে আসতে বলেছিলাম। ভুলে গেছেন আপনি।’
ওমর (রা:) হেসে উঠেন। খেজুর রুটি আর শুকনো রুটি দিয়ে রাতের খাবার শেষ করে ওমর (রা:) দাঁড়ান।
আল্লাহ’র রসুলের প্রিয় সাথি ওমর (রা:) জীবনি কয়েক পাতায় লিখে শেষ করা সম্ভব নয়, ্এখানে সামান্য অধ্যায় তুলে ধরা হলো মাত্র।
সুত্র: আল্লামা তালিবুল হাশেমী এবং রাফিক হারিরি। ২১শে মে ২০২৩
Leave a Comment
Your email address will not be published. Required fields are marked with *