কামাল মাহমুদ,ফ্লোরিডা: স্কুলজীবনে আমার জানি দোস্ত ছিল কুদরত, কাজী কুদরত ই খুদা। আমরা আদর করে তাকে ডাকতাম 3K (কু ক্লাক্স ক্লেনের সাথে ভিন্নতা বুঝানোর জন্য)। আমাদের সকলের আইকন 3K, বিশেষ করে মেয়েদের কাছে তার ডিমান্ড তুঙ্গে। বিধাতা কুদরতি হাতে তাকে হ্যান্ডসাম, স্মার্ট, কেতাদুরস্ত ও রমনীমোহন করে আমাদের মাঝে পাঠিয়েছেন। ওকে নিয়ে আমাদের মধ্যে কোন
কামাল মাহমুদ,ফ্লোরিডা: স্কুলজীবনে আমার জানি দোস্ত ছিল কুদরত, কাজী কুদরত ই খুদা। আমরা আদর করে তাকে ডাকতাম 3K (কু ক্লাক্স ক্লেনের সাথে ভিন্নতা বুঝানোর জন্য)। আমাদের সকলের আইকন 3K, বিশেষ করে মেয়েদের কাছে তার ডিমান্ড তুঙ্গে। বিধাতা কুদরতি হাতে তাকে হ্যান্ডসাম, স্মার্ট, কেতাদুরস্ত ও রমনীমোহন করে আমাদের মাঝে পাঠিয়েছেন। ওকে নিয়ে আমাদের মধ্যে কোন হিংসা ছিল না, বরং আমরা সকলে মন্ত্রমুগ্ধের মত ওর দিকে চেয়ে থাকতাম আর ওর কথাগুলো গিলতাম।
আমি যদিও ছিলাম ক্লাসের ফার্স্ট বয়, কিন্তু কুদরতের কাছে আমি একান্তই ক্যাবলাকান্ত, অনুগত এক শিষ্য। ও আমাকে প্রায়ই বলত, “শোন, তুই শিখেছিস কিভাবে লেখার মাধ্যমে স্যারদের মন জয় করা যায়। আর আমি ডক্টরেট করেছি কিভাবে বাস্তব জীবনে ডজন ডজন সুন্দরীর মন জয় করা যায়”। আমার জায়গায় পৌঁছতে তোকে হার্ভার্ড থেকে পিএইচডি করে আসতে হবে। আমিও নির্বিবাদে তার কথা মেনে নিতাম আর ভাবতাম, কুদরতের জীবনটা কত রঙীন, কত রোমান্টিক! আর আমারটি? আলুভাজি আর শুকনো রুটি।
কুদরতের কুদরতি সবচেয়ে বেশি কাজ করত নারী জাতির মন জয়ে। তার প্রেমে পাগলপরা ছিল স্কুলের সকল মেয়েরা। কুদরত বেছে বেছে ডজন খানেকের সাথে ভাব করলেও কোন মেয়ের সাথে সিরিয়াস সম্পর্কে জড়াত না। অত্যন্ত স্মার্টলি মেয়েদের হ্যান্ডেল করার এক চমৎকার ম্যাজিক সে রপ্ত করেছিলো। সেখানে হিন্দু-মুসলিম কোন ভেদ ছিল না। কুদরত যখনি যার, তখনি তার। মেয়েদের মধ্যে কুদরতকে নিয়ে তীব্র প্রতিযোগিতা থাকলেও কেউ ঝগড়াতে জড়াত না, পাছে কুদরতের প্রেমময় দৃষ্টি থেকে বন্চিত হতে হয়, হয়ত সেই ভয়েই।
সেই যুগে সেলফোন দূরে থাক, গ্রামে কোন বাড়িতে এনালগ ফোনও ছিল না। কিন্তু কুদরত ঠিকই স্থান ও কালভেদে একেক অপ্সরার সাথে মিলিত হয়। কুদরত কি ভেল্কি দেখিয়ে সে কারো জন্য রুমাল, কারো জন্য গোলাপ, আবার কারো জন্য বেলী ফুলের মালা নিয়ে হাজির হয়। আমরা শুধু দেখি আর ভাবি, কুদরতকে উপরওয়ালা নিশ্চয়ই নারীর হৃদয় পড়ার ও বুঝার এক দিব্যি শক্তি দিয়েছে। সে কতই না ভাগ্যবান!
স্কুলের পাশের বাড়িটিই ছিল কুদরতদের। মেয়েরা সেখানে নানা ছল ছুতায় ভীর জমাত। কুদরত তাদেরকে গাছের পেয়ারা, আমড়া, বিলাতী গাব, কামরাঙা ইত্যাদি পেড়ে খাওয়ায়। সেখানে কার সাথে আকার ইঙ্গিতে কি কথা হয় জানি না, তবে দেখি ঠিক সময়মতো কুদরত নদীর পাড়ে, দুর্গাপুজার মণ্ডপে, সরস্বতী পূজায়, একুশে ফেব্রুয়ারি এবং স্বাধীনতা দিবসে, স্কুল থেকে নিরাপদ দুরত্বে একেক জনের সাথে ডেটিংয়ে ব্যস্ত থাকে। মেয়েগুলোও মনে হয় বিভিন্ন বাহানায় শুধু কুদরতের সাথে মিলিত হতেই আসে।
হস্তরেখা ও রাশিফলে ভক্তি না থাকলেও আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, কুদরত কন্যা রাশির। কতদিন ওর বাম হাত উল্টে পাল্টে দেখেছি, কিন্তু কোন বিয়ের রেখা আবিষ্কার করতে পারি নি। অবশেষে ক্ষ্যান্ত দিয়ে বলতাম, ভারতের ছিল কৃষ্ণ, পাকিস্তানের আছে খান ইমরান, আর আমাদের আছে কুদরত। এই 3K এর মধ্যেই সকল প্রেম, ভালোবাসা ও রোমান্টিকতা বিধাতা নিহিত করে রেখেছেন। আমরা শুধু দেখলাম আর আফসোস করলাম। কুদরত শুনে মুচকি হাসে।
দেখতে দেখতে একদিন স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে আমি ঢাকা কলেজে চলে এলাম, তারপর আমেরিকা। কলেজ, ইউনিভার্সিটি, হোয়াইট কলার জব, পাহাড়, পর্বত, সমুদ্রের বেলাভূমি, তিলোত্তমা নগরী, অপ্সরা শ্বেতাঙ্গিনী সুন্দরী, জীবনে কতকিছুই দেখেছি। কিন্তু জীবনখানা চিরদিনই রয়ে গেছে আলুভাজি আর শুকনো রুটি। অবশেষে একদিন নাড়ীর টানে, সেই ফেলে আসা গ্রামে তশরিফ নিলাম।
আমাদের বাজারের কাছে গাড়ি থেকে নেমে সবকিছু কেমন যেন অচেনা লাগছিলো। অনেকেরই নাম মনে নেই। তারাও আমাকে দেখে, নিজেদের মধ্যে ফিসফিসিয়ে কথা বলছে। মনে হয়, আমি বিশ্বজয় করে এসেছি। আমার চিরচেনা গ্রাম, আর আমার আজন্ম শৈশবের পরিচিত মানুষগুলোও আমার সাথে কথা বলতে কেমন যেন দ্বিধা ও সংকোচ করছে। যাই হোক, বাড়ির জন্য কিছু ফল কিনতে ফলপট্টি ঢুকলাম। হঠাৎ একজনের সামনে এসে মনে বড় ধাক্কা খেলাম। গায়ে মলিন হাফ হাতা গেঞ্জি, পরনে লুঙ্গি, মুখে লম্বা দাড়ি, গায়ের রঙ ময়লা। কিন্তু চিনতে একটুও ভুল হচ্ছে না, সে আমার কৈশোরের আইকন, কাজী কুদরত ই খুদা (3K)। আমি স্বলাভ সুলভ ভঙ্গিতেই জিজ্ঞাসা করলাম, তোর পেয়ারার দাম কত? কুদরত মাথা তুলে তাকাল। তার চিনতে একটুও ভুল হয় নি। মানুষকে মুহূর্তের মধ্যে চেনার এক ঐশ্বরিক শক্তি তার চিরকালই ছিল। কিন্তু আজ সে কেন জানি আমতা আমতা করে তোতলাচ্ছে, আপনি…। আমি ধমক দিয়ে বললাম, কি সব বলছিস? তারপর বুকটা জড়ায়ে ওকে যতই কাছে টানতে যাই, সে কেমন যেন অস্বস্তি বোধ করে। পাছে তার ময়লা গেন্জিতে আমার বিদেশী জামাকাপড় ময়লা হয়, এই ভয়ে। আমি বুঝতে পেরে তার পাশেই চটের উপর বসে পড়লাম। সে আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হলো। দুই দোস্ত পুরনো দিনগুলোতে ফিরে গেলাম। কিন্তু আজ আমি বলছি, আর কুদরত ই খুদা মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনছে।
একসময় কুদরত জিজ্ঞাসা করলো, তোর ছেলেমেয়ে কয়জন? আমি বললাম, দুই মেয়ে। বড়টা ইউনিভার্সিটিতে পড়ে, আর ছোটটা ইলেভেন গ্রেডে। তার খবর জিজ্ঞাসা করতে সে এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, ছয় মেয়ে। বড় দুজনের বিয়ে দিলেও এখনো বাকী আছে চার জন। আমি অবাক হয়ে বললাম, কস কি? তোর তো এরকম হওয়ার কথা নয়। সে এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, টেনেটুনে থার্ড ডিভিশনে মেট্রিক পাশ করার পর কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম। তুই তো চলে গেলি ঢাকা। এদিকে বিভিন্ন মেয়ের অভিভাবকরা প্রায়ই অভিযোগ নিয়ে বাড়িতে আসে। একসময় আব্বাও চিন্তা করলেন, আমাকে বরং বিয়ে দিয়ে তার ফলের ব্যবসা দেখাশোনার দায়িত্ব দিলে সকল ল্যাঠা চুকে যায়। পরিবারের পিড়াপীড়িতে একসময় বিয়ে করতে বাধ্য হলাম। স্ত্রীও আমার সম্পর্কে পাড়া প্রতিবেশিদের কাছ থেকে অনেক কিছু শুনেছিলো। তাই বছর বছর বাচ্চা নেওয়া হয়ত তার সংসারের নিরাপত্তার জন্য জরুরি ছিল। পর পর দুই মেয়ের জন্মের পর আমি ক্ষ্যান্ত দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু একটি ছেলে সন্তানের অজুহাতে সে নাছোরবান্দা। মূল উদ্দেশ্য ছিল, বেশি সন্তান থাকলে আমি আর অন্য কোন মেয়ের দিকে নজর দিতে পারব না। হলোও তাই। যার নিজের ছয় কন্যা, সে আর অন্য মেয়েদের দিকে কিভাবে তাকাবে? জীবন যুদ্ধে লড়াই করতে করতে আমি এখন অনেক ক্লান্ত। কুদরতের জীবন খোদার কুদরতে কন্যা রাশিতে ভরপুর। কিন্তু সেখানে নেই কোন রোমান্টিকতা, কোন মোহনীয়তা। সেটা এখন তিনবেলা টেনেটুনে ভাত আর আলুভর্তা। আমি তাকে সান্ত্বনা দিয়ে একসময় বিদায় নিলাম। সে কিন্তু একবারও আমাকে তার বাসায় যাওয়ার জন্য বললো না
Leave a Comment
Your email address will not be published. Required fields are marked with *