কৈ রে। জলদি খাবার দে। সখিনা চুপ করে বসে আছে। কাসিম আবার বলল, “শুনতে পারছিস না খাবার চাইছি?” সখিনা উত্তর দিলো, “কোথা থেকে খাবার দেবো? আজ সাতদিন তুমি কোনো কাজে যাওনি। ঘরে একমুঠো চালও নেই। আমি কিভাবে তোমার মুখে ভাত তুলে দিই, তুমি কি কোনদিন জানতে চেয়েছো? যা দু’পয়সা আয় করো তা গাঞ্জা গিলতে
কৈ রে। জলদি খাবার দে। সখিনা চুপ করে বসে আছে। কাসিম আবার বলল, “শুনতে পারছিস না খাবার চাইছি?” সখিনা উত্তর দিলো, “কোথা থেকে খাবার দেবো? আজ সাতদিন তুমি কোনো কাজে যাওনি। ঘরে একমুঠো চালও নেই। আমি কিভাবে তোমার মুখে ভাত তুলে দিই, তুমি কি কোনদিন জানতে চেয়েছো? যা দু’পয়সা আয় করো তা গাঞ্জা গিলতে চলে যায়। আবার সময় মতো ভাত চাইছো! লজ্জ্বা করে না তোমার? ঈদের আর সাত দিন মাত্র বাকী। ছেলে-মেয়ের একটা নতুন জামা দেওয়ার কোনো মুরোদ হয়নি তোমার। আমার হয়েছে যতো জ্বালা।” এই বলে সে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো। কাসিম লাল টকটকে চোখ জোড়া গোল্লা করে বলল, ”একমুঠো ভাত দিস বলে তোর গায়ে এতো জ্বালা? নে, তোর ভাত খাওয়া নিকুচি করি।” এই বলে থালা-বাটি-ঘটি ফেলে দিলো উঠানে।
কাসিমের দুই ছেলে, এক মেয়ে। বড় ছেলে সাজুর বয়স দশ বছর। ছোট ছেলে রাজুর বয়স সাত বছর। আর মেয়ে মিলির বয়স চার বছর। সাজু কাজ করে একটা গ্যারেজে। রাজু প্রাইমারি স্কুলে পড়ে। সাজু ওদের নিয়ে খুব স্বপ্ন দেখে। দুই ভাই বোনকে লেখাপড়া শিখাবে। অনেক বড় করবে। মনে মনে ভাবে, আমার স্বপ্ন ওদের দিয়েই পূরণ করব। মায়ের মুখে হাসি ফোটাবো। বড় হলে মাকেও আর কাজ করতে দেব না অন্যের বাসায়।
কাসিমের বউ সখিনা কাজ করে পরের বাড়িতে। কাসিম একদিন রিকসা চালালে তিনদিন বসে বসে তাস খেলে, গাঁজা টানে। সংসারের কোনো খোঁজ-খবর রাখে না। বউটা সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনি করে সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরে। নিজে না খেয়ে মালিকের বাড়ির ভাত এনে সবাই মিলে ভাগ করে খায়।
রাজু আর মিলি সারাদিন ক্ষুধার্ত পেটে বসে থাকে মায়ের পথের দিকে। কখন আসবে মা- কখন একমুঠো ভাত খেতে পারবে। অভাব অনাটনের সংসার। তাই দুজনের ভিতর ঝগড়া প্রায় লেগে থাকে। ওদের ঝগড়া শুনে আসলেন পাশের বাড়ির সাহানা ভাবী। খুবই অমায়িক মানুষ। শিক্ষকতা করেন। সময়ে- অসময়ে তাদের সাহায্য করেন। ছোট ছেলেমেয়ে দুটোকে পড়িয়ে দেন। তিনি দু’এক পা ফেলতে ফেলতে সখিনার উঠানে এসে দাঁড়ালেন। সখিনাকে জিজ্ঞেস করলেন, “কী হয়েছে সখিনা? থালা বাটির এই হাল কেন?” সখিনা উত্তর দিলো, “কী আর বলব আপা। সবই আমার কপালের দোষ। তা না হলে এমন স্বামী কপালে জুটবে ক্যান? কোন পাপের শাস্তি আল্লায় আমায় দিছে কে জানে। এর চেয়ে মরণও ভালো। আর সইতে পারিনা আপা।
সাহানাকে দেখে কাসিম ঘরের ভিতর চুপ করে রইল। সাহানা কাসিমকে জিজ্ঞেস করলো, “ছেলে- মেয়ের জন্য কী কাপড় কিনেছো কাসিম?” কাসিম কোনো উত্তর দিলো না। ছকিনা বলল, “সে কপাল কি ওরা করে আইছে বাবার হাতের জিনিস পরার? এ জীবনে আমার কিছু দেই নাই, আবার ছেলেমেয়ে।” শাহানা আপা কাশিমকে অনেকক্ষণ বোঝালেন। তিনি বললেন, “দেখ কাসিম তুমি যা করছো ঠিক করছো না। এ সংসারের দায়িত্ব তোমার। তুমি সবকিছু ছখিনার উপর ছেড়ে দিতে পারো না। তুমি অন্যায় করছো ওদের সাথে।” শাহানা উদাহরণ দিয়ে নানা ভাবে কাসিমকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন। বললেন, “আমি যা বলার তোমাকে বললাম। আর একবার ভেবে দেখো, কাজগুলো তুমি ঠিক করছো কিনা।” এই বলে তিনি চলে গেলেন।
শাহানার কথাগুলো তার বুকের ভেতর বাজতে থাকলো। কাসিম একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। কিছুক্ষণ চুপ করে বলল, “কি আর করব ছকিনা। এখন আমার শরীরটা আর চলে না।”
সখিনা রেগে বলল, “তাস খেলার সময় তোমার শরীর খারাপ করে না? গাঞ্জা টানার সময়ও তো শরীর খারাপ করতে দেখিনা। কাজ করতে গেলে তোমার যত শরীর খারাপ হয়।”
কাসিম উত্তর দিল, “শরীরটা চলে না বলেই তো বসে থাকি।” ছকিনা আরো বলল, “সংসারের প্রতি, সন্তানের প্রতি দায়িত্ব- কর্তব্য থাকলে এমনভাবে তুমি চুপ থাকতে পারতে? যে বয়সে ছেলেমেয়েরা স্কুলে যায় সেই বয়সে ছেলেকে পাঠিয়েছো গ্যারেজে। এমন হতভাগ্য বাবা তুমি। একটু বাজার করার সাধ্যও তোমার নেই।”
কাশিম সকিনার কথাগুলো চুপ করে শুনল। মনে মনে বলল, কাল থেকে সে কাজে বের হবে। যত কষ্টই হোক না কেন। কাল একটু মাছ কিনব। সত্যিই তো, ছকিনা ঠিক বলেছে। কতদিন ওদের মুখে এক টুকরা মাছ তুলে দিতে পারিনি। তাছাড়া শাহানার কথাগুলো তার বুকের ভিতর বাজতে থাকলো।
পরের দিন কাশেম রিক্সা নিয়ে বের হলো। দুইশ টাকা ভাড়া মেরে বাজারে গেল বাজার করতে। কতদিন কাশেম নিজ হাতে বাজার করেনি। তাই বাজার সম্পর্কে তার ধারণা কম ছিল। সে ভেবেছিল আজ একটু মাছ কিনবে। বাজারে যেয়ে জিনিসপত্রের দাম শুনে তার চোখ কপালে উঠে গেল। সব জিনিসের আগুনের মত দাম। তাই মাছের বাজারে আর ঢুকতে পারল না। ওই টাকা দিয়ে কোনো রকম চাল, ডাল, তেল কিনে আনলো। বাড়ি এসে দেখে ছকিনা এখনও বাড়ি ফেরেনি। ক্ষুধায় ছেলে মেয়ে দুটো পথের দিকে চেয়ে আছে মায়ের জন্য।
বাজার থেকে আসার পর কাশিমের দুশ্চিন্তার কোনো শেষ নেই। কি করে সে সংসার চালাবে। জিনিসপত্রের যে আগুনের মত দাম! না জানি সখিনা এতদিন কত কষ্ট করেছে। এমন সময় সাজু কাজ সেরে বাড়ি ফিরলো। সে বাবার চোখেমুখে দুঃচিন্তার ছাপ দেখতে পেল। বাবার কাছে যেয়ে জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে বাবা? তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন? কাসিম সাজুর কথার কোনো উত্তর দিল না। সে অপলক দৃষ্টিতে সাজুর দিকে তাকিয়ে রইল। নিজেকে আজ বড্ড অপরাধী ভাবছে সে। ছেলের দিকে তাকিয়ে তার বুকটা ব্যাথায় মোচড় দিয়ে উঠলো। কাসিম মনে মনে বলল, বাবা আমাকে ক্ষমা করিস। আমি না পারলাম তোদের মুখে ভাত দিতে, না পারলাম একটা কাপড় দিতে। যে কাজটি আজ আমার করার কথা ছিল, তুই সেই কাজটি কাঁধে তুলে নিয়েছিস। সাজুও হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে। সে ওভারটাইম করে। ওভারটাইমের টাকাগুলো খরচ না করে গুছিয়ে রাখে। সাজু তা থেকে দশ টাকা নিজের জন্য খরচ করে। আর বাকি টাকা মাটির ব্যাংকে জমা রাখে। সেটা পরিবারের কাউকে জানায় না সাজু।
সাজু ভাবলো, ব্যাংকটা ভেঙে দেখবো ঈদে সবার জন্য কিছু কিনতে পারি কিনা। গত বছর ঈদের পর থেকে এই টাকাটা খুব কষ্ট করে রেখেছে। মাঝে মাঝে কোনো কাস্টমার কাজের জন্য খুশী হয়ে বকশিস দিলে সাজু তা খরচ না করে সেটাও ব্যাংকে জমা রাখে। সে কাউকে কিছু না বলে পরের দিন সকালে মাটির ব্যাংকটা প্যাকেটে করে গ্যারেজে নিয়ে গেলো।
মাটির ব্যাংক ভেঙে টাকাগুলো গুনলো সাজু। চার হাজার আশি টাকা। তার চোখদুটো খুশিতে চকচক করে উঠলো। মায়ের কথা ভাবতেই সাজু’র চোখ থেকে পানি পড়লো। আহারে মা আমার! কত কষ্ট করে খাওয়ায়। হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে। বাপটা যে কি! মায়ের কোনদিন একটু সুখ দিতে পারলো না। আজ প্রথম সে মায়ের জন্য একটা শাড়ি কিনলো। শাড়িটা বুকের সাথে ধরে খুশিতে কেঁদে ফেলল। মনে মনে বলল, মা তোর সাজু কোনোদিন তোকে কষ্ট দেবে না। বাপ দেখে না তো কি হয়েছে? আমি তো আছি। আর কয়টা বছর দেরি কর। আমি আর একটু বড় হলে, তোকে আর পরের বাড়ি কাজ করতে দেবোনা মা।
সে বাপের জন্য একটা পাঞ্জাবি, ভাইয়ের জন্য জামা, আদরের বোন মিলির জন্য লাল ফ্রক, জুতা, ফিতা, রেশমি চুড়ি, মেহেদী কত কিছু কিনলো। সেমাই, চিনি, মুরগী সব কিনলো। এদিকে সখিনা ভেবে অস্থির। কান্নায় বুকটা তার খান খান হয়ে যাচ্ছে। রাত পোহালেই ঈদ। ছেলে-মেয়ের মুখে কিছুই তুলে দিতে পারবে না। জামাকাপড় তো দূরের কথা, একটু সেমাইও না। এমন সময় সাজু মা মা করে ডাকতে ডাকতে ঘরে ঢুকলো।
সাজুর হাতে অনেক জিনিসপত্র দেখে মা অবাক হয়ে গেলো। সখিনা সাজুকে বাজান বলে ডাকে। সখিনা জিজ্ঞেস করলো, “বাজান তোর হাতে এত সব কি? সাজু হাসিমুখে মায়ের হাতটা ধরে কাছে বসালো। শাড়িটা বের করে মাকে জড়িয়ে ধরলো। তারপর একে একে সবার জামাকাপড় বের করে দিলো। এতো টাকা কই পায়ছিস বাজান? সাজু সব কথা খুলে বলল। সখিনাও ছেলেকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে বলল, “বাজান রে তোর মতো ছেলে পাওয়া ভাগ্যের ব্যপার।” খুশীতে সাজুর চোখে, মুখে, কপালে চুমু খেতে খেতে বলল, “আল্লাহ আমার বাজানরে আমার মাথায় যতো চুল তার চেয়ে বেশি হায়াত দিক।” রাজু, মিলি খুশিতে ডগমগ হয়ে গেলো। এমন খুশীর দিন সাজু এর আগে কখনও দেখেনি। মায়ের এই খুশিভরা মুখখানা স্বর্গের চেয়েও দামী মনে হলো। কাসিম ঘর থেকে বের হয়ে সাজুকে ধরে কেঁদে ফেললো। সাজু বাবার চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বাবাকে পাঞ্জাবিটা পরিয়ে দিয়ে বলল, “আমার বাবাকে কত সুন্দর লাগছে। কাসিম সাজুকে বুকে ধরে বলল, “আমি এবার থেকে কাজ করব বাবা। তুই আমার চোখ খুলে দিয়েছিস। আমাকে তোরা মাফ করে দে। ঈদের চাঁদ সেদিন সত্যিই সখিনার আঙিনাতে নেমে এসেছিল। ওদের খুশির জোয়ার আকাশ বাতাসও মুখরিত ছিল। একটুখানি সুখ দিয়ে সেদিন কিনেছিল এক স্বর্গ পৃথিবী। সাহানা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল খুশির বন্যা। নিজের অজান্তে দু’ফোটা আনন্দাশ্রু গড়িয়ে পড়লো সাহানার চোখ থেকে।
Leave a Comment
Your email address will not be published. Required fields are marked with *