অনেক সময় অনেক মেয়েকেই নানা ধরনের দুর্ভোগ পোহাতে হয়। জানি না মানুষ কেন এভাবে তাকায়! আমি ছাড়াও তো এই পৃথিবীতে অনেক মেয়ে আছে। যে আমার দিকে খারাপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তারও তো বাড়িতে মা, বোন, বউ বা মেয়ে এমন মেয়ে মানুষ আছে। তারা কী তাদের নিজের মেয়েদেরকে এভাবেই দেখে? মাত্র পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ি। একদিন মায়ের
অনেক সময় অনেক মেয়েকেই নানা ধরনের দুর্ভোগ পোহাতে হয়। জানি না মানুষ কেন এভাবে তাকায়! আমি ছাড়াও তো এই পৃথিবীতে অনেক মেয়ে আছে। যে আমার দিকে খারাপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তারও তো বাড়িতে মা, বোন, বউ বা মেয়ে এমন মেয়ে মানুষ আছে। তারা কী তাদের নিজের মেয়েদেরকে এভাবেই দেখে?
মাত্র পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ি। একদিন মায়ের সাথে নিউ মার্কেট গিয়েছিলাম। সন্ধ্যা হয়ে গেছে তাই মায়ের খুব কাছাকাছি হাঁটছি। হঠাৎ কীভাবে যেন মা একটু সামনে চলে যায়। আমি খুব তাড়াতাড়ি হাঁটছি মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য। এর মাঝেই পিছনে থেকে কে যেন আমার গায়ে জোরে ধাক্কা দিয়ে পেটে হাত দিয়ে দ্রুত চলে যায়। আমি ভয় পেয়ে মনের অজান্তেই চিৎকার দিয়ে মা’কে ডাকি। মা আমার ডাক শুনে পিছনে তাকিয়ে দেখে আমি পিছে পড়ে গেছি। আমার এমন চিৎকার শুনে মা দৌড়ে কাছে এসে বলে, কী হয়েছে? তুমি পিছিয়ে গেলে কীভাবে? কেউ কিছু বলেছে?
আমি কেন যেন না বললাম। তবে মায়ের হাত শক্ত করে ধরে রাখলাম। আজও বলতে পারি না কেন বলি নাই মা’কে সেদিন?
এরপর কখনো বাসে বা কখনো রাস্তায় বাজে কমেন্ট শুনতাম। ঘৃণা লাগত উত্তর দিতে। কিন্তু মন চাইত ওদের জিহ্বা টেনে ছিড়ে ফেলি। এত এত কিল ঘুসি মারি যে আদমরা হয়ে যাক। কিন্তু এইসব মানুষ নাকি ভয়ংকর হয়। সুযোগ পেলেই প্রতিশোধ নেয়। টিভি আর খরবের কাগজে এমন সংবাদ প্রায়ই আসে। ভয়ে কুঁচকে যাই।
এমন পরিস্থিতিতে পড়লে মনে হয়, আমি কী দেখতে এতই বাজে যে ঐসব মানুষ আমাকে এসব বাজে কথা বলে? আমার মধ্যে এমন কী আছে যে এমন কথা বলে আমাকে দেখে। অনেক কষ্ট লাগত। বারবার নিজেকে প্রশ্ন করতাম। কতদিন একা একা কেঁদেছি। মা বাবাকে বলতে লজ্জা লাগে। কখনো তো ভয়ও লাগে। যদি বাবা মা বিশ্বাস না করে তাহলে কী করবো?
একদিন আমি, আমার চাচাতো বোন মুন্নী আপু আর সুমন ভাই বসুন্ধরা যাবো। আমি আর আপু আগেই নিচে নেমে বুদ্ধি করছি আমরা কী কী খাবো আর মুভি দেখার বায়না ধরবো ভাইয়ার কাছে। ভাইয়া চাকরি পেয়েছে। এই সুযোগ তো হাত ছাড়া করা যায় না। ভাইয়াকে বলে এসেছি তুমি আসো আমরা নিচে আছি।
হঠাৎ একটা রিকশাওয়ালা পিছনে এসে বেল বাজিয়ে বলে, কী গো নায়িকারা যাবা নাকি আমার সাথে। খুব মজা হইবো। দেখতো তো ভালাই ডাঙ্গর।
ভাইয়া যে পিছনে দাঁড়িয়ে ছিল এটা কেউ দেখিনি আমরা। রিকশাওয়ালা আর কই যায়। ভাইয়া শয়তানটার শার্ট ধরে রিকশা থেকে নামিয়ে এমন কিল ঘুসি আর চড় মারলো। বেটার চোদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করে দিল। অনেক মানুষ জমা হলো। তারা শুনে তো আগুন। এলাকার মেয়েকে একটা রিকশাওয়ালা এত বাজে কথা বলেছে! তারাও কয়েকজন মিলে দিল চড়। পুলিশে দিতে বলল কয়েকজন। কিন্তু এমনিতেই লোকটা অনেক মার খেয়েছে। তাছাড়া পা ধরে ক্ষমা চাচ্ছিল। তাই ছেড়ে দেওয়া হলো। কিন্তু এরপর ওকে এই মহল্লায় দেখলে খবর আছে বলে দেওয়া হলো। সেদিন ভাইয়াকে হিরো মনে হয়েছিল। সত্যি যদি মুন্নী আপুর মতো আমারও এমন একটা ভাই থাকতো! কিন্তু ভাই তো সবসময় সাথে থাকে না।
একদিন গ্রাম থেকে আম্মুর কেমন যেন চাচা এলো। আম্মু আমাকে সালাম দিয়ে কথা বলতে বলে নাস্তা আনতে গেল। লোকটা আমার গা ঘেষে বসেছিল আর আমার কোমড় আর পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে কথা বলতে লাগল। আমার এত খারাপ লাগছিল। কিন্তু আম্মুকে বলতে পারিনি। কোন রকমে সরে গিয়েছিলাম। মুরুব্বি মানুষও এমন হতে পারে! অথচ সে আমার দাদার বয়সের একজন।
এতকিছুর পরে শুধু নিজেকে দোষী মনে হত। মানুষ কী শুধু আমার সাথেই এমন করে? আর কাউকে তো এমন করে শুনি না। তাহলে কী আমার মধ্যে কোনো দোষ আছে?
তবে আমার ধারণা ভুল প্রমাণ করতে একদিন একটা ঘটনা ঘটে গেল। আমার স্কুলের ক্লাস টেনের দিপা আপু আর আমি এখন এক সাথে বাসে স্কুলে যাই। তাছাড়া আমি এখন ক্লাস এইটে পড়ি। মা একটু অসুস্থ তাই আপুর সাথে যাচ্ছি কিছু দিন। বাসে উঠে আমরা সিট পেলাম না। এদিকে সময় কম স্কুলে পৌঁছাতে হবে। তাই দাঁড়িয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা। আপু আমাকে বাসের সামনের দিকে একটা রড ধরিয়ে দাঁড়িয়ে দিয়ে একটু পিছনে আর একটা রড ধরে দাঁড়ালো। হঠাৎ আপু চিৎকার করে বলে উঠলো, আরে ভালো করে ধরেন না। লুকিয়ে গায়ে হাত দেন কেন? হাত দেওয়ার সাহস যখন আছে তখন সবার সামনে দেন। বাসে মেয়ে মানুষ দেখলে কী মাথা ঠিক থাকে না? নিজের মেয়ের বয়সী মেয়ের গায়ে হাত দিতে বুক কাঁপে না? নির্লজ্জ মানুষ কোথাকার?
লোকটা শুধু বলল, কী সব বাজে কথা বলে? আমি কিছুই করিনি। বাসে উঠলে এমন গায়ে গা তো লাগবেই। এত খারাপ লাগলে বাসে না উঠে প্রাইভেট কারে উঠলেই হয়। এত ছোট মেয়ে কী মুখের কথা।
আপু রাগে লাল হয়ে বলল, আমি বাসেই যাবো। টাকা দিয়ে যাই। আপনি আপনার অভদ্র আচরণের জন্য শাস্তি পাবেন। বাসের হেলপারলে ডেকে আপু বলল, সামনে পুলিশের চেক পোস্টে গাড়ি থামান মামা। আজ দেখেই ছাড়বো এই লোককে। লোকটা ভয় পেয়ে তার আগেই নেমে গেল। সবাই দেখল শুধু কেউ তেমন কিছু বলল না। তবে কারো কিছু বলার সাহস বা ইচ্ছা না থাকলেও দিপা আপু একাই একশো ছিল।
আমি বাস থেকে নেমে আপুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তোমার অনেক সাহস আপু। তোমার সাথে কীভাবে এমন করতে পারলো লোকটা! আপু বলল, শুধু আমার সাথেই না এরা সব মেয়ের সাথেই এমন করে। মুখ বুজে সহ্য করলে আরও বেশি করে। তাই মা সাহস দেখাতে বলে। চুপ করে থেকে নিজেকে কষ্ট দিব কেন? এগুলো জঘন্য অপরাধ। তাদের অবশ্যই শাস্তি প্রাপ্য। ছেড়ে দিলে আরও বাড়বে এসব জঘন্য অপরাধ। তুইও কখনো চুপ করে থাকবি না। দরকার হলে চড় থাপ্পড় দিয়ে দিবি। নিজেকে বাঁচাতে আর নিজের আত্মসম্মান বাঁচাতে যা লাগে করবি। ছেড়ে দিবি না একদম। সেদিন জেনেছিলাম শুধু আমার সাথেই এসব হয় না। অনেকের সাথেই হয়। তবে সবাই সাহস দেখিয়ে বলতে পারে না। এরপর থেকে আমি আর কোনদিনই এসব গোপন করে সহ্য করিনি। প্রতিবাদ করেছি সবার সামনে। চুপ করে থেকে নিজেকে অসহায় করে রাখিনি। নিজের বিবেককে দংশন করতে দেইনি।
একদিন আমার সামনে আমার মায়ের বয়সের এক মহিলার গায়ে এক লোক বারবার হাত দিচ্ছিল। মহিলা কিছু বলতে পারছিল না। সরে সরে যাচ্ছিল। পরে আমি সামনে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কী চাচা? কী সমস্যা? ওনাকে এভাবে বিরক্ত করছেন কেন? এগুলো করতেই বাসে উঠেন নাকি? এসব জঘন্য কাজ করে মজা নেন? আপনার বউ বা মেয়ের সাথে কেউ এমন করলে কেমন লাগত আপনার?
আমার কথায় লোকটা আগুনের মতো জ্বলে উঠলো। আমাকে চড় মারার জন্য হাত তুলল। ততক্ষণে ঐ আন্টিই ওনার গালে কষে একটা চড় মেরে দিয়েছে। আরও কয়েকজন লোক বাস থামিয়ে লোকটাকে বাস থেকে নামিয়ে দিল। আমাকে আর ঐ আন্টিকে বসার জন্য সিট দিল দুইজন লোক। সত্যি কতো আজব দুনিয়া। খারাপ ভালো মিলেই পৃথিবী। কিন্তু এই জঘন্য অপরাধ চুপ করে মেনে নেওয়াও চরম বোকামি। সন্তানদের বোঝাতে হবে এগুলো মেনে নেওয়া উচিত নয়। তাদের এসব মোকাবিলা করতে হবে। আর সবার মনে রাখা উচিত সবার ঘরেই মেয়ে মানুষ আছে। শুধু গায়ে হাত দিলে বা বাজে কথা বলাই অপরাধ নয়, বাজে দৃষ্টিতে তাকালেও অপরাধ।
Leave a Comment
Your email address will not be published. Required fields are marked with *