সামসুল ইসলাম টুকু : পাশ্চাত্য সংস্কৃতির অবাধ প্রবেশের কারণে আমাদের দেশের গ্রাম বাংলার হাজার বছরের পুরোনো ও ঐতিহ্যবাহী লোক সংস্কৃতিগুলো ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে। আগের সেই আলকাপ গান,কবি গান, জারি সারি গান,পালা গান আর শোনা যায় না গ্রামে গ্রামে। হয়ে গেছে আনুষ্ঠানিক। মাঝে মাঝে টিভিতে দেখা যায়। পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে শিল্পীরাও হারিয়ে গেছে। যাত্রা, মঞ্চ নাটক আর
সামসুল ইসলাম টুকু : পাশ্চাত্য সংস্কৃতির অবাধ প্রবেশের কারণে আমাদের দেশের গ্রাম বাংলার হাজার বছরের পুরোনো ও ঐতিহ্যবাহী লোক সংস্কৃতিগুলো ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে। আগের সেই আলকাপ গান,কবি গান, জারি সারি গান,পালা গান আর শোনা যায় না গ্রামে গ্রামে। হয়ে গেছে আনুষ্ঠানিক। মাঝে মাঝে টিভিতে দেখা যায়। পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে শিল্পীরাও হারিয়ে গেছে। যাত্রা, মঞ্চ নাটক আর অনুষ্ঠিত হয়না জেলা উপজেলা শহরে।গ্রামীণ মেলা আর বসেনা আইন শৃঙ্খলা রক্ষার অজুহাতে। সবই হয়ে গেছে প্রাতিষ্ঠানিক। জনসাধারণের প্রাণখোলা অংশ গ্রহণ দেখা যায়না। কারণ বাড়িতে বসেই টিভি আর মোবাইলে পাশ্চাত্য সংস্কৃতিতে মশগুল থাকে সকল স্তরের মানুষ। হাডুডু, বর্দন, গোল্লাছুট, কুস্তি, লাঠিখেলা এখন চোখে পড়েনা। জীবন ও সংসারের প্রয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে যুব সমাজ। গ্রাম বাংলা আজ আনন্দশুন্য।
আমাদের জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা নবান্ন উৎসব যেন ফিকে হয়ে গেছে। অগ্রহায়ণ মাসে আমন ধান কাটা হলে নবান্ন উৎসব বা পিঠা উৎসব হতো প্রতিটি বাড়িতে। বাঙালির এই প্রাণের উৎসবে অংশ গ্রহণ করতো শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত সকলেই। মূল ভুমিকায় থাকতো গৃহবধূরা। পুরো মাস জুড়ে উৎসবে মুখর থাকতো গ্রামগুলো। নতুন ধান উঠলেই মহিলারা লাল হলুদ শাড়ি পরে গীদ গেয়ে ঢেঁকিতে ধান থেকে চাল তৈরি করে সেই চাল জাঁতায় পিষে আটা দিয়ে তৈরি করে নানা ধরনের পিঠা পুলি পায়েস। আনন্দে ভরপুর হয়ে থাকতো গ্রামগুলো। প্রত্যেকেই প্রত্যেকের বাড়িতে পিঠা বিতরণ করতো। এখন তা সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে অবস্থা সম্পন্ন গৃহস্থ পরিবারের মধ্যে।
এমনি সময় পুরো গ্রাম সম্মিলিতভাবে নবান্ন উৎসব পালন করে তাক লাগিয়ে দিয়েছে চাপাইনবাগঞ্জ জেলাধীন গোমস্তাপুর উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামের এক আলোকিত মহিলা মমতাজ বেগম।জেলা শহর থেকে প্রায় ৩৮ কিঃমিঃ দূরে আঁকাবাঁকা পুনর্ভবা নদীর ধারে প্রায় ২ কিঃমিঃ দীর্ঘ ছায়া ঢাকা সুনিবিড় একটি গ্রাম বাবুরঘোনা। গ্রামটির অপর পাশে বিশাল আমবাগান। প্রায় আড়াই হাজার মানুষের বাস এই গ্রামে। গত ১৩ বছর যাবৎ মমতাজ বেগম গ্রামের মহিলাদের সংগঠিত করে এই নবান্ন উৎসব করে আসছেন। বিভিন্ন সংস্কারে আচ্ছন্ন এ গ্রামের মহিলারা প্রথমদিকে এ উৎসবে খুবই কম অংশ গ্রহণ করলেও দমে যাননি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা মমতাজ বেগম। তার অদম্য ইচ্ছা ও উৎসাহের ফলে ও গ্রামবাসীর সাথে নিবিড় সম্পর্কের জন্য গত কয়েবছর ধরে পুরো গ্রাম সম্মিলিতভাবে এ উৎসব পালন করেন। এতে মহিলা ও শিশুরা তো অংশ গ্রহ করেই। সেইসাথে পুরুষরাও তাদের সহযোগিতা করেন। এ গ্রামে শুধু নবান্ন উৎসবই হয়না পাশাপাশি বিভিন্ন জাতীয় দিবসও পালিত হয় মমতাজ বেগমের নেতৃতে।
একটি প্রত্যন্ত ও অন্ধকারাচ্ছন্ন গ্রামে লোকসংস্কৃতির এ বিকাশ অনন্য দৃষ্টান্ত বটে। অনেক সামাজিক প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও গ্রামের মহিলাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন মমতাজ বেগম। যার ফলশ্রুতিতে এ গ্রামের একজন অশিক্ষিত মহিলাও বক্তব্য রাখতে পারেন। তাদের নিজস্ব তুলে ধরতে পারেন,তার সামাজিক অধিকার, নিরাপত্তা ও সম্মান সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠেছেন। মমতাজ বেগমের এবারের আয়োজন ছিল অনেক বড়। গ্রামের সকল মহিলা ও শিশুরা তো অংশ গ্রহণ করেছেই, সেই সাথে এই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়েছেন জেলা শহর থেকে বেশ কিছু বুদ্ধিজীবী,শিক্ষক, সমাজ কর্মী, রাজনীতিবিদ এবং বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার একগুচ্ছ সাংবাদিক। গত ১ ডিসেম্বর এই অনুষ্ঠানে আমিও গিয়েছিলাম। দেখলাম মমতাজ বেগমের বাড়ির আঙ্গিনায় রঙিন শাড়ি পরে শতাধিক মহিলা গীদ গেয়ে গেয়ে ভাপা পিঠে,তেল পিঠে, পাটিসাপ্টা,ধুপি,পায়েস রান্না করছেন আবার পরিবেশনও করছেন অতিথিদের। মাহা উৎসবে তারা নিজেরাও পিঠের স্বাদ গ্রহণ করছেন। শিশুরা রঙিন পোষাক, মাথায়, খোপা্ গলায় রং কাগজের মালা কপালে টিপ পরে মুখরিত করে রেখেছে উৎসব প্রাঙ্গণ।অত্যন্ত অল্প পরিসরে এত মানুষের স্থান সংকুলান হচ্ছেনা তথাপি কোন অস্থিরতা নেই। সবাই উৎসব দেখতে উদগ্রীব কিন্তু শান্ত। সংবাদকর্মীরা এত ভিড়ের মাঝেও তাদের ভিডিও ধারণ করছেন সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন সুশৃঙ্খল্ভাবে।আর ছেলে বুড়ো সবার হাতে মোবাইল ক্যামেরা নিয়ে ছবি তুলতে ব্যস্ত। দুপুরে খেতে দেওয়া হলো মোটা স্বর্না চালের ভাত, কলাইয়ের ডাল, আলু বেগুনের তরকারি ও ব্রয়লার মুরগির মাংস। সকালে ছিল ভাত আর আলুর দম। যাকে বলে গরিবি খানা।
অন্যান্য কর্মসূচির মধ্যে ছিল শিশুদের নাচ ও গান এবং বড়দের জন্য গীদ, গান ও বক্তব্য। এত ছোট আঙ্গিনায় এত বড় অনুষ্ঠান সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন সম্ভব হয়েছে মমতাজ বেগমের সুনিপুন পরিচালনায়। কোথাও কোন অসংগতি চোখে পড়েনি। তবে এবার শিশু ও মহিলাদের বিভিন্ন ধরনের আন্তকক্ষ খেলা অনুষ্ঠিত হতে পারেনি সময়ের অভাবে। তারপরেও অংশ গ্রহঙ্কারীদের উৎসাহ ও উদ্দীপনা ছিল নজর কাড়া। বিনোদনের এই সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়ার জন্য মমতাজ বেগম প্রশংসা পেতেই পারেন। শিশুদের নাচ ও গান পরিচালনা ও অনুষ্ঠানের শৃঙ্খলা রক্ষা করেছে শিশু নীরব ও তার দল। খাবার পরিবেশনা করে আলিউল ওশফিকুলের দল। অনুষ্ঠানের খরচের জন্য গ্রামের মহিলাদের কাছ থেকে যৎসামান্য চাঁদা নেওয়া হয় আর সিংহভাগ খরচ করেন মমতাজ বেগম। গ্রামের মানুষদের সমবেত করে বাংলার লোক সংস্কৃতিকে উজ্জীবিত করেছেন,গ্রামীণ মহিলাদের সমজ সচেতন করতে পেরেছেন এতেই মমতাজ বেগমের সব আনন্দ।
মমতাজ বেগমের সাবলীল চলাফেরা,সংযত জীবনাচারন এবং অনুপ্রেরনামুলক বক্তব্য গ্রামের গোঁড়া মানুষগুলোকে অন্ধকার থেকে আলোতে আসতে সাহায্য করছেন অবিরত। প্রচলিত সব কুসংস্কার থেকে গ্রামবাসীকে মুক্ত করার যেন অলিখিত দায়িত্ব নিয়েছেন তিনি। গ্রামবাংলার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে মহিলা ও শিশুদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন তিনি।দেখলাম সেখানে নেই কোন ধর্ম ভীরুতা, কুসংস্কার, গোঁড়ামি,নেই অহেতুক বোরকা ও হিজাবের আবরণ।তাদের দেখলাম নেহৎই সাদাসিধে সংযমী, বলিষ্ঠ ও সদালাপী। অভাব অভিযোগ সমস্যা তো সব পরিবারেই থাকে। প্রতি সপ্তাহেই তারা সমস্যাগুলো নিয়ে আলোচনা করেন তাদের অধিকার ও উন্নয়ন নিয়ে কথা বলেন,পরামর্শ দেন। বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামে একজন করে মমতাজ বেগম দাঁড়াতে পারলে পুরো সমাজটাই বদলে যেত।
Leave a Comment
Your email address will not be published. Required fields are marked with *