কায়সার আহমেদ: ১৭ই জুলাই ১৯৬৮ সনে রক্তপাতহীন এক অভ্যুত্থানে ‘বাথ পার্টি’ ইরাকের ক্ষমতা দখল করে। প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহন করেন আহমেদ হাসান আল-বকর। তারই ডেপুটি হিসেবে নিযুক্ত হন সাদ্দাম হোসাইন। ঠিক এগারো বছর পর ১৬ই জুলাই ১৯৭৯ তারিখে প্রেসিডেন্ট আবু বকরকে পদত্যাগে বাধ্য করে ক্ষমতার শীর্ষে আরোহন করেন সাদ্দাম হোসাইন। আমেরিকার দাবীর ভিত্তিতে জাতিসংঘের আন্তার্জাতিক আনবিক শক্তি কমিশন তদন্তে ইরাকে কোন প্রকার মাস ডিস্ট্রাকশন রাসায়নিক অস্ত্রের অস্তিত্ব পাওয়া না গেলেও, আমেরিকা জাতিসংঘকে অগ্রাহ্য করে তার সামরিক জোট নিয়ে ২০মে মার্চ ২০০৩ সালে বিমান বাহিনীর বোমা বর্ষণের মধ্য দিয়ে ইরাক যুদ্ধের সুচনা করে। দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধ করে ইরাক দখলে নিয়েও, আমেরিকা আজ অবধি কোন প্রকার মাস ডিস্ট্রাকশন রাসায়নিক অস্ত্র ইরাকে পায়নি। যুদ্ধে সাদ্দাম হোসাইন পরাজয় বরন করে এবং ১৩ই ডিসেম্বর ২০০৩ সালে সাদ্দাম হোসাইন মার্কিন বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন।
সাদ্দাম হোসাইনের গ্রেফতারের পর বারো জনের একটি চৌকশ মার্কিনী সেনাদলকে পাহারার দায়িত্ব দেয়া হয়। এই বারো জন নিজেদেরকে ‘বিশেষ বারো জন’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। এই দলটির প্রতি কঠোর নির্দেশ ছিলো দায়িত্ব সংক্রান্ত সবকিছু কঠোরভাবে গোপনীয়তা মেনে চলতে। এমনকি দৈনন্দিন ডায়েরী লেখাও নিষিদ্ধ ছিলো।
৩০শে ডিসেম্বর ২০০৬ দিনটি ছিলো বাগদাদের শীতলতম দিন। ‘বিশেষ বারো জন’ নামের দলটি ইরাকে আসার পর থেকে এতটা ঠান্ডা দিন পায়নি। ভোরবেলা তাপমাত্রা প্রায় ৩২-এ নেমে গেছে। ঘুমন্ত বাগদাদের আকাশে ভোরবেলা নির্জনতা ভেঙ্গে ভেসে এল হেলিকপ্টারের পাখার শব্দ। এরপর ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত সুরক্ষিত সামরিক যানে করে সৈন্যরা এগিয়ে গেল। ‘বিশেষ বারো জন’, যাদের ওপর অর্পিত হয়েছিলো সাবেক একজন প্রেসিডেন্টের ভালো-মন্দ সবকিছু দেখাশোনার দায়িত্ব, তারা আজ নিজেদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব শেষ করে সাদ্দাম হোসাইনকে তাঁর শেষ গন্তব্যে পৌঁছে দিচ্ছে।
ফাঁসির জন্য মঞ্চ প্রস্তুত। বাগদাদের কাদিমিয়া জেলার ইশতিখবারাত সামরিক সদর দপ্তরের ভেতরে ঝোলানের হয়েছে ফাঁসির রজ্জু। এই বাড়িটি ন্যায়বিচারের দুর্গ বলে পরিচিত ছিলো এক সময়। টাইগ্রিস নদীর তীরে অবস্থিত এই সদর দপ্তর। এখান থেকে কয়েক শ কিলোমিটার দূরেই এক নির্জন গ্রামে আজ থেকে ৬৯ বছর আগে সাদ্দাম জন্মগ্রহন করেছেন। চতুর্দিকে চোখে পড়ার মতো নিরাপত্তা ব্যবস্থা। বাহিরে মার্কিন সেনাবাহিনীর পূর্ণ এক ব্রিগেড মোতায়েন করা হয়েছে। ফাঁসিকাষ্ঠের চারপাশে নিরাপত্তায় নিয়োজিত ইরাকী নিরাপত্তা বাহিনী। মার্কিন সৈন্যদের প্রতি কঠোর নির্দেশ যাতে কাউকে মূল ফাঁসির মঞ্চে ঢুকতে দেয়া না হয়। এই বিচার ও শাস্তি প্রদানের প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ ইরাকিদের সিদ্ধান্ত- এমনটা বোঝাতেই এই ব্যবস্থা।
‘বিশেষ বারো জন’ দলটির সদস্যরা প্রস্তুতি নিচ্ছে তাদের সর্বশেষ দায়িত্ব পালনের। সাদ্দামকে ফাঁসিকাষ্ঠে পৌছে দিতে হবে। সাদ্দাম গোসল করতে চাইলেন। বেসিনে পানি দিয়ে মুসলমানদের প্রথা মতো অজু করতে শুরু করেন তিনি। একদল আগন্তকের সামনে খালি গায়ে বেরিয়ে এলো সাদ্দামের অন্য রুপ। যে স্বৈরশাসক তাঁর শাসনামলে প্রচুর অশান্তি আর হানাহানির পেছনে কলকাঠি নেড়েছেন, আজ তাঁকে অন্য দশজন বৃদ্ধের মতোই লাগছে। একজন জীবন্ত মানুষ হিসেবে সাদ্দামকে স্বচক্ষে দেখেছে দলটির সবাই। সাদ্দাম এক অসাড় জীবন পার করেছেন। শৈশবে শিকার হয়েছিলেন নিষ্ঠুরতার, আর বড় হয়ে সেই নিষ্ঠুরতার ছড়ি ঘুরিয়েছেন সাধারণ মানুষের ওপর। সৈন্যরা ভেবে পায় না, এ রকম একজন মানুষের জন্যে তাদের করুনা অনুভব হচ্ছে কেনো?
বিশ্ব মঞ্চে শেষবারের মতো আবির্ভূত হওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছেন ইরাকের সাবেক প্রেসিডেন্ট। সঠিক মাপের মোজা খুঁজে পাচ্ছিলেন না তিনি। কয়েকজন সৈন্য এগিয়ে গিয়ে কাপড় ভর্তি ব্যাগগুলো উল্টেপাল্টে তাঁকে সহায়তা করে। জীবনের শেষ প্রস্তুতিতে সাদ্দাম একটু যেনো তাড়াহুড়োই করছিলেন। ফাঁসি কার্যকর হতে আর বেশি সময় বাকি নেই, এমন সময়েও সাদ্দাম সত্যিকারভাবেই ‘বিশেষ বারো জন’ দলটির ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। তিনি জিজ্ঞেস করছিলেন, রাতে তাদের ভালো ঘুম হয়েছে কিনা। কিছুটা সময় তাঁর ব্যক্তিগত জিনিসপত্রের হিসাব কষলেন মনে মনে। এক জায়গায় স্থির বসে খানিক সময় তাকিয়েছিলেন এতদিনের সঙ্গি ব্যবহার্য জিনিসগুলোর দিকে। জর্জিয়ার সন্তান স্টিভ হাচিনসন সাদ্দামের ব্যক্তিত্বে সত্যিই মুগ্ধ। এত কিছুর পরও কিভাবে প্রতিটা মুহূর্ত নিয়ন্ত্রন করছেন। টেবিলের ওপর একগাদা পুরোনের বই, কাগজ আর পত্রিকার স্তুপ। নিজের লেখা কাগজগুলো নেড়েচেড়ে দিখতে কিছু সময় ব্যয় করলেন সাদ্দাম। শেষবারের মতো যাচাই করলেন নিজস্ব চিন্তাভাবনার সঙ্গে এসবের সাদৃশ্য কতখানি। আরও কয়েক মিনিট সাদ্দাম সব কাগজ নিয়ে বসে রইলেন। অবশেষে সব সময়ের মতো একই কায়দায় দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন তিনি।
‘বন্ধুগণ!’ এই বলে হাচকে কাছে যেতে অনুরোধ করলেন তিনি।
সাধারণত কোনো কিছুর প্রয়োজন হলে সাদ্দাম এভাবে ইশারা করেন। হাচের মনে প্রশ্ন জাগলো। এখন আবার কি চাচ্ছেন তিনি? গরাদের ফাঁক গলে একখানা নীল রঙের বাক্স এগিয়ে ধরলেন সাদ্দাম। হাচ বাক্সটা সাদ্দাম থেকে নিয়ে নেয়। এরপর সাদ্দাম তখনো হাতে পরে থাকা রেয়মন্ড ওয়েল ব্র্যান্ডের সুদৃশ্য ঘড়িটা খুলে হাচকে দিয়ে দিলেন। পরিস্থিতি বুঝতে এক মিনিট সময় নিলো হাচ। সাদ্দাম সত্যি সত্যি হাচকে তাঁর ব্যক্তিগত ঘড়িটা উপহার দিচ্ছেন। বিনয়ের সঙ্গে তা প্রত্যাখ্যান করলো হাচ। ‘না, এই উপহার গ্রহন করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’ সাদ্দাম অনড় — ‘তুমি একজন ভালো বন্ধু। আমি তোমাকে মন থেকেই ঘড়িটা উপহার দিচ্ছি।’ আদালতের যাবার সময় সাদ্দাম রেয়মন্ডের এই ঘড়িটা হাতে পরে যেতেন। হাচ দেখেছে, অন্য সময় খুব সাধারণ টাইমেক্স ব্র্যান্ডের ঘড়েিত সময় দেখতেন সাদ্দাম। আজ তিনি হাচকে দামি এই ঘড়িটাই উপহার দিচ্ছেন!
সামরিক বাহিনীর কড়াকড়ি সম্বন্ধে নিয়মিত সৈন্য হিসেবে ভালোভাবেই অবগত হাচ। সে জানতো, বন্দীদের কাছ থেকে কোনো কিছু উপহার হিসেবে গ্রহণ করা সম্ভব নয়। দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে উর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে আসতে চাইলো হাচ। নাছোড়বান্দা সাদ্দাম জোর করলেন। তিনি হাসিমুখে বললেন, ‘না, এটা তুমি নিয়ে নাও। এই বিষয়টা কেবল আমার ও তোমার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। কেউই জানতে পারবে না।’ এরপর সাদ্দাম হাচের কবজি ধরে নিজের হাতে ওকে ঘড়িটা পরিয়ে দিলেন। বাধা দিতে গিয়েও আটকে গেল হাচ। বিষয়টাকে যৌক্তিক করার চেষ্টায় মনে মনে ভাবলো হাচ, আজ শেষ রাতটা ভালোয় ভালোয় কাটলেই হয়। ঘড়িটা নিয়ে যদি স্বাভাবিকভাবে সবকিছু শেষ করা সম্ভব হয়, তবে ক্ষতি কি? ঝুলিয়ে রাখা ব্যক্তিগত স্যুটগুলো থেকে অতি সন্তর্পনে সবচেয়ে সেরা স্যুটটা পরিধানের জন্য বাছাই করলেন সাদ্দাম। জনসমক্ষে যাওয়ার আগে সাদ্দাম সবসময়ই এভাবে পোশাক বাছাই করেন। পোশাকের ওপর দিয়ে প্রচুর পরিমান সুগন্ধি মেখে নেন। একজন সৈন্য বলেছিলো সাদ্দামের আভিজাত্য ও গায়ে মাখা সুগন্ধির ঘ্রাণ পাওয়া যেতো এক মাইল দূর থেকেই।
ইতিমধ্যে ‘বিশেষ বারো জন’ দলটির সবাই এসে জড়ো হয়েছে সাদ্দামের কক্ষের পাশে। ফাঁসির মঞ্চে সাদ্দামকে নিয়ে যাওয়ার জন্য সম্পূর্ণ যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে এসেছে সবাই। ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ১২ জন সাদ্দামকে ঘিরে এগিয়ে চললো। বোমা হামলা প্রতিরোধী আবরণ সবার গায়ে, চোখে রাতের অন্ধকারে দেখার উপযোগী সামরিক চশমা। প্রত্যেক সৈন্য ১০০ রাউন্ড গোলাবারুদ বহন করছে। একসঙ্গে এতো সৈন্যকে চারপাশে জড়ো হতে দেখে প্রস্তুতিপর্ব থেকে খানিক বিরতি নিয়েছিলেন সাদ্দাম। সমবেত সৈন্যদের দিকে এগিয়ে আসেন তিনি। বুক উঁচু করে বলিষ্ঠ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে সৈন্যদের উদ্দেশে কথা বলতে শুরু করেন।
‘সৈন্যরা, এই কয়েক দিনে অন্য যে কোনো ইরাকির চেয়ে তোমরা আমার বেশি আপন মানুষে পরিণত হয়েছিলে। একজন সৈন্যের মতো মাথা উঁচু করে মৃত্যুকে আমি হাসিমুখে বরণ করে নেবো। তোমরা আমার সঙ্গে সবসময়ই খুব ভালো ব্যবহার করেছো। এ জন্য আমি যারপরনাই কৃতজ্ঞ।’ এরপর সাদ্দাম সবার সঙ্গে করমর্দন করেন। সবসময় জীবাণুর ভয়ে ভীত সাদ্দাম পারতপক্ষে কারও সঙ্গে হাত মেলাতেন না। আজ সেই সব জীবাণুকে এক মুহূর্তের জন্য ভুলে গিয়ে নিজেই হাত বাড়িয়ে দিলেন। সৈন্যদের কেউ কেউ লক্ষ করে, সে সময় সাদ্দামের চোখের কোণ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে।
যে বাড়িতে ফাঁসির মঞ্চ, তার বাইরেই ‘বিশেষ বারো জন’ এর দলটি অপেক্ষা করছে। বাড়িটা ইটের কাঠামোর ওপর টিনজাতীয় একটা আবরণ দিয়ে ঢাকা। এক পাশ উম্মুক্ত, ওপরে খোলা আকাশ। অনেকটা গ্রামীণ শস্যভান্ডারের সদৃশ। বাইরে থেকে ভেতরের ফাঁসির মঞ্চ দেখা যাচ্ছে না। তবে একটা উঁচু কাঠামোর ছায়া বোঝা যাচ্ছে। মাঝখানে রশি ঝুলছে। বাইরে অপেক্ষমান হাচ এর মনে পড়ে, মৃত্যুদন্ডের শাস্তি নিয়ে সাদ্দাম যতটা না চিন্তিত ছিলেন, তার চেয়েও বেশি উদ্বিগ্ন ছিলেন ফাঁসিতে ঝুলে মৃত্যুকে আলিঙ্গনের ব্যাপারে। এভাবে মৃত্যু চাননি সাদ্দাম, ভাবতেই কষ্ট লাগলো তার।
একজন ইরাকির কাছে সাদ্দামকে হস্তান্তর করা হয়। যার নাম মোয়াফফাক আল-রুরায়ি, যিনি এই কার্যক্রমের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। রুবায়ি ছিলেন ইরাকের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা। একসময় তিনি ইরাকের শিয়া জনগোষ্ঠির দাওয়া পার্টির সদস্য ছিলেন। এই পার্টির সদস্যরাই দুজাইলে সাদ্দামের ওপর হামলা চালান। ক্রদ্ধ সাদ্দাম কঠোর প্রতিশোধ গ্রহণ করেন। এ অভিযোগেই বিচারের মুখোমুখি হয়ে সাদ্দাম আজ তার শাস্তি পেতে চলেছেন। ১৯৭৯ সালে ইরাক ছেড়ে লন্ডনে পালিয়ে যান রুবায়ি। তিনি দাবি করেন, সাদ্দামের নিরাপত্তা বাহিনী অসংখ্যবার তাঁর ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালিয়েছে। লন্ডনে নির্বাসন থেকে ২০০৩ সালে তিনি দেশে ফেরেন। হাতকড়া পরা অবস্থায় সাদ্দামকে ‘বিশেষ বারো জন’ দলের হেফাজত থেকে রুবায়ি একটা কক্ষে নিয়ে যান। সেখানে একজন বিচারক উচ্চস্বরে সাদ্দামকে তাঁর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগুলো পড়ে শোনান। রুবায়ি জানান, সে সময় পবিত্র কোরআন হাতে সাদ্দামকে খুব শান্ত ও নির্ভার লাগছিলো। বিচারক যখন অভিযোগুলো উচ্চারণ করছিলেন, তখন সাদ্দামকে একটুও অনুতপ্ত মনে হয়নি। পড়া শেষ হলে সাদ্দামকে ফাঁসির মঞ্চে তোলেন রুবায়ি। সে মূহুর্তে একটা ঘটনা ঘটেছিলো। মঞ্চে ওঠার সিঁড়ির প্রথম ধাপেই দাড়িয়ে পড়েন সাদ্দাম। ফাঁসির রশির দিকে তাকিয়ে রুবায়িকে বলেন, ‘ডক্টর, এসব তো মানুষের জন্য।’ শেষবারের মতো নাটকীয় ভঙ্গিতে নিজের ভয়ডরহীন ব্যাক্তিত্বের কথা মনে করিয়ে দিলেন তিনি।
মুখোশ পরিহিত জল্লাদেরা সাদ্দামকে নিয়ে ফাঁসির মঞ্চে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেলো। মঞ্চের পাটাতনের ফাঁদের ওপর ঝুলছে ফাঁসির রজ্জু। জল্লাদদের কেউই সেদিন উর্দি পরে আসেনি। একজনের গায়ে ছিলো চামড়ার জ্যাকেট, আর অপরজনের গায়ে ধূসর রঙ্গের কোট। অন্যদিকে জনপ্রতিনিধিদের মতো নায়োকোচিত ভঙ্গিমায় হাজির হয়েছেন সাদ্দাম। গাঢ় রঙের স্যুটের ভেতর উঁকি দিচ্ছিলো ধবধবে সাদা রঙের শার্ট। জল্লাদদের থেকে দীর্ঘকায় সাদ্দাম মাথা উঁচু করে এগিয়ে যাচ্ছেন। নির্ভীক অবয়বে জ্বল জ্বল করছে সাদ্দামের দাড়ি-গোঁফ। একদম শেষ মূহুর্ত পর্যন্ত তিনি একজন সফল ব্যবসায়ী মোগলের মতো বুক টান করে ছিলেন। ইরাকের অধিপতি সাদ্দামের যৌবনের দিনগুলোর শৌর্যবীর্যের শেষ মহড়া চলছে যেনো। ক্ষমতায় থাকাকালীন সাদ্দাম ঠান্ডা মাথায় ইরাকিদের মৃত্যুদন্ডাদেশে স্বাক্ষর করতেন। হতভাগ্য ইরাকিরা যখন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তো, ভাবলেশহীন সাদ্দাম তখন একের পর এক চুরুট ধরিয়ে যেতেন। ভয়ে কাঁপতে থাকা পরাজিত সাদ্দামকে দেখতে জড়ো হওয়া উপস্থিত জনতাকে হতাশ করতে সম্পূর্ণ সফল সাদ্দাম। বরং নির্ভয়েই জল্লাদদের বিভিন্ন আদেশ মান্য করেন তিনি। মাথায় কালো কাপড় পরতে অস্বীকৃতি জানান সাদ্দাম।
তিনি প্রায়ই তাঁর অনুসারীদের অনুরোধ করতেন, যাতে তার মৃত্যুর দৃশ্য সংরক্ষণ করা হয়। তাঁর একসময়ের জেনারেল রাআদ আল-হামদানি জানিয়েছিলেন, বেদুইনদের মধ্যে একটা রহস্যময় উপকথা প্রচলিত ছিলো। জীবনের দৃশ্য অগণিত। কিন্তু শেষ মুহূর্তের দৃশ্যই ইতিহাসের পাতায় স্থায়ী হয়। হামদানি একটা বিশেষ সময়ের উল্লেখ করেছিলেন। তখন ইরান-ইরাকের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ চলছিলো। সদ্য পরাজয়ের হতাশায় নিমজ্জিত বিচিত্র পোশাকে সজ্জিত আহত সৈন্যদের পরিদর্শনে গিয়েছেন সাদ্দাম। যন্ত্রণায় কাতর সৈন্যদের দিকে তাকিয়ে সাদ্দাম ঘোষণা করলেন, যুদ্ধের ফলাফল যেই হোক না কেনো, ইতিহাস অবশ্যম্ভাবী সাহসী লড়াকুদের মনে রাখে।
সাদ্দাম জানতেন এটাই শেষ সুযোগ। তিন বছর আগে মাকড়সার গর্ত থেকে নির্লজ্জ আত্মসমর্পণের পর হারানো ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের আর কোনো সুযোগ পাওয়া যাবে না। হাচিনসনের মন্তব্য, জীবননাট্যের শেষ অংকে নিউজ অবিচল সাদ্দামের প্রদর্শনী হবে, এটাই ছিলো স্বাভাবিক। সাদ্দামের কাছ থেকে এমন আচরনই প্রত্যাশিত। ফাঁসির মঞ্চে মুখোশ পরিহিত জল্লাদদের মধ্যে কেবল সাদ্দামের চেহারাই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিলো। এই দৃশ্য সাদ্দামকে আরও মর্যাদা উপহার দেয়। ফাঁসির কার্যক্রম অনেকটা অপেশাদার অদক্ষ হাতে পরিচালিত হয়েছিলো। বিচিত্র এসব দৃশ্য থেকে এটাই প্রতিয়মান হয়, ইরাকি উচ্চ আদালত যতই সুষ্ঠুভাবে বিচারকাজ সম্পন্ন করুন না কেনো, মৃর্তুদন্ড কখনোই সভ্য সমাজের সমাধান হতে পারে না। রশি ব্যবহার করে ফাঁসি কার্যক্রম অসহ্য যন্ত্রণার উদ্রেক করে। এর ফলে মেরুদন্ডের হাড় ভেঙ্গে যায়, মাংসপেশি ও রক্তনালী ছিঁড়ে যায়। এমনকি ঝুলন্ত ব্যক্তির শরীর থেকে মলমূত্র নির্গত হয়। পাটাতন সরিয়ে ফেলার আগ মুহূর্তে একজন জল্লাদ সাদ্দামের ঘাড়ে একটা রুমাল পেঁচিয়ে দেয়, যাতে করে ফাঁসি কার্যকরের আগ মুহূর্তে গলায় কোনো ব্যথা অনুভব না হয়। উপস্থিত মানুষের জন্য দৃশ্যটা যথেষ্ট ভীতি জাগায়।
এই অসুস্থ সভ্যতা-বিবর্জিত রুচিহীন দৃশ্যটাকে ধরে রাখতে জ্বলে ওঠে ক্যামেরার ফ্ল্যাশ। এসব দেখে মুখ টিপে হাসলেন সাদ্দাম। গোষ্ঠীগত প্রতিহিংসা আর বিদ্বেষে ভরপুর ক্রোধান্বিত জনতার দিকে তিনি প্রশ্নবাণ ছুড়ে দেন, ‘তোমরা কি একে নিজেদের বীরত্ব বলে জাহির করছো?’ জনতার মধ্যে থেকে একজন চিৎকার করে ওঠে, ‘নরকে যা তুই।’ তাৎক্ষণিক জবাব দিলেন সাদ্দাম, ‘বর্তমান ইরাকের মত নরকে?’ উপস্থিত জনতাকে ভীতসন্ত্রস্ত লাগছিলো, কারণ, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত নির্ভীক অবিচল সাদ্দামের পা কেঁপে ওঠেনি।
ফাঁসির মঞ্চের বাহিরে ‘বিশেষ বারো জন’ দলটি নীরবে অপেক্ষা করছে। পাথুরে প্রাসাদ থেকে অনেকটা তড়িঘড়ি করেই বের হতে হয়েছিলো। তদুপরি ছিলো কোনো বাধাবিঘ্ন ছাড়াই বন্দীকে সমর্পণের দায়িত্ব। এক অস্বস্তিকর নীরবতাকে সঙ্গী করে ফাঁসিমঞ্চের পাটাতন পড়ে যাওয়ার অপেক্ষায় ছিলো তারা। সৈন্যদের কয়েকজন অসুস্থবোধ করছিলো সে সময়। অবশেষে এক ঘন্টা পর কিছু একটা ধসে পড়ার শব্দ হলো। শেষ হলো অস্বস্তিকর নীরবতার পর্ব। শব্দটা যেনো বিদ্যুৎ গতিতে প্রতিধ্বনিত হলো সবার দেহে। হাচের মনে হয়েছিলো যেন ধারেকাছেই বোমা ফুটেছে। দম বন্ধ লাগছিলো তার।
কালামায়ে শাহাদাত আওড়াচিছলেন সাদ্দাম। মাঝপথেই পায়ের নিচের পাটাতন অকস্মাৎ সরে যায়। ঘাড়ের মেরুদন্ডের গাড় ভেঙ্গে যাওয়ার শব্দ ধ্বনিত হলো বন্ধ কক্ষে। নিথর দেহখানা কয়েক মিনিট ধরে রশিতে ঝুলে রইলো। একজন চিকিৎসক এসে হৃৎস্পন্দন শোনার যন্ত্র স্টেথোস্কোপ ধরলেন সাদ্দামের বুকে। কোনো সাড়া না পেয়ে সাদ্দামকে মৃত ঘোষণা করলেন তিনি। তখন সবে মাত্র ভোর ছয়টা বাজে। কাছেই কোথাও গুলি ছোড়ার শব্দ কানে এলো। হতচকিত মার্কিনীরা ভাবলো, হয়তো সাদ্দামকে মুক্ত করার জন্যে শেষ প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। কিন্তু না, এটা ছিলো আনন্দ উৎসব। সাদ্দামের শত্রুরা দীর্ঘদিন ধরে এই মুহূর্তটার অপেক্ষায় ছিলো। অবশেষে এসেছে সেই বহুল প্রতীক্ষিত দিন।
সুত্র: ‘দ্যা এন্ড গেইম: দ্যা ইনসাইড স্টোরি অফ দ্যা স্ট্রাগল ফর ইরাক, ফ্রম জর্জ ডব্লিউ বুশ টু বারাক ওবামা – ঐতিহাসিক মাইকেল গর্ডন। ২৭শে সেপ্টেম্বর ২০২৩