‘মুদাচ্ছেদ- ও মুদাচ্ছের’ গলা ফাটিয়ে হাঁক ছাড়ে বৃদ্ধ ছলেমান মোড়ল। তার হাঁক ডাকে আশপাশের বাড়িগুলোর ঘুমন্ত মানুষেরা জেগে ওঠে সহসা। সূর্যের আলো তখনও পৃথিবীতে এসে পৌছায়নি। মুসাল্লীরা কেউ কেউ মসজিদ থেকে বাড়ির দিকে পা বাড়িয়েছে মাত্র। ঝিকো গাছী একের পর এক খেজুর গাছে উঠে রস ভর্তি ঠিলে নিচে নামিয়ে আনতে ব্যস্ত। যে পাখির তখনও
‘মুদাচ্ছেদ- ও মুদাচ্ছের’ গলা ফাটিয়ে হাঁক ছাড়ে বৃদ্ধ ছলেমান মোড়ল। তার হাঁক ডাকে আশপাশের বাড়িগুলোর ঘুমন্ত মানুষেরা জেগে ওঠে সহসা। সূর্যের আলো তখনও পৃথিবীতে এসে পৌছায়নি। মুসাল্লীরা কেউ কেউ মসজিদ থেকে বাড়ির দিকে পা বাড়িয়েছে মাত্র। ঝিকো গাছী একের পর এক খেজুর গাছে উঠে রস ভর্তি ঠিলে নিচে নামিয়ে আনতে ব্যস্ত। যে পাখির তখনও ঘুম ভাঙেনি সেও ইতস্তত ডাল থেকে উড়ে যায় ঢুলু ঢুলু চোখে।
মুদাচ্ছের মোড়লের শরীরটা ক’দিন থেকে ভাল যাচ্ছে না। একেবারে যে খারাপ তা নয়। ঠাণ্ডা- শুকনো কাশি এই যা। বেলা বাড়ার সাথে সাথে অনেকটা ঠিক হয়ে যায়। সন্ধ্যা নামলেই বাড়ে। যাকে বলে আবহাওয়াজনিত সমস্যা। ঠাণ্ডা লাগার ভয়ে সে আজ ফজরের নামাজ বাড়িতে পড়ে সবেমাত্র কোরআন শরীফ সামনে নিয়ে বসেছিল। এমন সময় মেঝো চাচার ডাকে ঘরের বাইরে এসে দাঁড়ায়। এত ভোরে মেঝো চাচা কোনদিন এ বাড়িতে আসেনি। হঠাৎ কেন এই আগমন বুঝতে না পেরে উপর থেকে চিল্লিয়ে বলল ‘কিছু বলবে চাচা?’
‘হ্যা মুদাচ্ছের; একটা গোপন কথা আছে। একটু নিচে নেমে আয়তো।’
কী গোপন কথা এই কুয়াশা ভোরে চাচা বলতে এসেছে তা মাথায় আসে না মুদাচ্ছের মোড়লের। তবে কী তুরিন আবারো ঝামেলা শুরু করেছে! তাকে তো হিসাব মত জমাজমি সব বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে! বরং সে যা পেতো তার থেকেও বেশি দেওয়া হয়েছে। এক দাগের সোনা ফলা জমি; চাট্টিখানি কথা নয়। জমিটা নিজের কেনা ছিল। তুরিনের শ্বশুর বাড়ির কাছে বলে পৈত্রিক জমির বদলে ওই জমিটাই তাকে দিয়েছে। না হলে আইন অনুযায়ী দাগে দাগে নিতে হতো। তখন সাড়ে তিন বিঘা জমি তিতাল্লিশ খণ্ড হয়ে যেতো।
নুরুল বেঁচে থাকলে বোনকে নিয়ে এই সংকটে পড়তে হতো না। সে মুদাচ্ছের মোড়লকে অত্যাধিক সম্মান করতো। নুরুল মারা যাবার পর ছেলে-মেয়েরা তাদের ভাগের অংশ আদায় করতে উঠে পড়ে লেগেছিল। চাওয়া-পাওয়ার এই সংকটের পড়ে কবে কোনদিন এই বোনটা মুদাচ্ছের মোড়লের বাড়িতে রাত থেকেছে মনেও পড়ে না। পাছে ঘুমিয়ে থাকলে কেউ তার টিপসহি নিয়ে জায়গা জমি লিখে নেয়! অথচ এই বোনের জন্যে কী না করেছে। নুরুল একটা টেক্সটাইল মিলে চাকুরী করতো। একদিন কোন রকম পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই মিলটা বন্ধ হয়ে যায়। চার ছেলে-মেয়ে নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ে নুরুল। তখন ঢাল হয়ে দাঁড়ায় মুদাচ্ছের মোড়ল। গরুর গাড়ি ভরে চাল-ডাল- খড়িকাঠ নিয়ম করে পাঠাতো বোনের বাড়ি। বাবা তখন বেঁচে ছিল- সেও নিষেধ করেনি কোনদিন। যা এখন অতীত। সেই বোন এমন হয়ে গেল কীভাবে? তবে সে যে একা কিছু করছে না তা বুঝতে পারলেও তুরিন যে মেরুদণ্ডহীন নয় সেটা জানে মুদাচ্ছের মোড়ল। তাইতো বোনের প্রতি একটা চাপা ক্ষোভ মনের ভেতরে ঘুরে বেড়ায় যখন তখন; যা কাউকে বুঝতে দেয় না।
‘কী হলো রে মুদাচ্ছের; একটু তাড়াতাড়ি আয়।’ আবারো হাঁক ছাড়ে ছলেমান মোড়ল।
বাইরে কুয়াশা খুব; দশ হাত দূরের কিছু দেখা যায় না স্পষ্ট। বলল, ‘বাইরে তো খুব কুয়াশা- ঠাণ্ডা লাগানো বারন। তুমি যদি ওখান থেকে বলতে….’
কথা শেষ করতে পারে না মুদাচ্ছের মোড়ল। তার মুখে কথা থাকা অবস্থায় ছলেমান মোড়ল বলল, ‘নারে বাপ। একটু কষ্ট করে নিচে নেমে আয়। খুব গোপন কথা।’
‘আচ্ছা আসছি। তুমি একটু অপেক্ষা করো।’
দোতলা বাড়ি। উপর তলার উত্তর পাশের ঘরে থাকে মুদাচ্ছের মোড়ল। গায়ের চাদরটা ভালো করে গায়ে জড়িয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এসে চাচার সামনে দাঁড়ায়। বয়সের ভারে ন্যুব্জ ছলেমান মোড়লের বয়স হিসাব অনুযায়ী আশি পার হয়েছে আরো তিন বছর আগে। মুদাচ্ছের মোড়ল তার থেকে সাত বছরের ছোট। ছোট হলে কী হবে, মুদাচ্ছের মোড়ল ছিয়াত্তরের মন্বন্তরে ছলেমান মোড়লকে যেভাবে সহযোগিতা করেছিল তা বোধকরি ছলেমান মোড়ল কোনদিন ভুলতে পারবে না। মুদাচ্ছের মোড়লের অবস্থা যে খুব ভাল ছিল তাও নয়। তবে যা ছিল তা দিয়ে সময় পার হয়ে গেছে দু’পরিবারের। এখন সে ছলেমান মোড়লের স্বচ্ছলতা চোখে পড়ার মতো। দুই ছেলে বিদেশে থাকে। চাষের জমি বর্গা দিয়ে যে ফসল আসে তাতে বছর চলে যায়। বাগ বাগিচার ফল ফলাদি- সেও প্রচুর। এদিক দিয়ে অবশ্য মুদাচ্ছের মোড়ল বেশ খানিকটা উপরে। তার চার ছেলে। দুইজন বিদেশে থেকে প্রতি মাসে টাকা পাঠায় দু’হাত ভরে। একজন বাজারে দোকানদারী করে আর একজন জমিজায়গা দেখাশুনা করে বাবার সাথে।
‘এদিকে আয়’ বলে হাত ধরে মুদাচ্ছের মোড়লকে বাড়ির বাইরে নিয়ে যায় ছলেমান মোড়ল। সে উৎসুক নয়নে এদিক ওদিক তাকায়।
রাতারাতি কী এমন ঘটলো যা জানতে পারেনি মুদাচ্ছের মোড়ল! এলাকার শালিস-বিচার তো সেই করে বহুবছর ধরে। তাহলে? তবে কী তার প্রতিপক্ষরা কোন কিছু ঘটাতে চলেছে? দিনকাল ভাল না। ভাল লোকেরও শত্রুর অভাব নেই। তাছাড়া বিচার করতে যেয়ে দুই পক্ষের মন রক্ষা হয় এমনটিও নয়। কারো না কারো কাছে খারাপ হতেই হয়। তাইবলে সে আজ পর্যন্ত অন্যায়ের কাছে আপোষ করে নি। তাতে কে বেজার হলো- কে মনে কষ্ট পেল তা তার ধার ধারে না। বিভিন্ন ভাবনা মনের ভেতরে ঘুরপাক খায় মুদাচ্ছের মোড়লের।
দখিনা বাতাসে কাঁপন লাগে দু’জনের। ‘আশেপাশে কেউ নেই চাচা। তুমি বলো।’
ছলেমান মোড়ল কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘আজ কি হাটে যাবি?’
গত হাটের দিন ক্ষেতে কাজ থাকায় যাওয়া হয়নি। তিন গাড়ি নারিকেল সেভাবে গাড়িতেই সাজানো পড়ে আছে। বলল, ‘তাতো যাবোই।’
‘যাবার সময় আমাকে ডেকে নিয়ে যাস।’ বলে বাড়ি যাবার জন্যে পা বাড়ালে মুদাচ্ছের মোড়ল বলল, ‘চাচা, বললে না তো, কী বলতে চেয়েছিলে।’
ঘুরে দাঁড়ায় ছলেমান মোড়ল। বলল, ‘ওই তো- ওই কথাই। আমাকে ডেকে নিয়ে যাস তাহলে। আমি গেলাম।’
বিস্মিত মুদাচ্ছের মোড়ল বলল, ‘এই কি তোমার গোপন কথা! ওখান থেকেই তো বলতে পারতে?’
ছলেমান মোড়ল কোন উত্তর না দিয়ে হাটতে হাটতে বলল, ‘তুই যা; যাবার সময় আমাকে ডেকে নিয়ে যাস।’
চাচার কথায় মুদাচ্ছের মোড়ল হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারে না। বলল, ‘ঠিক আছে চাচা, তুমি গোছগাছ হয়ে থেকো’।
নারিকেল বিক্রি করে সরকারি গোডাউনের পাশে এসে দাঁড়িয়ে আছে মুদাচ্ছের মোড়ল। পাশের কাঠাল বাগানে বাধা গরুগুলো মুখ উঁচিয়ে চেয়ে আছে তার দিকে। ইতিমধ্যে তিনজন গাড়োয়ান এসে গাড়ির সাথে তাদের জুড়তে শুরু করে। বাঁকের দুই পাশে ছিঁয়ে পেচাতে পেচাতে মুদাচ্ছের মোড়লের পাশে এসে দাঁড়ায় ছলেমান মোড়ল। সে ধামা ভরে খেজুরের গুড়ের পাটালি নিয়ে এসেছিল। আজ যে বেপারীর কাছে পাটালি বিক্রি করেছে সে পূর্ব পরিচিত। কী কারণে পাত্রসহ নিয়ে গেছে। ঘন্টা খানেকের মধ্যে এখানে ধামা দু’টি দিয়ে যাবার কথা। হঠাৎ বাজারের ভেতরে জটলা দেখে সেদিকে এগিয়ে যায় দু’জনেই।
উৎসুক মানুষের ভীড় চোখে পড়ার মতো। কী ঘটেছে- কেন ঘটেছে ইত্যাদি। কেউ বলে চোর- কেউ বলে পকেটমার। এ ওর কাছে জানতে চায়। তীল থেকে তাল হয়। চোর থেকে ডাকাতে পরিণত হয়। প্রকৃত ঘটনা জানা কষ্টকর হয়ে যায় ততক্ষণে। ছলেমান মোড়ল পাশে দাঁড়ানো একজনের কাছে জানতে চাইলে সে জানায়, ‘উত্তম নগরের একজন গুড় বিক্রি করে কেবল লুঙির খুটে টাকাগুলো গুজেছে অমনি তা হাওয়া! ভাগ্যিস সাথের লোকটা দেখে ফেলেছিল। নাহলে কী ধরা সম্ভব হতো! কথাটা শুনে রাগ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে ছলেমান মোড়লের। সে নিজে লুঙ্গির খুট খুলে দেখে তার টাকাগুলো ঠিক আছে কী না। ঠিক আছে দেখে মুদাচ্ছের মোড়লের হাতে বাঁকটি দিয়ে বলল, ‘মুদাচ্ছের বাঁকটা একটু ধরতো; দু’ঘা দিয়ে আসি।’
‘কী বলো চাচা!’
‘মনে হলো যেন আকাশ থেকে পড়লি?’
‘আশ্চর্য; আকাশ থেকে পড়ারই কথা।’
‘কেন?’
‘তুমি নিজেই নড়তে পারো না। আবার যাচ্ছো ভীড়ের মধ্যে পকেটমারকে মারতে!’
‘বয়স হয়েছে সত্যি; বল তো আর শেষ হয়ে যায়নি। তুই দাঁড়া আমি যাবো আর আসবো।’
‘ভীড়ের মধ্যে যেয়ে আবার বিপদে না পড়ো!’
‘আমাকে নিয়ে তোর কোন চিন্তা করতে হবে না। তোর চাচাকে তুই আজও চিনতে পারলি না।’
মুদাচ্ছের মোড়ল কিছু একটা বলতে যেয়েও বলতে পারে না। তার আগেই ছলেমান মোড়ল ভীড়ের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যায়।
কিছুক্ষণ পরে দুই হাত দিয়ে নাক চেপে ধরে ফিরে আসে। এ কী; নাক দিয়ে যে রক্ত ঝরছে! মুদাচ্ছের মোড়ল হতভম্ব হয়ে বলল, ‘এ কী চাচা, এ কোন অবস্থা তোমার!’
‘আর বলিস না, আমি মারার আগেই কে যেন আমার নাক বরাবর বসিয়ে দিয়েছে।’
মুদাচ্ছের মোড়ল চাচার হাত ধরে গোপাল ডাক্তারের কাছে যাবার জন্যে পা বাড়ালে ছলেমান মোড়ল বলল, ‘একটু দাঁড়া। তোর সাথে একটা গোপন কথা আছে।’
মুদাচ্ছের মোড়ল দাঁড়ায়। বলল. ‘আবার কী কথা?’
‘কানটা একটু বাড়া।’
‘তুমি বলো. এই হাটের মধ্যে কেউ আমাদের কথা খেয়াল করবে না।’
‘অতো রিক্স নেবার কী দরকার। তুই কান বাড়া তো।’
মুদাচ্ছের মোড়ল আর কথা না বাড়িয়ে কান এগিয়ে দিলে সে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘মাইরের ব্যাপারটা ডাক্তারের কাছে গোপন রাখিস। বুঝিসতো, মান সম্মানের ব্যাপার।’
মনে মনে হাসে মুদাচ্ছের মোড়ল যা বাইরে প্রকাশ করে না; পাছে চাচা কিছু মনে করে! ইতিমধ্যে বাজারে চাউর হয়ে গেছে কে কে আহত হয়েছে, কে কে মেরেছে, কে কে মার খেয়েছে। তবে চাচার ব্যাপারটা কেউ দেখেছে কী না বুঝতে না পারলেও ডাক্তারের কাছে গোপন করা সম্ভব হবে কী না বোঝা যায় না।
Leave a Comment
Your email address will not be published. Required fields are marked with *