,
সামসুল ইসলাম টুকু: অস্ট্রেলিয়ায় নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য বাংলাদেশের চেয়ে বেশী বলেই ধারণা করা হয়। কিন্তু সেখানকার মানুষের আয় রোজগার এবং ব্যয় তুলনা করলে তা মোটেও বেশী বা ব্যয়বহুল নয়।
অষ্ট্রেলিয়া বেড়াতে গিয়ে বিভিন্ন পণ্যের মূল্য জিজ্ঞাসা করলে তারা দামটা ডলারে বলে।আমি শুনী আর মনে মনে হিসাব কষি এত ডলার হলে কত টাকা হয়। হিসাব শেষ হলেই চমকে উঠতাম। প্রবাসী বাঙালি দোকানদারকে বলতাম দাম খুব বেশী।তারা বলতো যেমনভাবে বাংলাদেশে টাকা গুনেন তেমনিভাবে ডলার গুনবেন তাহলে বেশী মনে হবেনা কিন্তু ডলারকে টাকায় রূপান্তর করলেই চমকে উঠবেন। এমনটা আমাদেরও মনে হতো যখন প্রথম এসেছিলাম এবং কয়েকমাসের মধ্যে সে ধারণা মন থেকে মুছে গেছে।আমার জীবনে এই প্রথম ডলারের দেশে এসেছি। স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও উড়োজাহাজ যাওয়া আসার টিকিট এর দাম সহ আমাদের স্বামী স্ত্রীর প্রায় ৪ লাখ টাকা খরচ হয়ে গেছে।সবই ছেলের টাকায়। তার উপরে আমরা সেখানে ৭৫ দিন থাকবো খাবো বেড়াবো। ফলে ছেলের অনেক টাকা খরচ হবে। সেখানে ছেলে বউমা থাকে। বাড়ি ভাড়া দেয় এক লাখ কুড়ি হাজার টাকা, বিভিন্ন বিল খাওয়া খরচ আরো এক লাখ টাকা। সুতরাং আমরা তাদের কাছে বোঝা হয়ে গেলাম নাতো। এমন আশঙ্কার কথা বুঝতে পেরে ছেলে বললো,চিন্তা করবেন না।ঘোরা ফেরা করেন।সপ্তাহে দুদিনের ছুটিতে আপনাদের গাড়িতে করে দূরে ভ্রমণে নিয়ে যাবো।এদিকে আমি যখনই মলে যেতাম তখনই বিভিন্ন পণ্যের দাম জিজ্ঞাসা করতাম এবং নোটবুকে লিখে রাখতাম অস্ট্রেলিয়ান ডলারের মূল্য ৮০ টাকা ধরে সেখানকার বেশ কিছু খাদ্য পণ্যের তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরলাম। সেখানে গরুর মাংস প্রতি কেজি ১২ডলার বা ৯৬০ টাকা যা বাংলাদেশে ৭০০টাকা,গরুর কলিজা ৭ডলার বা ৫৬০টাকা যা বাংলাদেশে ৭০০ টাকা। গরুর ভুঁড়ি ১০ ডলার বা ৮০০ টাকা যা বাংলাদেশে ৩০০টাকা। এখানেও যে গরুর ভুঁড়ি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে সোকেশে সাজানো থাকে তা দেখে আমি বেশ আশ্চর্য হয়েছি।তবে নিশ্চিত হয়েছি যে অস্ট্রেলিয়ানরাও ভুঁড়ি খায়। কিন্তু এই ভুঁড়ি খাওয়ার প্রচলন কে বা কারা শুরু করেছিল এবং কখন এটা খাদ্য তালিকায় স্থান করে নেয় সে ইতিহাস জানতে পারিনি। তবে বাংলাদেশে দেখি আমার জন্মের আগে অর্থাৎ ৭৫ বছর বা তার ৭৫ বছর আগে থেকে এটা খাদ্য তালিকায় স্থান পেয়েছে।সে সময় গরিব মানুষেরা গরুর ভুঁড়ি খেয়ে তাদের আমিষের চাহিদা পুরন করেছে।আর বর্তমানে অভিজাতদের ঘরেই তা চালু হয়ে গেছে বেশ উপাদেয় খাদ্য হিসেবে।একদিন এক মলের সোকেশে দেখলাম শুয়োরের একটা মাথার চামড়া উঠিয়ে পরিষ্কার করে সাজানো আছে।দামটাও কম না। কেজি প্রতি ১৫ ডলার বা ১২০০ টাকা। বেশ বড় ব্রয়লার মুরগির মাংস প্রতি কেজি ৫ ডলার বা ৪০০ টাকা যা বাংলাদেশে সর্বোচ্চ ৩০০ টাকা কেজি। এখানে জ্যান্ত মুরগি পাওয়া যায়না। কারণ যেখানে সেখানে মুরগি জবাই করলে পরিবেশের ক্ষতি হয়। এজন্য জ্যান্ত মুরগি মলে পাওয়া যায়না।এখানে মুরগির গলা, ডানা,পা, কলিজা,রান পৃথক ভাবেও পাওয়া যায় কিন্তু দাম প্রায় একই সমান। এখানে সবচেয়ে কমদামি সামুদ্রিক মাছ সেটাও প্রতি কেজি ১০ ডলারের কম নয়।অর্থাৎ ৮০০ টাকা বাংলাদেশে ভাল রুই কাতলা মাছ ৩৫০ টাকা কেজির বেশী নয়।অন্যান্য মাছের দাম বাংলাদেশের ৩/৪ গুন।এখানে চিংড়ি প্রতি কেজি ৩০ ডলার বা ২৪০০ টাকা। বাংলাদেশে গলদা চিংড়ির দাম ১২০০ থেকে১৫০০ টাকার বেশী নয়।এখানে ব্রয়লার মুরগির ডিম প্রতিটি ৩০টাকা যা বাংলাদেশে ১৫টাকার বেশী কখনো হয়নি।
এখানে ভারতীয় সোনামাসুরি চিকন চাল ২.৫ ডলার বা ২০০ টাকা কেজি,একই মানের চাল বাংলাদেশের মিনিকেট মাত্র ৭০ টাকা কেজি।চিনি আতপ বা পোলাও চাল অস্ট্রেলিয়ায় বিক্রি হয় কমপক্ষে ৪.৫ ডলার বা ৩৬০ টাকা কেজি,অথচ বাংলাদেশে এর মূল্য মাত্র ১২৫ টাকা কেজি। বিভিন্ন ধরনের ডাল এখানে কম বেশী ৩ ডলার বা ২৪০ টাকা,যা বাংলাদেশে ১৪০ টাকার উপরে নয়। এখানে আলুর দাম প্রতি কেজি ২ডলার বা ১৬০টাকা কেজি,বাংলাদেশে ৬০টাকার বেশী হয়নি।অস্ট্রেলিয়ায় প্রচুর গম উৎপাদিত হয়। অথচ সেখানে প্রতি কেজি গমের আটার দাম ১.২৫ ডলার বা ১০০টাকা,যা বাংলাদেশে সর্বোচ্চ ৬০টাকা। সোয়াবিন,সূর্য মুখি, শরিষা সহ খাবার তেলের সর্বনিম্ন মূল্য ৩ ডলার বা ২৪০ টাকা কেজি,বাংলাদেশে খুব আকালেও ২০০টাকার বেশী হয়নি।
অষ্ট্রেলিয়া গিয়ে প্রথমেই আমার পেটের পীড়া হয়েছিল তাই পেট ঠান্ডা রাখার জন্য ছেলেকে কিছু সুজি ও চিড়া কিনতে বলেছিলাম। পরে দাম জিজ্ঞাসা করলে সে বলেছিল চিড়া প্রতি কেজি ৪ ডলার বা৩২০ টাকা এবং সুজি প্রতি কেজি ৫ডলার বা ৪০০ টাকা, যা বাংলাদেশে যথাক্রমে ৮০ ও ৯০ টাকা কেজি। প্রাণ কোম্পানির পটেটো(২৫ গ্রাম) চীপ্স এর দাম সেখানে ১ ডলার বা ৮০ টাকা,যা বাংলাদেশে মাত্র ১০ টাকা। গুড়াসাবান ১কেজির দাম ৮ ডলার বা ৬৪০ টাকা যা বাংলাদেশে মাত্র ১২০ টাকা।পেঁয়াজ প্রতি কেজির সর্বনিম্ন মূল্য ২ ডলার বা ১৬০ টাকা, যা বাংলাদেশে খুব আকালেও ১০০টাকার বেশী হয়নি।অস্ট্রেলিয়ায় কাঁচামরিচ এর দাম খুবই অস্বাভাবিক।প্রতি কেজি ১৫ ডলার বা ১২০০ টাকা, বাংলাদেশে খুব আকালেও ২০০টাকা হয়নি।অস্ট্রেলিয়ায় উৎপাদিত আম কেজি প্রতি৩/৪ ডলার বা ২৪০থেকে ৩২০ টাকা,বাংলাদেশে সবচেয়ে সুস্বাদু খিরসাপাত, ল্যাংড়া, গোপালভোগ,প্রতি কেজি ১০০ টাকার বেশী নয়। হালে কিছু বিদেশি জাত কাটিমন, ব্যানানা, গৌড়মতি কয়েকটি জাতের আম মৌসুমের পরে উৎপাদিত হয় বলে সেগুলোর দামও ২০০টাকা র বেশী হয়না।অস্ট্রেলিয়ায় উৎপাদিত হয় কমলা,আপেল,নাশপাতি, কিউই,এভকডো বিভিন্ন জাতের তরমুজ প্রভৃতি ফল। এর মধ্যে কমলা ও আপেলের দাম বাংলাদেশের সমান।অর্থাৎ কেজি প্রতি ১৫০টাকা থেকে ২৫০ টাকা পর্যন্ত।শুনেছি অস্ট্রেলিয়ার কমলা বাগানে যেতে পারলে পেট ভরে কমলা খাওয়া যায় তার উপরে ব্যাগ ভরে আনা যায়।
এখানে টমেটো(ডাঁসাডাঁসা) প্রতি কেজি ৩ ডলার বা ২৪০ টাকা,যা বাংলাদেশে সর্বোচ্চ ১০০টাকার বেশী নয়।বরবটি প্রতি কেজি ২ডলার বা ১৬০টাকা, বাংলাদেশে সর্বোচ্চ ৮০টাকা। বেগুন কেজি প্রতি ৩ডলার বা ২৪০টাকা,যার মূল্য বাংলাদেশে ৬০টাকার বেশী নয়। ঢেঁড়ষ প্রতি কেজি ১৩ডলার বা ১০৪০ টাকা,যা বাংলাদেশে ১০০টাকার উপরে না। ফুলকপি, বাঁধাকপি,ঝুকিনির দাম ২থেকে ৩ডলার বা ১৬০তাকা থেকে ২৪০টাকা, বাংলাদেশে ৬০টাকার উপরে নয়। বিভিন্ন ধরনের শাক কমপক্ষে ১০ডলার প্রতি কেজি, বাংলাদেশে ৬০টাকার বেশী না। অস্ট্রেলিয়ার মলগুলোতে সব ধরনের ফল মূল পাওয়া যায়। যেমন…আঙুর, বেদানা, খেজুর, খুরমা, কিশমিশ, মনাক্কা, ইষপগুলের ভুঁসি, কাঠবাদাম, পেস্তা, আখরোট, জাইফল, জৈত্রী, জাফরান।তবে দামের দিক থেকে বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বেশী।অন্যদিকে এসব পণ্যের মূল্য বাংলাদেশে তুলনামূলক কম হলেও বাংলাদেশে মজুরিও খুব কম। অস্ট্রেলিয়ায় এক ঘণ্টার মজুরি ২৫ ডলার বা ২হাজার টাকা আর বাংলাদেশে ৮ ঘণ্টার বা একদিনের মজুরি মাত্র ৪০০টাকা। তাই বাংলাদেশে পণ্যের দাম কম হলেও তাদের ক্রয়ক্ষমতা নিতান্তই কম। ফলে বাংলাদেশে খেটে খাওয়া ২কোটি মানুষ প্রতিনিয়ত অর্থকষ্টে ভোগে। প্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে পারেনা তখন আওয়াজ তোলে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য কমানোর, মজুরি বৃদ্ধি করার,প্রতিবাদ করে দুর্নীতির বিরুদ্ধে।বাংলাদেশ সরকার দাবি করে তারা প্রত্যেক সপ্তাহে ১কোটি গরীব মানুষকে ৫কেজি চাল ও ৫কেজি আটা প্রায় অর্ধেক মূল্যে দেয়। এছাড়া বিধবা ভাতা,বয়স্কভাঁতা, শিক্ষাভাঁতা, মুক্তিযোদ্ধা ভাঁতা সহ বিভিন্ন ধরনের ভাতা চালু রেখেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় দলীয় লোকজন এই ভাতা পায় আর কিছু আত্মসাৎ হয়। কিন্তু এটি সমাধানের কোনো পথ নয়।বরং কিছু লোককে অকর্মণ্য করে তোলা,পরমুখাপেক্ষী করা। কিন্তু এই বিপুল পরিমাণ খাদ্য ও ভাতার অর্থ পরিকল্পিতভাবে কাজের বিনিময়ে দেওয়া হয় তাহলে প্রতিদিন বহু খাল খনন,বাঁধ নির্মাণ, রাস্তায় মাটি ওঠানো সহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ করিয়ে নেওয়া সম্ভব। এতে রাষ্ট্র উপকৃত হবে। অন্যদিকে বাংলাদেশে সরকারি বেসরকারি অফিসের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে যে অস্বাভাবিক বেতন বৈষম্য এবং খেটে খাওয়া মানুষদের মধ্যে যে মজুরি বৈষম্য বিরাজ করছে তা কমালে ও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে সমগ্র দেশের মানুষ সুখে থাকবে। অস্ট্রেলিয়ার অর্ধেক মজুরিরও দরকার হবেনা। সামান্য বাড়ালেই খেটে খাওয়া মানুষগুলোর অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।কমদামে চাল আটা দেওয়ার ও আত্মসাতের সংস্কৃতি বন্ধ হবে। খেটে খাওয়া মানুষেরা পেট ভরে ডাল ভাত ছাড়া বেশকিছু চায়না। বাংলাদেশের কোনো সরকারের পক্ষে এটি খুব কঠিন কাজ নয় বলেই মনে হয়।এ প্রসঙ্গে আর একটি কথা না বললেই নয়। তা হচ্ছে পত্র পত্রিকা সোশ্যাল মিডিয়া সহ পৃথিবীর বিখ্যাত গণ মাধ্যম খুব পরিষ্কার ভাষায় বলছে লক্ষ কোটি টাকা দেশ থেকে পাচার করে দিচ্ছে সরকারের মন্ত্রী ও আমলারা এবং তার তথ্য প্রমাণও হাজির করেছে।তারপরেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তি মুলক ব্যবস্থা তো দূরের কথা তদন্ত পর্যন্ত শয়ানা। কিন্তু ওইপাচারকৃত টাকা দিয়ে সোনার বাংলা গড়া যেত।এত উলঙ্গ বৈষম্য দেখা যেতনা।উন্নত দেশগুলোর পর্যায়ে উন্নীত হতে পারতো এই দেশটি। এ ধারণা কি শাসক গোষ্ঠীর মাথায় আসেনা। যা জনপ্রিয়তার জন্য যথেষ্ট।ডামি নির্বাচন, রাতের নির্বাচন, বিনা ভোটে নির্বাচনের দরকার হতোনা।
লেখক—- সাংবাদিক