তাসলিমা তাজ: শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সালের ২১শে এপ্রিল মাত্র ৪১ বছর বয়সে বালাদেশের রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত হন। সে সময় বিশ্বের প্রভাবশালী রাষ্ট্রপ্রধান জিমি কার্টার, জেমস ক্যালাহান, মার্গারেট থ্যাচার , ভ্যালেরী রিস্কা ডেস্টা, লিওনেড ব্রেজনেভ, মার্শাল টিটো কিংবা সৌদী কিং খালিদ ইবন আবদ আল আজিজ আল সাউদ এর মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। সে সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে পেট্রোলিয়ামের মূল্য বৃদ্ধি, আফগান – সোভিয়েত যুদ্ধ, ফকল্যান্ড যুদ্ধ, ইরান- ইরাক যুদ্ধ, ইরানের মার্কিন হোস্টেজ নেগোশিয়সনের মত বিষয়গুলো তখন বিশ্ব রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে এবং নেতীবাচক প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। এরকম সংকটময় পরিস্থিতিতে যুদ্ধ বিধ্বস্ত এবং দূর্ভিক্ষকবলিত একটি দেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে শহীদ জিয়া একই সাথে মধ্যপ্রাচ্য ও পশ্চিমা দেশের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করেন এবং বিশ্বসংকটময় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। আন্তর্জাতিক মহল এখন অব্দি শহীদ জিয়ার এই অবদানকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন, যা ভারত ( ইন্ডিয়া টুডে)র জন্য যেনো হতাশার কারন হয়ে দাঁড়ায়। রুগ্ন, ক্লিষ্ট অর্থনীতিকে ঘুরিয়ে মাত্র তিন বছরে জিডিপি দ্বীগুন করার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অঙ্গণে নের্তৃত্ব দেওয়া — শহীদ জিয়ার এই কারিশমা ভারত (ইন্ডিয়া টুডে) র মেনে নিতে কষ্ট হয়, নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে এবং অযাচিত সমালোচনা মূখর হয়। এই লিখাটির মাধ্যমে শহীদ জিয়ার পররাষ্ট্র নীতির কয়েকটি সাফল্য তুলে ধরার মাধ্যমে ভারতীয় পত্রিকা “ইন্ডিয়া টুডে” র সমালোচনার জবাব দেওয়ার চেষ্টা করবো।
বাংলাদেশ স্বাধীন হলে সৌদী আরব সহ অন্যান্য তেল সমৃদ্ধ মুসলিম দেশগুলো বাংলাদেশকে সমর্থন দিতে প্রাথমিক ভাবে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। মুসলিম ঐ দেশ গুলো মনে করতো যে পূর্ব পাকিস্তান বিভক্ত করার জন্য অমুসলিম দেশ হিসেবে ভারতের ভূমিকা রয়েছে। তাই উনারা মরহুম রাষ্ট্রপতি শেখ মুজীবর রহমানকে সেই ভাবে গ্রহণ করতে ইতস্তত করতেন। যে কারনে চীন এবং সৌদী আরব বাংলাদেশ কে সমর্থন দিয়ে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিলো ৭৫ এর ১৫ই আগষ্ট এর পর। সেসময় রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবর রহমান মুসলিম তেল সমৃদ্ধ রাষ্ট্রগুলোর সাথে সম্পর্ক স্থাপনের জন্য দুজন প্রতিভাবান কূটনীতিবিদকে পাঠালেও তেল সমৃদ্ধ দেশ গুলোর সাথে আন্তরিকতা তৈরী করতে পারেন নাই। শহীদ জিয়া এখানে অত্যন্ত সফল হন। উনি ওপেক (অর্গানাইজেশন অব পেট্রোলিয়াম এক্সপোর্টিং কান্ট্রি) গুলোর সাথে আন্তরিক সম্পর্ক তৈরী করেন।
অন্যদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার ব্যক্তিগত ভাবে শহীদ জিয়াউর রহমানকে তাঁর উদার ও প্রগতীশীল, গনতান্ত্রিক মনোভাবের কারনে খুবই পছন্দ করতেন। ফলে , পশ্চিমা বিশ্ব এবং মুসলিম বিশ্বের মধ্যে যোগাযোগের এক সেঁতুবন্ধন হন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়া।
১৯৭৯ সালে ইরান বিপ্লবের ফলে তেলের উৎপাদন কমে যাওয়ায় জ্বালানী সংকট দেখা যায় এবং অপরোশিধিত তেলের দাম বৃদ্ধি পায়। শহীদ জিয়া ওপেকের সদস্য দেশ গুলোর সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকার সুবাদে তেলের মূল্য কমানোর ক্ষেত্রে বিশেষ নেগোশিয়েসন করা শুরু করেন। পরবর্তীতে শহীদ জিয়া এই বিষয়টি জাতীসংঘের নিরাপত্তা অধিবেশনে উল্লেখ করেন এবং প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারকে আশ্বস্ত করেন।
১৯৮০ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার ও শহীদ জিয়ার মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দুটি বিষয়– ইরানের সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর হাতে বন্দী মার্কিনীদের মুক্তি এবং আফগানিস্তান হতে রুশ সৈণ্য প্রত্যাহারের বিষয় আলোচিত হয় এবং পরবর্তীতে এই বিষয় দুটির শান্তিপূর্ণ সমাধানে শহীদ জিয়ার অবদান সুস্পষ্ট ভাবে পরিলক্ষিত হয়।
১৯৭৯ সালের ৪ঠা নভেম্বর ইরানি জঙ্গিরা তেহরানে মার্কিন দূতাবাস দখল করে ৬৬ জন আমেরিকানকে বন্দী করে। জিম্মি ৬৬ জনের মধ্যে ৬ জন পালিয়ে যান এবং ৮ জনকে ১৯৭৯ ও ৮০ সালে মুক্তি দেওয়া হয়। বন্দী মুক্তির দাবীতে বিভিন্ন সময়ে আলোচনা ও আন্তর্জাতিক চাপের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৮১ সালের জানুয়ারীতে বাকী ৫২ জন আমেরিকান কে মুক্তি দেওয়া হয়।
১৯৭৮ সালে একটি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পিডিপিএ আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করে এবং নূর মুহম্মদ তারাকী রাষ্ট্রপতি পদে আসীন হন। দলটি দেশজুড়ে প্রচলিত ইসলামী মূল্যবোধ ধ্বংস করে কার্ল মার্কস এর কমিউনিজম আগ্রাসনের সূচনা করে যা আফগানীদের ক্ষেপিয়ে তোলে। বিদ্রোহ দমন করতে তারাকী প্রায় ২৭,০০০ রাজনৈতিক বন্দিকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে। আফগান কমিউনিস্ট শাসকদের দ্বারা কমিউনিজম এর স্বার্থ পুরোপরিভাবে উদ্ধার না হওয়ায় এবং আফগানিস্তানে ব্যাপক বিদ্রোহের কারণে লিওনিদ ব্রেজনেভের নেতৃত্বে সোভিয়েত সরকার ১৯৭৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর আফগানিস্তানে সোভিয়েত ৪০তম আর্মি মোতায়েন করে। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান স্পষ্ট ভাবে রুশ সরকারের সমালোচনা করেন। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়া তখন ৩৪টি মুসলিম দেশের সরকার প্রধানের সাথে আলোচনা করে রুশ সৈণ্য প্রত্যাহারের বিষয়ে ঐক্যমত গড়ে তুলতে ভূমিকা রাখেন। এরই ধারাবাহিকতায় শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়া পশ্চিমা বিশ্বকে আফগান হতে রুশ সৈন্য প্রত্যাহারের বিষয়ে ভূমিকা রাখতে অনুরোধ জানান।
এই পর্যন্ত এসে এখন শহীদ জিয়া সম্পর্কে ভারতীয়দের সংকীর্ণ মতামতের দিকে দৃষ্টি দিব : ২০১৪ সালে ইন্ডিয়া টুডে শহীদ জিয়ার বৃটেন ভ্রমণের উপর একটি নেতীবাচক কলাম প্রকাশ করে, যা ভারতীয় সংকীর্ণ ও কদর্জ মানসিকতার পরিচয় বহন করে।
শহীদ জিয়ার বৃটেন সফরের বিষয়ে ইন্ডিয়া টুডে লিখেন “তিনি বৃটেনে ভিক্ষার বাটি প্রসারিত করে আসছেন”।
অথচ ২০১৫ সালে ইউএসএআইডির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ১৯৪৬ – ২০১২ সাল পর্যন্ত ভারত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হতে সর্বোচ্চ সাহায্য নিয়েছে।
তাহলে প্রশ্ন রইলো ভিক্ষার বাটি কার হাতে ????
ভারতই কিন্ত এখনো ভিক্ষার বাটি নিয়েই অপেক্ষায় থাকে।
ইউকে এইড টু ইন্ডিয়া রিপোর্টে, ইন্ডিপেনডেন্ট কমিশন ফর এইড ইমপ্যাক্ট দেখেছে যে ইউ.কে ২০১৬ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে ভারতকে ২.৩ বিলিয়ন পাউন্ড ($2.8 বিলিয়ন) সাহায্য দিয়েছে, যা এটিকে ইউকে সাহায্যের ১১তম বৃহত্তম প্রাপক।
ভারত ছিলো দক্ষিন এশিয়ার একমাত্র দেশ যে কি না সেই সময়ে আফগানিস্থানে রুশ আগ্রাসনকে সমর্থন করেছিলো এবং এখনোও রাশিয়া কর্তৃক ইউক্রেন আক্রমনের পক্ষে কথা বলেন। আর একারনেই আগ্রাসী ভারতীয় পত্রিকা শহীদ জিয়ার আফগানে রুশ সৈন্য মোতায়নের জোড়ালো প্রতিবাদ কে “অর্থনৈতিক সাহায্য আদায়ের জন্য মরিয়া চেষ্টা” বলে অভিহিত করেছেন।
সম্প্রতি ভারতীয় প্রতিনিধি দল তালেবানের নেতৃত্বের সাথে সাক্ষাত করার জন্য নিঃশব্দে দোহা সফর করেছিল এবং সার্কের উদ্যোক্তা হিসেবে শহীদ জিয়ার সমালোচনা ও বিরোধিতা স্বত্বেও ভারত কিন্ত ঠিকই সার্কের মতাদর্শে উদ্ধুদ্ধ হয়ে দক্ষিন এশিয়ার নিজেদের অবস্থান পাকাপোক্ত করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে এবং সেই লক্ষে কাজ করে যাচ্ছে।
একই লিখায় ভারত নিজেদেরকে “প্রযুক্তি এবং বৈজ্ঞানিক দক্ষতার দিক থেকে সবচেয়ে উন্নত” দাবী করেন অথচ বাস্তব চিত্রে দেখা যায় ভারতের শিক্ষার হার শ্রীলংকার থেকেও কম। ভারতে ১৮৮ জন বিলিওনিয়ার রয়েছেন যারা দেশের ৭.২% বেকারের খবর রাখেন না, ৪ কোটি নারী ও শিশুর জন্য শৌচাগার নির্মানের প্রয়োজন মনে করেন না। প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানে উন্নত হওয়া স্বত্বেও ধর্মীয় অসহিষ্নুতা ও সোশ্যাল কাস্ট সিস্টেমের বলি হয়ে লাখ লাখ মানুষ হারিয়ে যাচ্ছে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে উন্নত হওয়া স্বত্বেও খোদ রাজনীতিবিদগণ গরুর মল মূত্র সেবনের পক্ষে স্লোগান দিচ্ছেন, গরুর মল মূত্র খাওয়ার বিশেষ পার্টি দিচ্ছেন।
উল্লেখ্য, দিল্লীর সাবেক রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং কূটনীতিকবৃন্দও শহীদ জিয়ার কূটনৈতিক দক্ষতাকে সম্মানের সাথে স্বীকার করেছেন। যার প্রমান শহীদ জিয়ার ‘১৯৭৭ ও ৮০’ সালের ভারত সফর পর্যালোচনা করলে পরিস্ফুত হবে।
‘৭৭ সালে ভারতীয় রাষ্ট্রপতি নীলম সন্জীব রেড্ডি শহীদ জিয়াউর রহমানকে ” ইতিহাসের সাহসী যোদ্ধা ,বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাকারী এবং আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে একজন উঁচুমানের গ্রহণযোগ্য নেতা ” বলে স্বীকার করেছিলেন।
প্রয়াত সন্জীব রেড্ডি, ইন্দিরা গান্ধী কিংবা মোরারজি দেশাই এর মত রাষ্ট্রনায়ক যাকে শ্রদ্ধা করতেন, ইন্ডিয়া টুডে তাঁকে অপমানিত করার চেষ্টা করেছেন। মূলত আপনারা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে নয়, আপনাদের পূর্ববর্তী নেতাদেরই অপমানিত করেছেন। আপনারা তো আপনাদেরই সম্মান দিতে পারেন না , বাংলাদেশীদের নয়নের মনি, হৃদয়ের স্পন্দন শহীদ জিয়াকে সম্মান দিবেন কিভাবে?
যদি বাংলাদেশীদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আশা করেন তবে অবশ্যই শ্রদ্ধাশীল হওয়ার চেষ্টা করবেন | ” রেসপেক্ট আর্নস রেসপেক্ট ” কথাটি এখন থেকে মনে রাখার চেষ্টা করবেন এবং দয়া করে আমাদের মুখ খুলতে বাধ্য করবেন না !