কুসুম সেই কখন থেকেই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সে একমনে নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। কপালের ছোট্ট কালো টিপটা তার মায়াবী মুখে একটা মোহনীয় দ্যোতনা সৃষ্টি করেছে। বিষয়টা সে ভালোই খেয়াল করেছে। জলপাই রঙের পাটভাঙা শাড়ি, চেক ব্লাউজে বাঙালিয়ানার ষোলোকলা পূর্ণতা পেয়েছে আজ। গলায় লাল সাদা স্টোনের মালা। অনিন্দ্য এক রূপকথার রাজকন্যার মতোই কুসুমকে দেখাচ্ছে!
কুসুম সেই কখন থেকেই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সে একমনে নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। কপালের ছোট্ট কালো টিপটা তার মায়াবী মুখে একটা মোহনীয় দ্যোতনা সৃষ্টি করেছে। বিষয়টা সে ভালোই খেয়াল করেছে। জলপাই রঙের পাটভাঙা শাড়ি, চেক ব্লাউজে বাঙালিয়ানার ষোলোকলা পূর্ণতা পেয়েছে আজ। গলায় লাল সাদা স্টোনের মালা। অনিন্দ্য এক রূপকথার রাজকন্যার মতোই কুসুমকে দেখাচ্ছে! কুসুম নিজেকে আয়নায় দেখছে আর চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে তার গাল বেয়ে। শব্দহীন নৈশব্দের ইন্দ্রজালে এখন সে বন্দী। রোদজ্বলা দুপুরে হঠাৎ মেঘেদের উৎপাতের মতো অকাল সন্ধ্যার অন্ধকারে ডুবে আছে কুসুম।
কুসুমের ঠিকানা রোকেয়া হল। বাংলায় পড়ে। চতুর্থ বর্ষ। বাংলার পলল মাটির মতো বেদনা শুষে নিতে সে জানে। তাইতো এমন দিনেও সে বাইরে বের হচ্ছে। দারুণভাবে সামলে নিয়েছে নিজেকে। রান্না করা খাবারগুলো লাল নীল বক্সে ভরে রেখেছে সেই সকালে। একটা বক্সে সেমাইও আছে। কুসুম চপলা হরিণীর মতো দ্রুত পায়ে হেঁটে যাচ্ছে গেইটের দিকে। পেছন পেছন আসছে আতিক মামা। হলের কর্মচারী হলেও কুসুমকে আতিক মামা খুব আদর করেন। কুসুমের অনেক কাজ নিজের গরজে করে দেন। এইযে আজও খাবারের ব্যাগ দুটো বয়ে আনছেন। কুসুম গেইট থেকে মুখটা খানিক বাইরে বের করে ইতিউতি রিক্সা খুঁজছে। কিন্তু রাস্তায় কোনো রিক্সা দেখা যাচ্ছে না। এমন কী একজন মানুষও নেই টিএসসির সড়ক দ্বীপে! অবশ্য থাকার কথাও না। ঈদের সময় হলগুলো পইপই করে খালি হয়ে যায়। সবাই নাড়ির টানে ছুটে যায় বাড়িতে। স্বজনদের কাছে। সম্পর্কের উষ্ণতায় তাদের ঈদটা তখন আরো ঘন হয়ে ওঠে। আনন্দের ফুলকিধারা ফুটে মনের আঙিনা জুড়ে। কুসুমেরও ইচ্ছে হয়- বাড়িতে যেতে। মা বাবার কাছে যেতে। ভাইবোনদের সাথে হৈ-হুল্লোড় করতে। চাঁন রাতে মেহেদি পরতে তারও নিশ্চয়ই মন্দ লাগতো না। গাঁয়ের সবার সাথে ঈদ করতে কুসুমেরও ইচ্ছে হয়। কিন্তু সবার কপালে তো আর সব সয় না।
কুসুমেরও সয়নি। তার জন্মের শুভ লগ্নে মায়ের নাই হওয়ার গল্প- এখনো তাকে তাড়া করে। পাড়াপড়শির দেয়া অপয়া অপবাদ নিয়েই বড়ো হয়েছে কুসুম। বাবার দ্বিতীয় বিয়ে। ঘরে সৎ মায়ের নীরব অত্যাচার- তার শরীর ও মনে বিভৎস ক্ষত সৃষ্টি করেছে। তাও তো অনেক বছর হয়। ব্যথা সইতে সইতে তার মনটা এখন পাথর হয়ে গেছে। শত লাঞ্ছনা গঞ্জনা সে পিঠে বয়ে বেড়াতে জানে প্রচন্ড রকমের নির্লিপ্ততায়। সেই ছেলেবেলা থেকেই পড়াশোনায় বেশ তুখোড় ছিল কুসুম। জেদটা বুকে পুষে রেখেছিল গোপনে। পড়াশোনা ও ন্যূনতম আশ্রয়ের জন্য কুসুম আজ থাকে তো নানা বাড়ি, তো কাল ফুফুর বাড়িতে। সহপাঠী বান্ধবীর আয়েশার বাড়িতে থেকেও সে এইচএসসি পাশ করেছে। তারপর তার নিজ গ্রামের বড়ো আপুর সহযোগিতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। তারপর থেকে তারা নিজেরা ক্রমেই নিজের গ্রামের সাথে নাড় কাটতে থাকে। সম্পর্কের নাড়িতে শেষ পোঁচটা পড়ে তার বাবার মৃত্যু দিয়ে। বাবার মৃত্যুর পরের কুসুম বাড়িতে ঈদ করতে গিয়েছিল। সৎ মা ও ভাইবোনদের জন্য কাপড়চোপড় কিনে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তাদের মন গলেনি। দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছিল তারা। হয়তো সম্পত্তিতে কুসুমকে উটকো ঝামেলা মনে করে তারা তাড়িয়ে দিয়েছিল। তারপর থেকে কুসুম ঢাকায় থাকে। একাকী থাকে। হলে তার মত আরো দু’চার জন হলেই ঈদ করে। এই রঙিলা শহরে নির্বাসিত কুসুমের গত দু’টো ঈদই কেটেছে খেয়া’র ছাত্রছাত্রীদের সাথে।
উপায় না পেয়ে আতিক মামাই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের উন্মুক্ত মঞ্চে খাবারগুলো পৌঁছে দেন। আতিক মামাকে কুসুম পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে। মামা হলে ফিরে যাবার সময় আতিক মামার হাতে কুসুম পাঁচশত টাকা গুঁজে দেয়। কিন্তু আতিক মামা কিছুতেই টাকা নেয় না। সজল চোখে মামা বলেন, ‘মাগো, আপনি এতো ভালো কেন!’ বাক্যটার প্রতিধ্বনি শেষ হতে না হতেই চোখটা মুছতে মুছতে হলের দিকে হেঁটে যায় আতিক মামা।
কুসুমকে দেখেই খেয়া’র ছোট্টো ছেলেমেয়েরা দৌঁড়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে। কেউ কেউ পা ছুঁয়ে সালাম করে। মুহূর্তেই কুসুমের মনের গুমোট মেঘ কোথায় যেন উড়ে যায়! স্মৃতির নীল বিষ উবে যায় শিশুদের উষ্ণ ভালোবাসায়। কুসুমই তাদের মা-বাবা। খেয়া- কুসুমের বিকেলবেলার স্কুলের নাম। এখানে দশ বারো জন পথশিশু বর্ণমালার সাথে পরিচিত হয়। টিউশনের টাকায় কুসুম স্কুলটা চালায়। এই শিশুদের ঘিরেই তার যত্তো সব ভাবনা। ওহ! একটা সময় কুসুমের পাশে আরেকজন মানুষ ছিল। একই স্বপ্নের মানুষ। একই বৃত্তের মানুষ ছিল- তূর্য। তূর্যের সাথে কুসুমের ভাব হয় দ্বিতীয় বর্ষে। একই সাথে পড়াশোনা। সম্পর্কের ঘনত্ব ছিল গাঢ়। এখন তূর্য আর কুসুমের পাশে নেই। আজকাল সিলভির পাশেই দেখা যায়। গা লেপ্টে বসে ফুচকা খায়। বাদামের খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে দু’জনে হাসতে হাসতে কুটিকুটি হয়।। প্রথম প্রথম এই দৃশ্যগুলো ভীষণ রকম সুঁই ফোটা যন্ত্রণার মতো বুকে বিদ্ধ হতো। ইদানীং তেমন আর লাগে না। অনুভূতির শরীর জুড়ে মখমলের একপ্রস্ত কাপড় জুড়ে নিয়েছে কুসুম। সেই মখমলের কাপড়ে ব্যথারা এসে হোঁচট খেয়ে পড়ে থাজে। কষ্টগুলো হুঁল ফুটাতে পারে না। বেদনারা অসহায়ত্ব প্রকাশ করে মখমলের কাপড়ে গা এলিয়ে শোয়। ঘুম যায়। কুসুমের কাছে বরং এই সব বিচ্ছেদ বিরহকে জীবনে স্বাভাবিকই মনে হয়। যে মেয়ের কোনো পরিবার নেই পরিজন নেই, যে মেয়ের জীবন অনেকটা বেদেদের মতো- তাকে আর যাই হোক কোনো পরিবার মেনে নিবে না। তাই হয়তো চতুর তূর্য কুসুমের কাছ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছে। অথচ মাঝদরিয়ায় ডুবন্ত মানুষ যেমন খড়কুটো ধরেও বাঁচতে চায়! তেমনি কুসুমও তূর্যকে অবলম্বন করে বাঁচতে চেয়েছিল!
কুসুম এখন একা। বড্ড একা। এই ক্যাপাসে তার কোনো বন্ধু নেই। কোনো সার্কেল নেই। একলা একা হাঁটতে সে খুব ভালোবাসে। ক্লাস, লাইব্রেরি আর টিউশন- এই নিয়েই তার জীবনচক্র। সপ্তাহে চারদিন টিউশন করে। বাদ বাকি তিনদিন খেয়া নিয়ে ভাসে। শিশুদের নিয়ে স্বপ্ন দেখে। শিশুদের কচি চোখে সে দুর্দান্ত স্বপ্ন আঁকে। খেয়ায় সবাই নতুন জামা কাপড় পরে এসেছে। জরিনা, শিরিন, মায়িশা, পূর্ণিমা, লতা- তাদেরকে সাজিয়ে দেয়ার জন্য সাজের বক্সটা খুলে বসেছে কুসুম। আলীম, তপু, সাজু, রাকিব, পিকুলরা আশেপাশে ছুটাছুটি করছে। আজ তাদের খুব আনন্দের দিন! এমন ঘটা করে তারা ঈদ করেনি কেউ। ঈদের নতুন পোশাক, সেমাই, পোলাপ-কোর্মা খায়নি অনেক বছর হয়! সবই কুসুমের জন্য হয়েছে। ঈদ আর ঈদের এই নির্মল আনন্দ- কুসুমের মায়া।
সবাইকে নিয়ে খাওয়াদাওয়া শেষ করে গোল হয়ে বসেছে কুসুম গং। সবুজ ঘাসের ওপর বসে একজন একজন করে গান ও গল্প পরিবেশন করছে। পরিবেশনা শেষে বাকিরা হাততালিও দিচ্ছে। কুসুমও গান করেছে। দারুণ একটা দিন কাটালো খেয়ার বাসিন্দাদের। হলে ফেরার সময়- তাই পথশিশুদের হাতে হাতে ঈদের সেলামি দিয়ে কুসুম বিদায় নেয়। হলের অভিমুখে একা সে হাঁটতে থাকে। মনে এলোমেলো স্মৃতির চিৎকার চেঁচামেচি। বাবার কাঁধে চড়ে ঈদগাহে যাওয়ার স্মৃতি এসে খোঁচা দিলো চোখে ও মনে। চোখে জল এলো কুসুমের। তবুও খানিকটা কায়দা করে লুকিয়ে রাখলো চোখের নোনা জল। শৈশবে নতুন ফ্রক পরে বাবাকে সালাম করা। সালামি দেয়ার জন্য বাবাকে চাপাচাপি করা। সেলামির টাকায় লাল আইসক্রিম কিনে খাওয়া। ফানটা আইসক্রিম। ঠোঁট ও মুখ কমলা রঙা হয়ে যেত! আহা রে ঈদ! খুশিগুলো আজ স্বার্থসিদ্ধির আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায়! সেই ছাই মুঠো ভরে কুড়ায় কুসুম।
হিজলতলীর গ্রামের সেই কিশোরীবালার ভাইয়ের মতো যদি কুসুমের সৎ-ভাইও খেয়া ভিড়াইতো তার ঘাটে! যদি সে কুসুমকেও এই নিঃসঙ্গ নির্বাসন জীবন থেকে বাড়িতে তুলে নিয়ে যেত। নাইওর করে। দিনে দিনে পুঞ্জিভূত অভিমানের জমাট বরফ হয়তো তখন গলে যেত। কুসুমও ফিরতে পারতো আপন ভিটায়। যেখানে তার নাড় পোঁতা আছে। সেখানেই সে ফিরতে চায় শতজন্মে শতবার। এসব ভাবতে ভাবতে কুসুম আকাশের দিকে তাকায়। তার চোখের জল গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে এই পাষাণ শহরের পিচঢালা সড়কে….
Leave a Comment
Your email address will not be published. Required fields are marked with *