728 x 90

উগ্র হিন্দুত্ববাদের কবলে বাংলাদেশ

  ড. ফারুক আমিন : আঠারো এপ্রিল সন্ধ্যা সাতটা। ফরিদপুরের ডুমাইন ইউনিয়নের প্রত্যন্ত অঞ্চল পঞ্চপল্লী। এলাকাটি হিন্দু অধ্যুষিত। পঞ্চপল্লী প্রাইমারি স্কুলের পাশেই হিন্দুদের মন্দির। সন্ধ্যার সময় হঠাৎ আগুন আগুন চিতকার শোনা যায়। মানুষজন দৌড়ে এসে দেখলো মন্দিরে থাকা কালী মূর্তির পরনের শাড়িতে আগুন জ্বলছে। কেউ জানে না কে আগুন দিয়েছে অথবা কিভাবে আগুন ধরেছে। অল্প

 

ড. ফারুক আমিন : আঠারো এপ্রিল সন্ধ্যা সাতটা। ফরিদপুরের ডুমাইন ইউনিয়নের প্রত্যন্ত অঞ্চল পঞ্চপল্লী। এলাকাটি হিন্দু অধ্যুষিত। পঞ্চপল্লী প্রাইমারি স্কুলের পাশেই হিন্দুদের মন্দির। সন্ধ্যার সময় হঠাৎ আগুন আগুন চিতকার শোনা যায়। মানুষজন দৌড়ে এসে দেখলো মন্দিরে থাকা কালী মূর্তির পরনের শাড়িতে আগুন জ্বলছে। কেউ জানে না কে আগুন দিয়েছে অথবা কিভাবে আগুন ধরেছে। অল্প কিছুক্ষণ আগেই প্রতিদিনের মতো সেদিনও মন্দিরে মূর্তির সামনে সন্ধ্যাবাতি জ্বালিয়ে গিয়েছেন নিয়মিত সেবায়েত তপতী। এর কিছুক্ষণ পর এখন আগুন। উত্তেজিত জনতা পেয়ে বসলো পাশের নির্মাণাধীন স্কুলে থাকা নয়জন মুসলমান শ্রমিককে। এরা বেশ কিছুদিন যাবত স্কুলের নির্মাণ কাজ করছিলো্ এবং রাতে তারা স্কুলেই ঘুমাতো। তাদের একমাত্র অপরাধ হলো তারা মুসলমান।

স্থানীয় চেয়ারম্যান এবং মেম্বারের নেতৃত্বে হাত-পা বেঁধে নির্মম নির্যাতন করা হয় এই শ্রমিকদেরকে। খবর পেয়ে স্থানীয় থানা থেকে পুলিশ আসলে তাদেরকে অবরুদ্ধ করে রাখে হিন্দু জনতা। ইউএনও এবং ডিসি পর্যন্ত এসেও পুলিশের সহায়তায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যর্থ হয়। ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে এই নয়জন শ্রমিককে পেটানো হয়। শেষ পর্যন্ত র‍্যাব এসে গোলাগুলি চালিয়ে এই শ্রমিকদেরকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠায়। তাদের মাঝে দুই ভাই আঠারো বছর বয়সী আশরাফুল এবং পনেরো বছর বয়সী আরশাদুল আর বেঁচে নেই। তাদের আত্মীয়দের বরাতে জানা যায় এদেরকে এতো নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে যে জানাযার সময় এদের মৃতদেহকে একদিক দিয়ে ধরতে গেলে অন্যদিকে ভেঙে পড়ছিলো। নিহত এবং আহত শ্রমিকদেরকে রড এবং ইট দিয়ে পিটিয়ে হাত পা ভেঙে দেয়া হয়েছিলো। নিহত দুই ভাইয়ের মাথা থেতলে দিয়েছিলো স্থানীয় হিন্দু জনতা।

এতো ভয়াবহ একটি ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরও বাংলাদেশের পত্রিপত্রিকা এবং টিভি চ্যানেলগুলো এ নিয়ে তেমন কোন সংবাদ জানায়নি। ঘটনার পরদিন থেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে শুরু হয় প্রচন্ড সমালোচনা। শেষ পর্যন্ত তিনচারদিন পর কিছু পত্রিকা এ নিয়ে খবর প্রকাশ করে। প্রথম যথাযথ খবর প্রকাশিত হয় বাইশে এপ্রিল মানবজমিন পত্রিকায়। এরপরও বাংলাদেশের অন্যান্য প্রধান পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলগুলো এই খবর এড়িয়ে গিয়েছে অথবা কম গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করেছে।

এই ঘটনার পর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিলো ফেইসবুকে উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের প্রকাশ্য উল্লাস এবং নারকীয় সমর্থন প্রকাশ। এই ধরণের উগ্র জাতিগত ঘৃণা প্রকাশের বিষয়টি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার দেশ ভারতে নিয়মিত একটি বিষয়। কিন্তু বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যক হিন্দুও এখন উগ্র হিন্দুত্ববাদের বিষাক্ত আদর্শে আক্রান্ত হয়েছে তা এই ঘটনায় পরিস্কার দেখা গেলো।

অল্প কিছু পত্রিকায় প্রকাশিত খবর এবং স্থানীয় ফেইসবুক ব্যবহারকারীদের মন্তব্য থেকে জানা যায় স্কুলটির নির্মাণ কাজ করা ঠিকাদারের কাছ থেকে স্থানীয় হিন্দু যুবকরা চাঁদা দাবী করেছিলো। কিন্তু ঠিকাদার তাদের সেই দাবী করা চাঁদা না দেয়াতে আগে থেকেই ঝগড়া চলে আসছিলো। নিহত দুই শ্রমিক সহোদর এসব সমস্যার কারণে বিপদ থেকে বাঁচতে কাজ ছেড়ে দিয়ে নিজেদের গ্রামেও ফিরে গিয়েছিলো কিন্তু ঠিকাদার তাদেরকে বুঝিয়ে শুনিয়ে আবার নিয়ে এসেছিলো।

বাংলাদেশে যতবার সাম্প্রদায়িক সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে, প্রতিটি ঘটনাতেই দেখা যায় রহস্যজনক কোন প্রেক্ষাপট থাকে যার কোন সুরাহা হয় না। তারপর যখন কোন মন্দির ভাংচুর হয় তখন বাংলাদেশের প্রগতিশীল নামে পরিচিত লোকজন সারা বিশ্বজুড়ে প্রচারণা চালায়। তারা প্রোপাগান্ডা চালিয়ে বলতে চায় বাংলাদেশের মুসলিমরা উগ্র এবং অসহিষ্ণু। অথচ যখন দুইজন মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করা হলো, এখানে যেহেতু তাদের সেই সাম্প্রদায়িক প্রচারণার সুযোগ নেই, এ কারণে তারা নিশ্চুপ। বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মের মানুষ যদি উগ্র হতো তাহলে এই দেশে নিশ্চিতভাবেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হতো। অথচা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনা বারবার ঘটে তথাকথিত বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ ভারতে। ভারতের উগ্রপন্থী হিন্দু জনতার হাতে মুসলিম হত্যা এবং নিপীড়ন একটি নিয়মিত ঘটনা। সেই উগ্রপন্থী স্বভাব বাংলাদেশের হিন্দুদের মাঝেও সংক্রামিত হয়েছে। প্রতিবেশী ভারতের এই জঘন্যতম প্রকৃতি থেকে বাংলাদেশের সমাজকে রক্ষা করতে হলে এবং বাংলাদেশের ঐতিহাসিক ধর্মীয় সম্প্রীতিকে টিকিয়ে রাখতে হলে যেখানে সরকারের দায়িত্বশীল ভূমিকা সবচেয়ে জরুরী, দুঃখজনকভাবে আওয়ামী লীগ সরকার তা না করে বরং সাম্প্রদায়িকতার গুটি ব্যবহার করেই তাদের ক্ষমতায় থাকতে চায়, এতেও এখন আর কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। সুতরাং বাংলাদেশের শান্তিপ্রিয় এবং সংহতি-প্রত্যাশী মানুষদেরকেই এখন সচেতন হতে হবে।

বাংলাদেশে হিন্দুত্ববাদীদের প্রতিহিংসামূলক প্রভাব এবং কাজকর্ম মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়ছে এটি ফরিদপুরের এই ঘটনার পাশাপাশি চলমান আরো অনেক ঘটনা থেকে পরিস্কার বুঝা যায়। অতি সম্প্রতি বিগত রমজান মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররা ইফতার মাহফিলের আয়োজন করলে তা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কতৃপক্ষের গাত্রদাহ শুরু হয়। তারা আয়োজনকারী ছাত্ররা বেশিরভাগ যে বিভাগের ছাত্র, সেই বিভাগের চেয়ারম্যানকে কারণ দর্শাও নোটিশ পাঠায়। চলমান গরম এবং অসহনীয় আবহাওয়ার কারণে সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাই ইসতেসক্বার নামাজের আয়োজন করতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় কতৃপক্ষ সে নামাজ পড়ার অনুমতি দেয়নি।

আওয়ামী লীগের শাসনকালে পুলিশ, সামরিক বাহিনী, সরকারী চাকরি সহ সকল ক্ষেত্রে হিন্দুদেরকে বৈষম্যমূলকভাবে অতিমাত্রায় নিয়োগ দেয়ার বিষয়টি এখন প্রমাণিত সত্য। যেসব সমাজে ধর্মীয় বৈষম্য ঘটে, সেখানে সাধারণত ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা সে বৈষম্যের শিকার হয়। কিন্তু বাংলাদেশে প্রতিবেশী ভারতের আধিপত্যবাদ এবং তাদের এদেশীয় দালালদের কারণে এ বৈষম্যগুলো হচ্ছে পুরোপুরি বিপরীত। তবে প্রকৃতিগতভাবে এবং ঐতিহাসিকভাবেই বাংলাদেমের মুসলমানরা ধর্মীয় সম্প্রীতির চর্চা করেছে এবং কোন সংঘাত ছাড়া দশকের পর দশক নিজ ধর্মের চর্চা করেছে। বর্তমানে ক্ষমতার জন্য যখন পরিকল্পিতভাবে দেশের মানুষকে ধর্মীয় সহিংসতার দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে তখন সংখ্যাগুরু হিসেবে মুসলমানদেরকে ধৈর্য্যের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করতে হবে। ধর্মীয় কারণে দেশে যে কোন সংঘাতের ঘটনা ঘটলেই সামগ্রিকভাবে তার দোষ মুসলমানদেরা বহন করতে বাধ্য হবে। পাশাপাশি উগ্র হিন্দুত্ববাদী পক্ষ এবং তাদের ভৃত্য এদেশীয় মুসলমান নামধারী দালালদের প্রোপাগান্ডা মেকানিজম এই উদ্দেশ্য পূরণে দীর্ঘদিন যাবত কাজ করে আসছে। যখন সমাজে ক্ষমতাবান শক্তি নিজেরাই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় তখন সাধারণ মানুষের দায়িত্ব অযাচিতভাবেই অনেক বেড়ে যায়। বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি চর্চা, নিজ নিজ ধর্ম স্বাধীনভাবে পালনের অধিকার এবং যথাযথ মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য গণতান্ত্রিক রাজনীতির প্রতিষ্ঠা ছাড়া অন্য কোন বিকল্প নেই। ফ্যাসিবাদী ষড়যন্ত্রকারী এবং পার্শ্ববর্তী দেশের গোলামরা যতদিন ক্ষমতা দখল করে রাখবে ততদিন তারা নিজেদের ডিভাইড এন্ড রুল পলিসির কারণেই সাম্প্রদায়িক সমস্ত সংঘাতে উসকানি দিয়ে যাবে, এই সংঘাতের বলি হবে এই পক্ষ এবং ও পক্ষ দুই পক্ষেরই সাধারণ মানুষজন; তাদের প্রাণ, সম্পদ ও নিরাপত্তা।

Read More

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked with *

সর্বশেষ পোস্ট

Advertising