পূর্ব প্রকাশের পর-
-মেজোভাই।
-আপনার নামটা আরেকবার বলুন তো?
-রোজি।
-আই সি!
-আপনি কি আমার বাবাকে চেনেন?
-শুধু আপনার বাবাকে নয়। আপনার মেজোভাই আমার ক্লাসমেট। যুদ্ধের আগে আমি আপনাদের বাসায় অনেকবার গিয়েছি।
-আপনাকেও আমার কেমন চেনা চেনা হনে হচ্ছে।
-এখন তো তাই মনে হওয়াই স্বাভাবিক। আচ্ছা, আপনাদের পাশের বাসায় আলি আরমান নামে আরেকটি ছেলে ছিলো। সে আমাদের সাথে পড়তো। খুব ব্রিলিয়ান্ট ছেলে। ওর বাবাও ডাক্তার ছিল। ওকে চিনতেন?
রোজির চোখ আনন্দে চকচক করে ওঠে। অফিসার তাদের পরিচিত জেনে বুকে সাহস জন্মায়। রোজি ভারিকণ্ঠে বলে, আপনি যার খোজ করতে এসেছেন, তিনিই সেই লোক।
-হোয়াট! অফিসারের চোখ কেমন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায়। রোজিকে মাথা নিচুকরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলে, সে তো মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিল, তাই না?
-হাঁ।
-ওর কোনো ছবি আছে?
-আছে।
-প্লিজ একটু দেখাতে পারবেন?
রোজি টেবিলের ড্রয়ার খুলে একটা গ্রুপ ছবি বের করে আনে। ছবিটা দেখে অফিসার নিঃসন্দেহ হয়। ছবিটা রোজির হাতে ফিরিয়ে দিতে দিতে বলে, আমি বুঝতে পাছি না, আরমান এমন একটা কাজের সাথে জড়িয়ে পড়লো কি করে।
-আপনার মতো জিজ্ঞাসাটা আমারও।
-এই ছবিতে যারা আছে, তাদের সবাইকে আপনি চেনেন?
-না। তবে এখন মনে হচ্ছে ওদের দলে আপনিও আছেন।
-ঠিক বলেছেন। আমি আরমানের শুধু বন্ধু ছিলাম না। সে আমার সহযোদ্ধাও ছিল। আচ্ছা ভাবী, আরমান কোথায় আছে সত্যিই কি আপনি জানেন না?
-না। আমি খুব কষ্টে আছি। সে কোথায় আছে, কেমন আছে, না জানতে পেরেই আরও বেশি কষ্টে আছি।
-ঠিক আছে। যদি তার সাথে আপনার কোনো যোগাযোগ হয়, তাহলে আমার কথা তাকে বলবেন। সে যেন আমার সাথে যোগাযোগ করে। আমি যতদূর তাকে চিনি, সে এমন কাজ করতে পারে না। বাই দ্য ওয়ে, পারলে কালই আপনি এই বাসা ছেড়ে আপনার বাবার বাড়িতে চলে যাবেন। এখানে আপনার একা থাকা দরকার নেই।
-আপনি ওর কেসটাকে-
-সে আমি দেখবো। আরমানকে আমি খুব ভালো চিনি। তাকে বলবেন আমার দিক থেকে কোনো ত্রুটি থাকবে না।
-যদি কিছু মনে না করেন, আপনাকে কি এক কাপ চা-
-আজ না। অন্য একদিন আসবো।
পুলিশ অফিসার আর বসলো না। কথা শেষ করে চলে গেলো। রোজি দরোজা বন্ধ করে চুপচাপ কিছুক্ষণ বসে রইল। তার চিন্তার ক্ষেত্র ক্ষণে ক্ষণে পরিবর্তন হচ্ছিল। বিশেষ করে আরমান কেন তার সাথে যোগাযোগ করছে না, এই বিষয়টা তাকে বেশি ভাবিত করছিল।
বাসায় আসতে না পারে না আসুক। টেলিফোনেও তো খবরা খবর আদান প্রদান করতে পারে। তাও করছে না। তাহলে কি আরমান তাকে এ্যাভয়েড করতে চাইছে?
তা করবে কেন? কি আমার অপরাধ। আমিতো এমন কিছুই করিনি যার জন্য সে আমাকে ত্যাগ করবে?
সেদিনকার সেই ঝগড়ার কথা মনে করে আপন মনেই বলে, ওরকম ঝগড়াঝাটি কোন সংসারে না হয়। সাব্বিরকে সে সন্দেহ করে। না না, আগে সে ভুল বুঝলেও পরে তো তার সে ভুল ভেঙ্গে গেছে। সাব্বির শুধু আমার কলিগ নয়, সে আমার কাজিন। আপন খালাতো ভাই। তার সাথে প্রেম ভালোবাসার সম্পর্ক নয়, রক্তের সম্পর্ক।
১৬.
বেশ কদিন হয়ে গেছে আরমান চিটাগাং এসেছে। ফালু মামার বাসায় আছে। খাচ্ছে আর ঘুমুচ্ছে। কাজ তো নেই । ভয়ে ঘরের বাইরেও তেমন একটা বের হয় না। চার দেওয়ালে বন্দি হয়ে একা একা ছটফট করে। মাঝে মাঝে ভাবে রোজিকে একটা চিঠি লেখে। তার অবস্থান রোজিকে জানিয়ে দেয়। কিন্তু ওই পর্যন্তই, লেখা আর হয়ে ওঠে না। মনের ইচ্ছাটা আপনা থেকেই মনের মাঝে কেন জানি মরে যায়। যখনই রোজির পাশে সাব্বিরের মুখটা ভেসে ওঠে। ভেসে ওঠে নিউমার্কেটে ওদের দুজনের রিকসায় ওঠার দৃশ্যটা।
আজ সকালেও খবরের কাগজ পড়ার জন্য আরমান ওপর থেকে নিচে নেমে আসে। ড্রয়িংরুমে ফালু মামার মুখোমুখি হয়ে যায়। আরমানকে দেখে ফালু মামা জিজ্ঞাসা করে, কি হে ছোকরা, এখানে তোমার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো?
-না মামা, অসুবিধা হবে কেন। ভালোই তো রাজার হালে খাচ্ছি আর ঘুমুচ্ছি। তবে ঢাকার অবস্থা ঠিক মতো জানতে না পেরে মনটা বড্ড উতলা হয়ে উঠছে।
-হুম। গোলাম মাওলা ফোন করেছিল। জানতে চাইছিল, তুমি কেমন আছ? আমি বললাম, তুমি ভালো আছ। ওর কাছ থেকেই জানতে পারলাম তোমাদের কেসটার জোর তদন্ত চলছে। পুলিশ কয়েকজনকে এ্যারেস্ট করেছে। মিনিস্টারের সাথে কথা বললাম।
-কি বললেন তিনি?
-বন্ধু মানুষ তো, রঙ তামাশার কথাই বললাম বেশি। তার কথায় বুঝলাম, সে তোমাকে পছন্দই করে। সাবধান করে দিলো এই মুহূর্তে তোমাকে যেন ঢাকায় যেতে না দিই। অবস্থা স্বাভাবিক হলে সে-ই তোমাকে নিয়ে যাবে।
ফালু মামার কথায় আরমানের মনটা আরও দমে যায়। মামা তা বুঝতে পারে। তাই সান্ত্বনা দেয়, মন খারাপ করে কি করবা। ঝামেলায় যখন জড়িয়েছ, তখন মাথা ঠান্ডা রেখে সবদিক সামাল দিয়ে চলাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ।
-কিন্তু এইভাবে শুয়ে বসে থাকতেও তো ভালো লাগে না। কোনো কাজ কাম থাকলে তবুও-
ফালুমামা তৎক্ষণাৎ কিছু বলেন না। নীরবে খবরের কাগজে চোখ বুলিয়ে যান। আরমানও আর কিছু বলার সুযোগ পায় না। বেশ কিছুক্ষণ নিঃশব্দে কাটার পর মামা বলেন, তাহলে এক কাজ করো। আমার নাতীটাকে একটু লেখাপড়ায় সাহায্য কর, পারবে না?
-কাকে? টোটনকে?
-হাঁ।
-তা পারবো না কেন?
-তাহলে আপাতত তাই কর। আর আমি দেখছি তোমার জন্য কি করতে পারি। মামা আবার কাগজের পাতায় ডুবে যায়।
আরমানও আর কথা না বাড়িয়ে নীরবে খবরের কাগজে চোখ বোলাতে শুরু করে। তারপর নির্দিষ্ট সময়ে যে যার কাজে চলে যায়। তবে সেইদিন থেকেই টোটনকে পড়াতে শুর করে। কাজটা সে খুব মনেযোগ দিয়েই করে। কারণ, ফ্রি বসে খাওয়ার চেয়ে কিছু একটা করে খাওয়াতে আরমানকে কিছুটা স্বস্তি দেয়।
ছোট্ট ছেলে টোটোন। ক্লাস সেভেনে পড়ে। গায়ের রং ফর্সা। মুখটা লম্বাটে। চোখ দুটো বেশ বুদ্ধিদীপ্ত। বয়সের তুলনায় বেশি স্মার্ট। পড়াশোনায় মনোযোগী। কোনো বিষয়ে একবারের বেশি দুবার রিপিট করতে হয় না।
দু’চার দিনেই মাষ্টার আর ছাত্রের মাঝে একটা প্রীতিমধুর সম্পর্ক তৈরী হয়ে যায়। টোটোন সবসময় কাছে পিঠে থাকায় এখন আর আগের মতো নিঃসঙ্গ বোধ হয় না। ইদানীং সে আরেকটা জিনিস খেয়াল করেছে। তা হলো, মাঝে মাঝে শ্বেতবসনা এক মহিলাকে পাশের ঘরের জানালায় এসে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। প্রথম প্রথম দু’চার দিন মহিলার ওপরে চোখ পড়লে আরমান দ্রুত চোখ সরিয়ে নিয়েছে। না দেখার ভান করে নীরবে পাঠদান অথবা গল্পের আসর মাৎ করেছে।
মহিলা যেমন নীরবে এসে জানালায় দাঁড়ায়, তেমনি আবার নিঃশব্দে সরে যায়। কখনো সখনো ক্ষণেকের জন্য চার চোখের মিলন হয়। কখনো হয়না। তবে আলাপ পরিয়ের পর্যায়ে গড়ায়নি। এভাবেই কেটে গেছে মাস খানেক। সময়ের গতিময়তার সাথে সাথে আরমান জেনেছে মহিলা আর কেউ নয় টোটোনের বিধবা মা। দু’বছর আগে রোড এক্সসিডেন্টে টোটোনের বাবা মারা গেছে। এখন তারা মা-বেটা নানা বাড়িতে থাকে।
তারপর সময়ের চাকা যেমন ঘুরে দিন থেকে সপ্তাহ, সপ্তাহ থেকে মাসের পথে এগিয়ে যায়, তেমনি দুটো অপরিচিত নর-নারী ধীরে ধীরে দু’একটা প্রয়োজনীয় কথাবার্তার মাঝে একদিন পরিচিত হয়ে ওঠে। এই যেমন আজ টোটোন তার স্যারের কাছে পড়ছিল, টোটোনের মা নাস্তার ট্রে নিয়ে এলো, টেবিলের ওপরে রেখে ছেলের উদ্দেশ্যে বলল, টোটোন তোমার মাষ্টার সাহেবকে নাস্তা খেয়ে নিতে বলো। আর তুমি ভেতরে চলে এসো।
টোটোন মুখে কিছু না বলে স্যারের দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেই স্যার বলেন, যাও।
আরমানের কথা শেষ হওয়ার আগেই টোটোন উঠে দাঁড়ায়। আর টোটোনের মা ততক্ষণে গোবরাট পেরিয়ে যাওয়ার জন্য বাইরে এক পা ফেলেছে। আরমান খেয়াল করেছে, মহিলা যখন এঘর ছেড়ে চলে যায় তখন একবারও পেছন ফিরে তাকায় না। এই নিয়ে আরমান অনেককিছু ভেবেছে। মহিলার এই নির্বিকার চলাফেরা আরমানের মনে অসংখ্য প্রশ্নের জন্ম দিলেও সে মুখ ফুটে কখনো তা প্রকাশ করেনি। এমন কি সমবেদনা জানাতেও নয়।
এভাবেই কেটে যায় প্রায় তিন মাস। সেদিন বিকেল বেলা আরমান নিজের রুমে বসে একটা সাপ্তাহিক পত্রিকার পাতা ওলটাচ্ছিল। হঠাৎ সেখানে হাজির হলো টোটোনের মা। সে ঘরের ভেতরে এলো না। ঘরের চৌকাঠ ধরে দাঁড়িয়ে ভেতরে উকি দিলো। গলা খ্যাকারি দিয়ে তার আগমন বার্তা জানালো।
আরমান পত্রিকার পাতা থেকে চোখ সরিয়ে দরোজার দিকে তাকালো। টোটোনের মাকে দরোজায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে যতটা না বিস্মীত হলো, তার চেয়ে বেশি আত্মসচেতন হয়ে উঠলো। নিচুস্বরে জিজ্ঞাসা করল, কিছু বলবেন?
মহিলা ফিক করে হেসে বলল, নিশ্চয়ই। কিছু বলার জন্যই তো এসেছি। কারণ, আপনি তো ধনুক ভাঙ্গা পণ করেছেন, আগে আমার সাথে কথা বলবেন না।
-অযথা গায়ে পড়ে আলাপ জমাতে গেলে তো বিরক্ত হতেও পারেন। তাই-
চলবে…