ডক্টর মোঃ নুরুল আমিন: একজন পুলিশ সদস্যের মৃত দেহ পরে আছে রাস্তায়। এটা নিয়ে ব্যাপক শোকের সৃষ্টি হয়েছে। তিনি একজন বাবা, সন্তান, স্বামী ইত্যাদি। আমিও এই পুলিশের মৃত্যুতে ব্যথিত। সে আমার ভাই, চাচা বা আত্মীয় হতে পারতো! কিন্তু এই পুলিশ সদস্যের মৃত্যুর জন্য দায়ী কে? আওয়ামী লীগ? বি এন পি? ফকরুল সাহেব? কাদের সাহেব?
ডক্টর মোঃ নুরুল আমিন: একজন পুলিশ সদস্যের মৃত দেহ পরে আছে রাস্তায়। এটা নিয়ে ব্যাপক শোকের সৃষ্টি হয়েছে। তিনি একজন বাবা, সন্তান, স্বামী ইত্যাদি। আমিও এই পুলিশের মৃত্যুতে ব্যথিত। সে আমার ভাই, চাচা বা আত্মীয় হতে পারতো! কিন্তু এই পুলিশ সদস্যের মৃত্যুর জন্য দায়ী কে? আওয়ামী লীগ? বি এন পি? ফকরুল সাহেব? কাদের সাহেব? আমি মনে করি এ মৃত্যুর জন্য দায়ী হচ্ছে বাংলাদেশের রাজনীতি। জনগণের গলা চেপে ধরা রাজনীতি।
রাজনীতি হচ্ছে রাজ্য বা রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি। রাষ্ট্র হচ্ছে জনগণের একটি প্রতিষ্ঠান। সমস্ত জনগণ সমানভাবে এর মালিক। ফকির, ধনী, চাষা, মেজর, এস পি, ডিসি, আমলা, কামলা সবাই সমানভাবে রাষ্ট্রের মালিক। তাই সবার ভোট একটি করে। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠান চালাতে লোকজন লাগবে। তাই জনগণ ভোট দিয়ে তার রাষ্ট্র বা প্রতিষ্ঠানকে চালাতে কিছু প্রতিনিধি নির্বাচিত করে। রাষ্ট্র পরিচালনায় কিছু নিয়মের প্রয়োজন। সে লক্ষ্যে তৈরি করা হয় সংবিধান, আইন। তাই জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে মেম্বার, চেয়ারম্যান, এম পি, মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী, সবাই হন দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংবিধানিক কর্মচারী। এরা হলেন দায়িত্ব প্রাপ্ত। কিন্তু দায়িত্ব পেয়ে এরা হয়ে যান ক্ষমতা প্রাপ্ত। দায়িত্ব প্রাপ্ত হলে অর্পিত দায়িত্বের জন্য মালিকের কাছে জবাবদিহি করতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতিতে উনারা ক্ষমতাপ্রাপ্ত হন বিধায় জনগণকে পাত্তা দেয় না। অর্থাৎ জনগণকে রাষ্ট্রের মালিক মনে করেন না। উনারা নিজেরাই ক্ষমতাধর প্রভু হয়ে জনগণের উপর জুলুম শোষণ চালান। এই কাজে তারা রাষ্ট্রের অন্যান্য প্রতিষ্ঠান পুলিশ, সেনা, বিচার বিভাগ, প্রশাসন সবকিছুকেই নিজেদের আয়ত্ত করেন। নিজেদের ফরমায়েশ পালন করবে এমন ব্যক্তিকে পদে বসান। আফসোস ঐ পদ গৃহীত চাটুকাররা নিজেদের পকেট ভর্তি ও পদ রাখতে ক্ষমতাশীন দলের লেজুড়বৃত্তি করেন। ক্ষমতাসীনদের অন্যায় হুকুমকে তলব করেন এবং যথারীতি সেটাকে সরকারি আদেশ বলে চালিয়ে দেন। কিন্তু সরকারি আদেশ নাকি সরকারি দলের আদেশ এই বিষয়টি তারা পার্থক্য করতে পারেনা।
আগেই উল্লেখ করেছি রাষ্ট্র নামক প্রতিষ্ঠানটির মালিক হচ্ছে জনগণ। তাহলে সরকারি চাকরিজীবীরা কে? কনস্টেবল, সিপাহি, দারোগা, ওসি, এস পি, আই জিপি, ই এন ও, ডিসি, ভিসি, অফিসার, প্রফেসর সবাই ঐ রাষ্ট্র নামের প্রতিষ্ঠানটির কর্মচারী। যেটাকে সংবিধানে বলা হয় প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। একই সাথে এরা নিজেরাও একজন জনগণ। সে অর্থে তারাও রাষ্ট্রের মালিক শ্রেণির। তাই চাকরিজীবীদের দায়িত্ব আরও বেশি। তারা একইসাথে রাষ্ট্রের মালিক এবং সেবা প্রদানে দায়িত্ব প্রাপ্ত কর্মচারী। কিন্তু চাকুরি পাবার পরে সরকারি চাকুরিজীবী অনেকেই রাষ্ট্র এবং সরকার, সরকার এবং সরকারি দল, ইত্যাদির পার্থক্য করতে পারেনা। অথবা পার্থক্য করতে পারলেও সিস্টেম এমন হয়ে দাড়িয়েছে যে সে সরকার এবং সরকারি দলের মধ্যে পার্থক্য করতে পারেনা অথবা পার্থক্য করতে চায়না। তাই প্রায়শই সরকারি দলের দ্বারা আদেশপ্রাপ্ত হয়ে সেটাকেই সরকারি আদেশ মনে করে জনগণের উপর নির্যাতন করে।
উদাহরণ স্বরূপ গত ২৮ অক্টোবর ২০২৩ বিরোধী দলের উপর পুলিশের অকস্মাৎ আক্রমণ। এতে সাধারণ জনগণের সাথে একজন পুলিশ সদস্যের মৃত হয়েছে। এখন সরকারি দলের পক্ষ থেকে এই খবরটাকে ফলাও করা হচ্ছে। বুঝাতে চাচ্ছেন যে বিরোধী দলের উগ্রতার কারণে এই পুলিশের মৃত্যু হয়েছে। অনেকেই আবার পুলিশের মৃত্যুতে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলছেন পুলিশের কি দোষ? সে সরকারি আদেশ মানতে বাধ্য। প্রশ্নটা এখানেই ? আদেশ কি সরকারের নাকি সরকারি দলের? আর সরকারের আদেশও যদি হয় তবে আদেশটা কি সাধারণ জনগণের বা মালিকের উপর চড়াও হওয়া। একটু বিবেচনা করে দেখুন মালিক পক্ষ যাকে দায়িত্ব দিয়েছে রাষ্ট্র পরিচালনার কর্মচারী হিসেবে, সেই কর্মচারী আক্রমণ চালায় মালিকের উপর। বিষয়টা অনেকের কাছে ইউটপিক্যাল মনে হতে পারে।
কেউ কেউ ছি ছি করে বলছেন সরকারি পোশাকধারী পুলিশকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এটা নিয়েই অনেকে সরব। কিন্তু এই সরকারি পোশাকধারী পুলিশ যখন জনগণকে গুলি করে তখন আপনি সরব না কেন? অবশ্যই সব মৃত্যুই কষ্টের। হোক সে পুলিশ, হোক সে জনগণ। কিন্তু আপনাদের বয়ান কেন এক তরফা!
কেউ কেউ মনে করেন বা বলার চেষ্টা করছেন পুলিশ আক্রমণ করতেই পারে। এটা তাকে আদেশ দেয়া হয়েছে। কিন্তু জনগণ কেন উগ্র হবে? আমারও প্রশ্ন সেটাই। জনগণ কেন উগ্র হবে? কিন্তু একটু গভীরভাবে চিন্তা করে দেখুন একজন মালিক কখন রাগ করে! কর্মচারী যখন মালিকের সেবা না করে উল্টো মালিকের উপর আক্রমণ করে তখন এমন কোন মালিক আছে যে চুপ করে থাকবে? তাই বছরের পর বছর যখন প্রজাতন্ত্র বা রাস্ট্রে দ্বায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মচারীরা মালিককেই দমন করতে চায়, মালিকের উপর জুলুম, নির্যাতন, অত্যাচার চালায় তখন মালিকপক্ষ এক পর্যায়ে সহ্য করতে না পেরে উগ্র হয়ে উঠে। তাহলে জনগণকে উগ্র বানানোর জন্য পুরো দোষী জুলুম, শোষণ ও জোরপূর্বক ক্ষমতায় থাকা শোষক শ্রেণির। জনগণকে ক্ষেপিয়ে উগ্র বানিয়েছেন ঐ জালিম শোষক শ্রেণি। এখন একটি উদাহরণ দেই। উন্নত দেশে যেমন নরওয়ে, ফিনল্যান্ড, জাপান, সুইজারল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ক্যানাডা ইত্যাদি দেশে জনগণ খুব সহজে উগ্র হয়ে ভাংচুর চালায় না। কারণ কি? ঐ সব পুলিশও উগ্র আচরণ করেনা। কোন বিদ্রোহ দমনে যতটুকু সম্ভব শান্তিপূর্ণ ভাবেই জনগণকে বাধা দেয়। তাই পুলিশ ও জনগণ কেউ মারা যায় না! দুই একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটে গেলেও তার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার হয়। দোষী পুলিশ বা জনগণ বা সরকারি দলের সমর্থক বা যেই হোক তাকে শাস্তি পেতে হবেই। কিন্তু বাংলাদেশে কি দেখি? কোন ভাবে যদি প্রমাণ করতে যে দোষী ব্যক্তি সরকারি দলের সমর্থক তবে মুক্তি! বিরোধী দলের হলে বিশেষ স্থানে গরম ডিম দিয়ে অত্যাচার করা হয়, আংগুল উপরে ফেলা হয়, পুরুষ লিংগ থ্যাথলে পিটানো হয়। একজন দোষী হলেও তো তাকে নির্যাতন করার আইন বিশ্বের কোন দেশেই নেই, বাংলাদেশেও নেই। এজন্য আদালত আছে। কিন্তু সেই আদালতটা পর্যন্ত নিরপেক্ষ আছে কিনা সেটাও বিবেচ্য। জনগণের শেষ ভরসা যে আদালত সেই আদালতটাও সরকারি দলের পক্ষে কাজ করে ? অপরাধী সরকারি দলের সমর্থক হলে বেকসুর খালাস। আর অপরাধ না করে বিরোধী দলের সমর্থক হলে ডান্ডা বেরি! আর অপরাধী হলে সাজা নিশ্চিত। এত সব জুলুম শোষণ সহ্য করার পর জনগণ চায় তার রাষ্ট্রের দ্বায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারকে পরিবর্তন করতে। কিন্তু সেই পরিবর্তন করতে প্রয়োজন হয় ভোটের। সেই ভোটের অধিকারটাও নেই জনগণের! একেমন বিচার! জনগণ বা মালিক চাচ্ছে তার কর্মচারী বদলাতে। আর কর্মচারীরা একজোট হয়ে বলবে “না”। আগেই জোর করে ভোট কেটে নিয়ে জোরপূর্বক ক্ষমতা কেড়ে নেয়! তারপর উঁচু গলায় বলেন ” জনগণ আমাদেরকে নির্বাচিত করেছে “! অবাক বিষয়! তাহলে যারা সরকারকে বদলাতে চায় তারা কারা? তারা কি জনগণ নয়? তখন শুনা যায়, ওরা অমুক, ওরা অমুক পন্থি, ওরা অমুক চেতনার। সমস্যা কি ভাই! ওরা মালিক পক্ষ। ওদের দেয়া দ্বায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে ওরা তো চাইবেই আপনাকে বদলাতে। ওদেরকে ওদের রাষ্ট্রের পরিচালক নির্বাচন করতে দিন। রাষ্ট্র তো জনগণের। জনগণ কাকে বাছাই করতে চায় সেটা তার ব্যাপার। আপনি আমি জোরপূর্বক ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে থাকতে চাই কেন? কেন বলি, আমাদের হাতে দ্বায়িত্ব না থাকলে দেশ এটা হবে, সেটা হবে! সেটা জনগণকেই বুঝতে দেন। তাদের উপর ছেড়ে দেন। এতে আপনাদের আপত্তি কোথায়?
আর জনগণ? সেটার সংগা কি? জুলুমবাজ ফেসিস্ট শাসকরা এই জনগণের ডেফিনিশনটাও বদলে দিয়েছে! সরকারি দলের সমর্থক হলে সে জনগণ। আর বিরোধী দলের সমর্থক হলে সে যেন জনগণ নয়! তাদেরকে বিভিন্ন নামে সংজ্ঞায়িত করা হয়। লাল, নীল, সাদা, কালো, হলুদ ও ডোরাকাটা বিভিন্ন বিভিন্ন নাম। আর একটি বিশেষ দলের নামে তকমা লাগিয়ে দিতে পারলে তো কথাই নেই। তাকে দিনে দুপুরে পিটিয়ে মারলেও তার বিচার নেই! এই হচ্ছে যখন জনগণের অবস্থা তখন আর সে কত মুখ বুজে থাকবে? একদিন তো উগ্র হবেই। এখানে একটি পরিষ্কার করে বলছি। জনগণের উগ্র আচরণকে সাপোর্ট করছি না। কারণ দেশ কারো একার নয়। এটা সব জনগণের সম্পদ। তাই যে কেউ ইচ্ছে করলেই উগ্র হয়ে বে আইনি কাজ করতে পারেনা। কিন্তু একটি দেশের অধিকাংশ জনগণ যখন জুলুম শোষণ সহ্য না করে শোষক শ্রেণির বিরুদ্ধে আন্দোলন করে তখন সেটা গণ অভুথ্যান হয়ে যায়। বিশ্বের কোন দেশেই গণ অভুথ্যান অপরাধ নয়। কিন্তু জনগণের উপর অত্যাচার চালানোর হুকুম দেয়া, লগি-বইঠা, লাঠি, ঝাড়ু নিয়ে আসার হুকুমজারি করা ফৌজদারি অপরাধ। কিন্তু বাস্তবতা কি? বি এনপির ফকরুল সাহেব যখন শান্তিপূর্ণ সমাবেশের ঘোষণা দিয়েছেন। তার কোন বক্তব্যে উস্কানিমূলক উক্তি ছিলো না। কিন্তু তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে হুকুমের আসামি হিসেবে। অন্যদিকে, ওবায়দুল কাদের সাহেব হুমকি ও উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে বলেই চলেছেন, “বি এন পির অবস্থা শাপলা চত্তরের চেয়েও খারাপ হবে।” একই সাথে মেয়র তাপস বলছেন সবাইকে লগি-বইঠা নিয়ে এসে আগের মতোই গণতন্ত্র রক্ষা করতে! উল্লেখযোগ্য যে, ২০০৬ সালের ২৮ সালে দিনে দুপুরে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে কয়েকজন মানুষকে খুন করে তার উপর নেচেছিল এই আওয়ামীলীগ। এখন আমরা আবার কি দেখলাম ২০২৩ সালের এই ২৮ অক্টোবরেই লাঠি দিয়ে বাস ভাংগা হচ্ছে, পুলিশ পাশেই! এটা কি নাশকতা নয়? পুলিশের সামনে সরকারি সমর্থকরা লাঠি, পিস্তল উঁচিয়ে ধরলে পুলিশ নিশ্চুপ। কিন্তু নিরস্ত্র জনগণ বা বিরোধী দলের সমর্থকরা স্লোগান দিলেই পুলিশের অ্যাকশন, লাঠিচার্জ, গুলি, সাউন্ড গ্রেনেড, টিয়ারশেল আর কত-কী! কই, আপনারা সুশিক্ষিত সুশীল সমাজের বয়ান কোথায়? এরকম সবক্ষেত্রেই যদি আপনি একতরফা হয়ে যান তবে ভুক্তভোগীরা কী করবেন? না, আমি বলেছি না তারা আইন নিজের হাতে তুলে নিবে। কিন্তু, সরকারি দলের সমর্থকরা যখন আইন নিজের হাতে তুলে নেয় তখন আপনি নিশ্চুপ কেন?
তাই সাবধান। জনগণের উগ্র আচরণের বিচার বিশ্বের কোনো আদালত করতে পারেনি। কিন্তু যারা জনগণকে উগ্র হতে বাধ্য করে তাদের বিচার হয়।
আরেকটি বিষয় লিখে আজকের লেখা শেষ করছি। যেহেতু জনগণ হচ্ছে মালিক। তাই প্রতিটি জনগণ চায় তার নিজের মতো করে স্বাধীনভাবে, ঝামেলামুক্ত জীবন যাপন করতে। সে চায় তার তথ্য, তার গোপনীয়তা সুরক্ষিত থাকুক। আর এই কাজের জন্য সে দায়িত্ব দেয় দায়িত্বপ্রাপ্তদের। কিন্তু বাংলাদেশে কি দেখা যায়! গভীর রাতে হোটেল তল্লাশি, তুমি কোন দলের, এ দল নাকি বি দল? ঢাকায় আসার কারণ কি? রাস্তাঘাটে আচমকা থামানো হয়? আইডি, পাসপোর্ট দেখান। অর্থাৎ নিজের দেশের ভিতর চলতে গেলেও ভিসা পাসপোর্ট লাগে! আইন শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য করা হলে ঠিক আছে। কিন্তু যখন উদ্দেশ্য হয় সরকারি দলের নিরাপত্তা দেয়ার নিমিত্তে বিরোধী দলের সমাবেশকে বাধা দেয়া তখন প্রশ্ন উঠবেই। এই রাজনীতি জনগণের কল্যাণের জন্য নাকি সাধারণ শান্তি প্রিয় জনগণের রক্ত পান করার জন্য!
Leave a Comment
Your email address will not be published. Required fields are marked with *