সামসুল ইসলাম টুকু : দ্বীপ দেশ অষ্ট্রেলিয়া মূলত একটি মহাদেশ ।যার আয়তন ৭৬ লাখ ৮২হাজার ৩০০বঃকিঃমিঃ । চারিদিকে অথৈ সমুদ্রে ঘেরা এই মহাদেশ । বিভিন্ন দেশের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক থাকায় বিভিন্ন পণ্য আমদানি রপ্তানির জন্য অস্ট্রেলিয়ার নৌ বন্দর গুলোতে পানির জাহাজ চলাচল করে বহুকাল থেকে । আজকের এই পানির জাহাজ বা যান্ত্রিক নৌযান এক
সামসুল ইসলাম টুকু : দ্বীপ দেশ অষ্ট্রেলিয়া মূলত একটি মহাদেশ ।যার আয়তন ৭৬ লাখ ৮২হাজার ৩০০বঃকিঃমিঃ । চারিদিকে অথৈ সমুদ্রে ঘেরা এই মহাদেশ । বিভিন্ন দেশের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক থাকায় বিভিন্ন পণ্য আমদানি রপ্তানির জন্য অস্ট্রেলিয়ার নৌ বন্দর গুলোতে পানির জাহাজ চলাচল করে বহুকাল থেকে । আজকের এই পানির জাহাজ বা যান্ত্রিক নৌযান এক সময়ে ছিল পালতোলা বড় নৌকা । ১৬০৬ সালে পর্তুগিজ নাবিক উইলিয়াম জেন্স জুন এই নৌকায় করেই প্রথম অস্ট্রেলিয়ার পশ্চিম তীরে এসেছিলেন । কিন্তু ওই অঞ্চলের রূক্ষ্ম ভূ-প্রকৃতি তাকে হতাশ করে। কিন্তু ওই ভূ-প্রকৃতি যে হিরা চুনি পান্নায় ভরা তা বুঝতে পারেননি এবং ফিরে যান । এর ১৬৪ বছর পরে ১৭৭০ সালে ব্রিটিশ নাবিক জেমস কুক অষ্ট্রেলিয়া এসেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার পূর্ব উপকূলে । যেখানে তিনি সবুজের সন্ধান পেয়েছিলেন এবং সম্ভাব্য ব্রিটিশ কলোনির জন্য চিহ্নিত করে ফিরে যান । এর ১৮ বছর পর ১৭৮৮ সালে পরিকল্পিতভাবেই ব্রিটিশ সরকার ক্যাপ্টেন আর্থার ফিলিপকে অষ্ট্রেলিয়া পাঠায় । আর তিনিই প্রথম অস্ট্রেলিয়ায় ব্রিটিশ কলোনির পতাকা স্থাপন করেন ও অস্ট্রেলিয়ার দখলি স্বত্ব ঘোষণা করেন । সে সময় ব্রিটিশ, পর্তুগিজ্, ওলন্দাজ, ফরাসিরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তাদের সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিল । তবে সে ইতিহাস মোটেও সহজ সরল ছিলনা । ছিল নিষ্ঠুর ও প্রাণঘাতি । এজন্য তাদের ঝুঁকি নিয়ে হাজার হাজার মাইল ভয়ংকর উত্তাল সমুদ্র পাড়ি দিতে হয়েছে পালতোলা নৌকায় । জীবন দিতে হয়েছে অসংখ্য মানুষকে । কিন্তু তাদের দেশ দখলের দুর্দুমনীয় ইচ্ছা এবং প্রচণ্ড দুঃসাহস তাদের সফল করেছিল । এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশী সফল হয়েছিল বৃটিশরা । আর এজন্য এক সময় বলা হতো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের কখনো সূর্য অস্ত যায়না । যাইহোক উল্লেখিত এসব সাম্রাজ্য বিস্তারকারী ব্যবসায়ীরা কালক্রমে ওই পালতোলা নৌকাকে যন্ত্র চালিত পানির জাহাজে পরিণত করে ।তারও আগে ঐ পালতোলা নৌকার নিরাপদ যাত্রার জন্য তথা যাত্রাপথের নিশানা নিশ্চিত করার জন্য সমুদ্র উপকূলে লাইট হাউস নির্মাণ করে । খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০ অব্দে অর্থাৎ যীশু খ্রীষ্টের জীবনকাল বা বয়সটা বাদ দিলেওআজ থাকে প্রায় ২৩২৩ বছর পূর্বে তৎকালীন বিখ্যাত ব্যাবসা কেন্দ্র মিশরের আলেকজান্দ্রিয়ায় নির্মিত হয় বিশালাকার লাইট হাউস । মিশরের সন্নিকটে ভূমধ্যসাগর অবস্থিত ফা্রো দ্বীপে প্রায় ১০০ মিটার উঁচু ও বিশাল লাইটহাউসটি নির্মাণ করা হয় । মহান আলেকজাণ্ডারের মৃত্যুর পর এর নির্মাণ কাজ শুরু করেন রোমান সম্রাট প্রথম টলেমি এবং শেষ করেন তার ছেলে দ্বিতীয় টলেমি । সময় লেগেছিল প্রায় ১৮ বছর । কঠিন পাথর কেটে সম্পূর্ণ মনুষ্য শ্রমে নির্মিত এই লাইটহাউসটি সে সময় প্রাচীন পৃথিবীর সপ্তমাশ্চার্যের একটি ছিল বলে জানা যায় । প্রায় ১০০মাইল দূর থেকে এটি দৃষ্টিগোচর হয় । যা ভুমধ্যসাগরের চলমান বাণিজ্যিক জাহাজগুলোকে পথ নির্দেশ করে । বন্দর থেকে নিরাপদে নৌযানগুলোকে প্রবেশ ও বের হতে সাহায্য করে ।এরই অনুকরণে বৃটিশরা অস্ট্রেলিয়ার চারিদিকে সমুদ্র উপকূলের প্রায় ৩৬ হাজার ৭৩৫ কিঃমিঃ জুড়ে প্রায় ২০০ বছরে ৩৫০টি লাইট হাউস নির্মান করে । যা রাতের অষ্ট্রেলিয়া উপকুলকে আলোকিত করে । সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এই লাইটহাউসের আলো যেমন রহস্যময় মনে হয় তেমনি প্রশান্ত মহাসাগরের পথভোলা নাবিকদের মনে আশা জাগায় । নাবিকদের সমুদ্রপথে চলাচলের জন্য এ লাইটহাউসগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ সংকেত । অষ্ট্রেলিয়া বেড়াতে গিয়ে এমন লাইট হাউজ অনেকগুলো দেখেছি । সবগুলোই বেশ দর্শনীয় এবং মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে । অষ্ট্রেলিয়া সরকার এগুলোর যথার্থই রক্ষণাবেক্ষণ করে বলে কোনোটাই পুরোনো বলে মনে হয়নি । বরং মনে হয়েছে সদ্য নির্মিত । অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিণ উপকূলে এ লাইটহাউসের সংখ্যা খুবই কম । কারণ ওইদিকে কোনো দেশ নাই । এ লাইটহাউসগুলোর কোনো কোনোটি অস্ট্রেলিয়ার দর্শনীয় স্থান হিসেবে বিবেচিত । কিয়ামা ব্লো হোল“ব্লো হোল” অর্থ ঘুসি , ধাক্কা বা আঘাত এর গর্ত বা গহবর । কথাটা সত্যই । তবে সেই ঘুসি বা আঘাত মানুষের নয় , পানির । পাথরের গর্তে সমুদ্রের পানির প্রচণ্ড আঘাত বা ধাক্কা ।অস্ট্রেলিয়ার অসংখ্য আকর্ষণীয় ও দর্শনীয় স্থানের মধ্যে কিয়ামা ব্লো হোল খুব কম আকর্ষণীয় কিন্তু ব্যাপকভাবে দর্শনীয় । অস্ট্রেলিয়ার নর্থ সাউথ ওয়েলস রাজ্যের ওলনগং এ এই ব্লো হোল অবস্থিত ।
এর দুপাশে রয়েছে বেশ কিছু সমুদ্র সৈকত বা সীবীচ আর প্রতিটি সীবীচে রয়েছে পিকনিক করার সকল সুযোগ সুবিধা। অষ্ট্রেলিয়া সরকার দেশের নাগরিকদের এবং পর্যটকদের জন্য আনন্দের ব্যবস্থা করে রেখেছে । বন্ধু কন্যা অষ্ট্রেলিয়া প্রবাসী পারভিনের পরিবার ও আমার ছেলের পরিবারে আমরা স্বামী স্ত্রী সহ ৯ জন পিকনিক করা সহ ব্লো হোল পরিদর্শনের জন্য প্রস্তুতি নিলাম । তবে পরিদর্শন স্থলে রান্নাবান্নায় সময় নষ্ট না করার জন্য দুই পরিবার পরিকল্পনা অনুযায়ী বাড়িতেই রান্না করে নির্দিষ্ট দিনে দুটি গাড়িতে করে রওয়ানা দিলাম ক্যাম্বেল টাউনের মিণ্টো ও ইঙ্গেলবার্ন সাবআর্ব থেকে । এখান থেকে দূরত্ব প্রায় ৫৬ কিঃমিঃ । সময় লাগবে প্রায় সোয়া ১ ঘন্টা এবং যেতে হবে গড়ে ওঠা নতুন শহর আপ্পিন এর মধ্য দিয়ে । পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও মসৃণ রাস্তা । কোথাও কোনো দুলুনি ঝাঁকুনি নেই বাংলাদেশের রাস্তার মত । বেশ আরামেই যাচ্ছিলাম এই বৃদ্ধ বয়সে । ব্লো হোল পৌঁছানোর কয়েক কিঃমিঃ আগে দেখতে পেলাম অভূতপূর্ব দৃশ্য । সমুদ্র আর পাহাড়ের মিলন । একদিকে অথৈ প্রশান্ত মহাসাগর আর তার পাশেই বিশাল উঁচু পাথুরে পাহাড় ।শুধু মাঝখান দিয়ে পাহাড় কেটে তৈরি করা একটি চিকন রাস্তা । এমনই পাহাড়ের উঁচুতে এক স্থানে দেখলাম একেবারে সমুদ্রের পাশে মাত্র ২০০ থেকে ২৫০ বর্গ গজ জায়গায় অষ্ট্রেলিয়া সরকার পর্যটকদের জন্য সমুদ্র দেখার একটি ক্ষুদ্র স্পট করে রেখেছে । সেখানে গাড়ি দুটি পার্কিং করে প্রাণভরে দেখলাম প্রশান্ত মহাসাগরের বিশাল নীল জলরাশি , ছবি তুললাম ,পারভিনের তৈরি করা নাস্তা খেলাম সবাই । এরপর রওয়ানা দিলাম গন্তব্যের দিকে । কয়েকমিনিটের মধ্যে দেখলাম আমাদের গাড়ি সহ বেশকিছু গাড়ি পাহাড় থেকে নিচের দিকে নামছে আর রোদের ছটায় প্রতিটি গাড়ির গ্লাসগুলো বিদ্যুতের মত চমক দিচ্ছে । দৃশ্যটি নিঃসন্দেহে উপভোগ্য ছিল। নিচে নেমে কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা একটি ছোট সীবীচে পৌঁছলাম । গাড়ি থেকে নেমে সীবীচটা দেখলাম । সুন্দর বালুকাময় বেলাভুমি নিয়ে একাকী দাঁড়িয়ে আছে ।এক মহিলাকে দেখলাম ঐ বেলাভুমিতে শুয়ে রোদ পোহাচ্ছে আর তার পাশেই দুটি শিশু ভেজা বালু খুড়ে পানি বের করছে । এছাড়া কোনো দর্শনার্থীকে দেখলামনা ।এরপর পথের পাশে আরো দুটি সীবীচ দেখে পৌঁছে গেলাম ব্লো হোল পাহাড়ে । দেখলাম রঙ বেরঙের অসংখ্য দর্শনার্থী । ব্লো হোলের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে সুন্দর ও সুউচ্চ একটি লাইট হাউস। দ্রুত ছুটে যাচ্ছি ব্লো হোলের দিকে আর শুনতে পাচ্ছি ছটাৎ ছটাৎ শব্দ । কাছে গিয়ে দেখলাম প্রকৃতির এক অপার সৃষ্টি। কুয়ার মত একটি পাথুরে গর্তের তলদেশ দিয়ে সমুদ্রের পানি প্রবেশ করছে অনবরত। যখন পানির চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে তখন হঠাৎ শব্দে এলাকাটি প্রকম্পিত করছে এবং কুয়ার পানি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে ও কোনো কোনো সময়ে দর্শকদের ভিজিয়ে দিচ্ছে ।কত যুগ ধরে প্রকৃতির এই গতি অব্যাহত আছে তা বলা যায়না । তবে অষ্ট্রেলিয়া সরকার ঐ কুয়া ও পানি প্রবাসের স্থানটিকে দর্শকদের দেখার উপযোগী করে গড়ে তুলেছে । বিকেল ৫টা পর্যন্ত দর্শকরা আসছে , প্রকৃতির এই লীলা দেখছে , ছবি তুলছে । খাওয়াদাওয়া করছে , প্রেমিক প্রেমিকারা দুরে বসে চুম্বন করছে । আমরাও দুপুরে খেয়ে নিলাম । পারভিন তার ব্যাটারি চালিত চুলায় খাবার গুলো গরম করে দিলো আর খাদিজা পরিবেশন করলো এরপর আমি আবার ব্লো হোলের কাছে রেলিং এর একপাশে দাঁড়িয়ে আমার মোবাইলে সংরক্ষিত হেমন্ত মুখোপধ্যায় এর গান জুড়ে দিলাম বেশ সাউন্ড দিয়ে । লক্ষ্য হলো কোনো বাঙালি , হোক সে বাংলাদেশের বা পশ্চিমবঙ্গের বা অষ্ট্রেলিয়া প্রবাসী বাঙালি আকৃষ্ট হয় কি না । কিছুক্ষণের মধ্যে দুটি প্রবাসী বাংলাদেশি পরিবার এগিয়ে এলেন । কথা হলো , পরিচয় হলো । বললেন কাজের ব্যস্ততায় এসব গান শোনা হয়না । দুঃখের কথা বলে রাখি, এসব প্রবাসী বাঙ্গলীদের পরবর্তী প্রজন্ম কেউই আব্দুল জাব্বার , ফেরদৌসী বেগম , ফিরোজা বেগম, আব্দুল আলিম,সাবিনা ইয়াসমিন, আব্দুল হাদী, হেমন্ত মুখোপধ্যায়, মান্নাদে, লতা মুঙ্গেস্কার ,সতি নাথ , তালাত মাহমুদ, শ্যামল মিত্রের নামই শোনেনি । একসময় এরা বাঙালি সংস্কৃতি হারিয়ে ফেলবে । সে না হতে পারবে অস্ট্রেলিয়ান না হতে পারবে বাঙালি । থাকবেনা তাদের অতীত ইতিহাস , ঐতিহ্য ,ভাষাগত পরিচয় , ধর্মীয় পরিচয় , আদিত্ব , মৌলিকত্ব। যে কোনো বিচারেই তা হবে ভীষণ পীড়াদায়ক ।
Leave a Comment
Your email address will not be published. Required fields are marked with *