728 x 90

হিজরী নববর্ষ ও আশুরা

ইমাম হোসেন ইকবাল : আসমানসমূহ ও পৃথিবী সৃষ্টির শুরু থেকেই আল্লাহ তায়ালার বিধানে মাসের সংখ্যা বারোটি, এ (বারোটির) – মধ্যে চারটি হচ্ছে যুদ্ধ -বিগ্রহের জন্য নিষিদ্ধ মাস; এটা (আল্লাহর প্রণীত) নির্ভুল ব্যবস্থা। সুরা-৯ তাওবা, আয়াত: ৩৬) মুসলমানদের স্বতন্ত্র বর্ষপঞ্জির নাম হিজরি বর্ষপঞ্জি বা হিজরি সন। একমাত্র হিজরি সনই বর্তমান বিশ্বের সব তাওহিদবাদী জনতার কাছে সমানভাবে

ইমাম হোসেন ইকবাল : আসমানসমূহ ও পৃথিবী সৃষ্টির শুরু থেকেই আল্লাহ তায়ালার বিধানে মাসের সংখ্যা বারোটি, এ (বারোটির) – মধ্যে চারটি হচ্ছে যুদ্ধ -বিগ্রহের জন্য নিষিদ্ধ মাস; এটা (আল্লাহর প্রণীত) নির্ভুল ব্যবস্থা। সুরা-৯ তাওবা, আয়াত: ৩৬) মুসলমানদের স্বতন্ত্র বর্ষপঞ্জির নাম হিজরি বর্ষপঞ্জি বা হিজরি সন। একমাত্র হিজরি সনই বর্তমান বিশ্বের সব তাওহিদবাদী জনতার কাছে সমানভাবে সমাদৃত, অতি পবিত্র, মহিমান্বিত ও মর্যাদাপূর্ণ বর্ষপঞ্জি। হিজরি সনের সম্পর্ক চন্দ্রের সাথে। আমরা জানি, পৃথিবীতে বর্ষ গণনার দুটো ধারা প্রচলিত আছে। যার একটির সম্পর্ক সূর্যের গতির সাথে, আর অন্যটির সম্পর্ক চাঁদের গতির সাথে। প্রথমটির নাম সৌরবর্ষ আর দ্বিতীয়টির নাম চন্দ্রবর্ষ। এই দুটো সালের মধ্যে প্রতি বছর ব্যবধান হয় ১০ কিংবা ১১ দিনের। সৌর সনের বছর হয় মোটামুটি ৩৬৫ দিনে, আর চন্দ্র সনের বছর হয় ৩৫৪ দিনে। সূর্যের চারদিকে পৃথিবীর আবর্তনের সময়কালকে সৌরবর্ষ এবং পৃথিবীর চারদিকে চাঁদের আবর্তনের সময়কালকে চান্দ্রবর্ষ বলা হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘ সূর্য ও চন্দ্র উভয়ই নির্ধারিত হিসাব মোতাবেক (অবিরাম কক্ষপথ ধরে) চলছে ।’ (সুরা-৫৫ রহমান, আয়াত: ৫)
বিশ্বের কোটি মুসলমানের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও জীবনধারার সাথে মিশে আছে হিজরি সন। মুসলমানরা ফরজ বিধান পালনে ও নানা আচার-উৎসব উদযাপনের ক্ষেত্রে হিজরি সন তথা চন্দ্র মাসকে অনুসরণ করে থাকে। চাঁদের উদয়ের ভিত্তিতে মুসলমানদের ইবাদত ও ধর্মীয় বিভিন্ন দিনক্ষণ নির্ধারিত হয়। মুসলিম বিশ্বে চাঁদের হিসাবে অনেক ইবাদত-বন্দেগি, আমল-অনুশাসন পালিত হওয়ায় হিজরি সনের পবিত্র মাহাত্ম্য ও প্রাচুর্য প্রত্যেক মুসলিমের অন্তরজুড়ে সমানভাবে বিশেষ মর্যাদায় সমাসীন রয়েছে। মহররম, সফর, রবিউল আউয়াল, রবিউস সানি, জমাদিউল আওয়াল, জমাদিউস সানি, রজব, শাবান, রমজান, শাওয়াল, জিলকদ, জিলহজ- এই ১২ মাস নিয়ে হিজরি সন।
মুহাররাম মাস ইসলামী পঞ্জিকার প্রথম মাস। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সময়ে ও তার পূর্বে রোমান, পারসিয়ান ও অন্যান্য জাতির মধ্যে তাদের নিজস্ব ক্যালেন্ডার বা পঞ্জিকা প্রচলিত ছিল। আরবদের মধ্যে কোনো নির্ধারিত বর্ষ গণনা পদ্ধতি ছিল না। বিভিন্ন ঘটনার উপর নির্ভর করে তারিখ বলা হতো। যেমন, অমুক ঘটনার অত বৎসর পরে…। খলীফা উমারের (রা) খিলাফতের তৃতীয় বা চতুর্থ বৎসর আবূ মূসা আশআরী (রা) তাঁকে পত্র লিখে জানান যে, আপনার সরকারি ফরমানগুলিতে সন-তারিখ না থাকায় প্রশাসনিক জটিলতা দেখা দেয়; এজন্য একটি বর্ষপঞ্জি ব্যবহার প্রয়োজন। খলীফা উমার (রা) সাহাবিগণকে একত্রিত করে পরামর্শ চান। কেউ কেউ রোম বা পারস্যের পঞ্জিকা ব্যবহার করতে পরামর্শ দেন। কিন্তু অন্যরা তা অপছন্দ করেন এবং মুসলিমদের জন্য নিজস্ব পঞ্জিকার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন। এ বিষয়ে কেউ কেউ পরামর্শ দেন যে, রাসূলুল্লাহ ( সা.)-এর মিলাদ বা জন্ম থেকে সাল গণনা শুরু করা হোক। কেউ কেউ তাঁর নবুয়ত থেকে, কেউ কেউ তাঁর হিজরত থেকে এবং কেউ কেউ তাঁর ওফাত থেকে বর্ষ গণনার পরামর্শ দেন। হযরত আলী (রা) হিজরত থেকে সাল গণনার পক্ষে জোরালো পরামর্শ দেন। খলীফা উমার (রা) এ মত সমর্থন করে বলেন যে, হিজরতই হক্ক ও বাতিলের মধ্যে পার্থক্যের সূচনা করে; এজন্য আমাদের হিজরত থেকেই সাল গণনা শুরু করা উচিত । অবশেষে সাহাবীগণ হিজরত থেকে সাল গণনার বিষয়ে একমত পোষণ করেন।
কোন্ মাস থেকে বর্ষ গণনা শুরু করতে হবে সে বিষয়ে পরামর্শ চাওয়া হয়। কেউ কেউ রবিউল আউয়াল মাসকে বৎসরের প্রথম মাস হিসেবে গ্রহণ করার পরামর্শ দেন; কারণ রাসূলুল্লাহ (সা.) এ মাসেই হিজরত করে মদিনায় আগমন করেন। ১২ই রবিউল আউয়াল তিনি মদিনায় পৌঁছান। কেউ কেউ রামাদান থেকে বর্ষ শুরুর পরামর্শ দেন; কারণ রামাদান মাসে আল্লাহ কুরআন নাজিল করেছেন।
সর্বশেষ তাঁরা মুহাররাম মাস থেকে বর্ষ শুরুর বিষয়ে একমত হন; কারণ এ মাসটি ৪টি ‘হারাম’ বা সম্মানিত মাসের একটি। এছাড়া ইসলামের সর্বশেষ রুকন হজ্জ পালন করে মুসলিমগণ এ মাসেই দেশে ফিরেন। হজ্জ পালনকে বৎসরের সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ কর্ম ধরে মুহার্রাম মাসকে নতুন বৎসরের শুরু বলে গণ্য করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এভাবে রাসূলুল্লাহ -এর ইন্তেকালের প্রায় ৬ বৎসর পরে ১৬ বা ১৭ হিজরী সাল থেকে সাহাবীগণের ঐকমত্যের ভিত্তিতে হিজরী সাল গণনা শুরু হয়। যদিও হিজরত রবিউল আউয়াল মাসে সংঘটিত হয়, তবুও দুমাস এগিয়ে, সে বৎসরের মুহার্রাম থেকে বর্ষ গণনা শুরু হয়।’ (তাবারী, আত-তারীখ ২/৩-৪; ইবনুল জাওযী, আল-মনতাযিম ২/১।)
অত্যন্ত দুঃখজনক বিষয় যে, আমরা বাংলাদেশের অধিকাংশ মুসলিম আমাদের ধর্মীয় এ পঞ্জিকার বিষয়ে কোনোই খোঁজ রাখি না। এমনকি আজ কত হিজরী সাল তা অধিকাংশ ধার্মিক মুসলিম বলতে পারবেন না । আমরা যে ‘ইংরেজি সাল’ ব্যবহার করি তা মোটেও ‘ইংরেজি’ নয়; বরং তা খৃস্টধর্মীয়। যীশুখৃস্টের প্রায় ১৬০০ বৎসর পরে ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে পোপ অষ্টম গ্রেগরী তৎকালে প্রচলিত প্রাচীন রোমান জুলিয়ান ক্যালেন্ডার (Julian calendar) সংশোধন করে যীশুখৃস্টের জন্মকে সাল গণনার শুরু ধরে এ পঞ্জিকা প্রচলন করেন, যা গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার ( Gregorian calendar) ও খৃস্টীয়ান ক্যালেন্ডার (Christian calendar) নামে পরিচিত। যীশুখৃস্টকে প্রভু ও উপাস্য হিসেবে বিশ্বাসের ভিত্তিতে এতে বৎসরকে বলা হয় আন্নো ডোমিনি (anno domini) বা এ. ডি. (AD)। এর অর্থ আমাদের প্রভুর বৎসরে (in the year of our Lord)। শুধু জাগতিক প্রয়োজনেই নয়, জীবনের সকল কিছুই আমরা এ খৃস্টধর্মীয় পঞ্জিকা অনুসারে পালন করি। আল্লাহ আমাদেরকে ক্ষমা করুন ও সঠিক পথে পরিচালিত করুন ।
ইসলামী পঞ্জিকা অনুসারে আমরা একটি নতুন বৎসর শুরু করেছি। নতুনের মধ্যে আমরা পরিবর্তনের আশা ও কামনা অনুভব করে আনন্দিত হই। তবে আমাদের বুঝতে হবে যে, মানুষের জীবনে প্রতিটি দিনই নবজীবন। মহান আল্লাহ বলেন : “তিনিই রাত্রিকালে তোমাদের মৃত্যু ঘটান এবং দিনে তোমরা যা কর তিনি তা জানেন। অতঃপর তিনি তোমাদেরকে দিনে পুনরায় জাগিয়ে তোলেন যাতে নির্দিষ্ট মেয়াদ পূর্ণ হয়।’ (সূরা আনআম: ৬০ আয়াত)
এজন্য রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন যে, প্রতিদিন ভোরে মহান আল্লাহর দরবারে হৃদয় নিংড়ানো কৃতজ্ঞতা ও শুকরিয়া জানিয়ে, পরিবর্তনের আকুতি ও সফলতা ও বরকতের প্রার্থনা করে নতুন জীবনের শুরু করতে হবে। আর প্রতিদিন শয়নের সময় ক্ষমা ও রহমতের প্রার্থনা করে মহান আল্লাহর করুণাময় আয়ত্তে নিজের আত্মাকে সমর্পণের দুআ পাঠের সাথে ঘুমিয়ে পড়তে হবে ।
আমরা অনেকে নববর্ষের শুভেচ্ছা বা শুভ কামনা জানাই। বস্তুত কামনা বা শুভেচ্ছা নয়, দুয়া হলো ইসলামি রীতি। শুভেচ্ছা অর্থ আমাদের মনের ভাল ইচ্ছা। আর মানুষের কামনা বা ইচ্ছার মূল্য কী? মূল্য তো মহান আল্লাহর ইচ্ছার । এজন্য তাঁর দরবারে দুয়া করতে হবে নতুন বছরের সফলতার জন্য। এছাড়া অন্তঃসারশূন্য ইচ্ছা বা কামনা কোনো পরিবর্তন আনে না; বরং পরিবর্তনের সুদৃঢ় সংকল্প, নতুন বছরকে নতুনভাবে গড়ার সুদৃঢ় ইচ্ছা ও কর্মই পরিবর্তন আনে। কুরআন ও হাদিসের নির্দেশনা থেকে আমরা জানি যে, সৃষ্টির সেবা ও মানুষের উপকারই জাগতিক জীবনে মহান আল্লাহর রহমত ও বরকত লাভের অন্যতম উপায়। অনুরূপভাবে মানুষের ক্ষতি করা বা ব্যক্তি বা সমাজের অধিকার নষ্ট করা আল্লাহর গজব ও শাস্তি লাভের অন্যতম কারণ। আসুন আমরা সকলে মহান আল্লাহর নির্দেশ মত তাঁর ইবাদাত ও আনুগত্যের মাধ্যমে, মানুষের অধিকার আদায় ও ক্ষতি থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে নতুন বছরের সূচনা করি । মহান আল্লাহ আমাদের তাওফীক দিন।
মুহাররাম মাস “হারাম” মাসগুলির অন্যতম। ইসলামি শরীয়তে যুলকাদ, জিলহজ, মুহার্রাম ও রজব- এ ৪টি মাসকে বিশেষ মর্যাদা প্রদান করা হয়েছে। এগুলি ‘হারাম’ অর্থাৎ ‘নিষিদ্ধ’ বা ‘সম্মানিত’ মাস বলে পরিচিত। এ সকল মাসে সকল প্রকার পাপ ও অন্যায় থেকে বিরত থাকতে ও অধিক নেক আমল করতে নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে কুরআন ও হাদিসে। এ ৪ মাসের মধ্যে মুহার্রাম মাসকে বিশেষভাবে মর্যাদা প্রদান করে একে ‘আল্লাহর মাস’ বলে আখ্যায়িত করেছেন রাসূলুল্লাহ (সা.)। হাদিস থেকে আমরা জানতে পারি যে, মুহাররাম মাসের নফল রোযার সাওয়াব অন্য সকল নফল রোযার সাওয়াবের চেয়ে বেশি। এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ বলেন: জাতিকে নিমজ্জিত করেন। এজন্য মূসা কৃতজ্ঞতা-স্বরূপ এ দিন সিয়াম পালন করেন। তাই আমরা এ দিন সিয়াম পালন করি। তখন রাসূলুল্লাহ বলেন, মূসার (আ) বিষয়ে আমাদের অধিকার বেশি এরপর তিনি এ দিবস সিয়াম পালন করেন এবং সিয়াম পালন করতে নির্দেশ প্রদান করেন । ” (বুখারী, আস-সহীহ, ২/৭০৪, ৪/১৭২২; মুসলিম, আস-সহীহ ২/৭৯৬)রামাদানের সিয়াম ফরজ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত আশুরার সিয়াম ফরজ ছিল। রামাদানের সিয়াম ফরজ হওয়ার পর আশুরার সিয়াম মুস্তাহাব পর্যায়ের ঐচ্ছিক ইবাদাত বলে গণ্য করা হয় । তা পালন না করলে কোনো গোনাহ হবে না, তবে পালন করলে রয়েছে অফুরন্ত সাওয়াব। রাসূলুল্লাহ বলেন: “আমি আশা করি, আশুরার সিয়াম-এর কারণে আল্লাহ পূর্ববর্তী বৎসরের কাফ্ফারা করবেন।’ (‘মুসলিম, আস-সহীহ ২/৮১৮।)
অন্য একটি কারণে ‘আশুরা’ মুসলিম উম্মাহর মধ্যে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে, তা হলো কারবালার ঘটনা । অনেকে ‘আশুরা’ বলতে কারবালার ঘটনাই বুঝেন, যদিও ইসলামি শরীয়তে আশুরার সিয়াম বা ফযিলতের সাথে কারবালার ঘটনার কোনো সম্পর্ক নেই। তবে ঐতিহাসিক ঘটনা হিসাবে কারবালার ঘটনা পর্যালোচনা করা আমাদের জন্য অতীব প্রয়োজন। উম্মাতের জন্য এ ঘটনা ছিল অত্যন্ত হৃদয় বিদারক বেদনাদায়ক ঘটনা। রাসূলুল্লাহ -এর ওফাতের মাত্র ৫০ বৎসর পরে ৬১ হিজরী সালের মুহার্রাম মাসের ১০ তারিখ শুক্রবার ইরাকের কারবালা নামক স্থানে তাঁরই উম্মাতের কিছু মানুষের হাতে নির্মমভাবে শহীদ হন তাঁরই প্রিয়তম দৌহিত্র হযরত হুসাইন ইবনু আলী (রা)। এ ঘটনা মুসলিম উম্মাহর মধ্যে চিরস্থায়ী বিভক্তি ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে। অনেক মিথ্যা ও ভিত্তিহীন কাহিনী এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে মুসলিম উম্মার মধ্যে ছড়ানো হয়েছে। যেগুলির বিস্তারিত আলোচনা এখানে সম্ভব নয় ।
এখানে আমরা নির্ভরযোগ্য প্রাচীন ইতিহাসগ্রন্থের আলোকে ইমাম হুসাইনের শাহাদতের ঘটনা সংক্ষেপে আলোচনা করব। তার আগে আমরা এর প্রেক্ষাপট বুঝতে চেষ্টা করব। রাসূলুল্লাহ -এর আগমনের সময় সমগ্র বিশ্বের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা ছিল মূলত বংশতান্ত্রিক। রাষ্ট্রের মালিক রাজা। তার অন্যান্য সম্পদের মতই রাষ্ট্রের মালিকানাও লাভ করবে তার বংশধরেরা। রাজ্যের সকল সম্পদ-এর মত জনগণও রাজার মালিকানাধীন। রাজা নির্বাচন বা রাজ্য পরিচালনা বিষয়ে তাদের কোনো মতামত প্রকাশের সুযোগ বা অধিকার নেই। রাসূলুল্লাহ সর্বপ্রথম একটি আধুনিক জনগণতান্ত্রিক পরামর্শ-ভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। এ ব্যবস্থার দুটি বিশেষ দিক ছিল: (১) রাজা ও প্রজার সম্পর্ক মালিক ও অধীনদের নয়, বরং মালিক ও ম্যানেজারের। তবে মালিক রাজা নন। রাষ্ট্রের মালিক জনগণ । রাজা তাদের খলীফা বা প্রতিনিধি বা ম্যানেজার হিসেবে তা পরিচালনা করবেন । জনগণই তাকে মনোনিত করবেন এবং জনগণ তাকে সংশোধন বা অপসারণ করবেন। (২) রাষ্ট্রপ্রধান নির্ধারণ করা একটি জাগতিক কর্ম এবং তা জনগণের কর্ম। জনগণের পরামর্শের ভিত্তিতে তা সম্পন্ন হবে। পরামর্শের ধরন নির্ধারিত নয় । যুগ, দেশ ও জাতির অবস্থা অনুসারে তা পরিবর্তিত হতে পারে ।
এ ব্যবস্থার আওতায় রাসূলুল্লাহ কাউকে মনোনিত না করে উম্মাতকে সরাসরি নির্বাচনের মুখোমুখি রেখে যান। আবূ বকর (রা) নেতৃবৃন্দের সাথে পরামর্শক্রমে উমারকে (রা) পরবর্তী শাসক হিসেবে মনোনয়ন দিয়ে যান। উমার (রা) ৬ জনের একটি কমিটিকে মনোনয়ন দেন, যারা জনগণের পরামর্শের ভিত্তিতে তাঁদের মধ্য থেকে উসমানকে (রা) মনোনয়ন দেন। উসমান (রা)-এর শাহাদতের পরে মদীনার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ পরামর্শের মাধ্যমে আলী (রা)-কে শাসক মনোনিত করেন। আলী (রা) তাঁর ইন্তেকালের পূর্বে তাঁর পুত্র হাসান (রা)-কে পরবর্তী শাসক হিসেবে মনোনয়ন দেন।
৪০ হিজরীর রামাদান মাসে আলীর (রা) ওফাতের পর হাসান (রা) খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন । গৃহযুদ্ধ বন্ধ করার জন্য ৬ মাস পরে তিনি মুআবিয়ার (রা) পক্ষে খিলাফতের দায়িত্ব পরিত্যাগ করেন এবং মুআবিয়া (রা) সর্বসম্মতভাবে খলীফা হন। ২০ বৎসর সুষ্ঠ রাষ্ট্রপরিচালনার পর ৬০ হিজরী সালে তিনি ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুর পূর্বে রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতৃবৃন্দের পরামর্শক্রমে তিনি তাঁর পুত্র ইয়াযিদকে পরবর্তী শাসক হিসেবে মনোনয়ন দেন। তাঁর মৃত্যুর পরে ইয়াযিদ খিলাফতের দায়িত্ব দাবি করলে তৎকালীন মুসলিম রাষ্ট্রের অধিকাংশ এলাকার মানুষ তা মেনে নেন। পক্ষান্তরে মদীনার অনেক মানুষ, ইরাকের মানুষ এবং বিশেষত কুফার মানুষেরা তা মানতে অস্বীকার করেন।
কুফার মানুষেরা আলীর (রা) দ্বিতীয় পুত্র ইমাম হুসাইনকে (রা) খলীফা হিসেবে গ্রহণ করতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। এ সময়ে ইমাম হুসাইন (রা) মদিনায় অবস্থান করছিলেন। এরপর তিনি মদীনা থেকে মক্কায় আগমন করেন। কুফার লক্ষাধিক মানুষ তাঁকে খলীফা হিসেবে বাইয়াত করে পত্র প্রেরণ করে। তারা দাবি করে যে, সুন্নাত পুনরুজ্জীবিত করতে ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করতে অবিলম্বে তাঁর দায়িত্ব গ্রহণ করা প্রয়োজন। মদীনা ও মক্কায় অবস্থানরত সাহাবিগণ ও ইমাম হুসাইনের প্রিয়জনেরা তাকে কুফায় যেতে নিষেধ করেন। তাঁরা আশঙ্কা করছিলেন যে, ইয়াযিদের পক্ষ থেকে বাধা আসলে ইরাকবাসীরা হুসাইনের পিছন থেকে সরে যাবে। সবশেষে হুসাইন (রা) কুফা গমনের সিদ্ধান্ত নেন।
তিনি তাঁর পরিবারের ১৯ জন সদস্যসহ প্রায় ৫০ জন সঙ্গী নিয়ে কুফায় রওয়ানা হন । ইয়াযিদের নিকট এ খবর পৌঁছালে তিনি কুফার গভর্নর নু’মান ইবনু বাশীর (রা)-কে পদচ্যুত করে বসরার গভর্নর উবাইদুল্লাহ ইবনু যিয়াদকে কুফার দায়িত্ব প্রদান করেন। তিনি তাকে নির্দেশ দেন অবিলম্বে কুফায় গিয়ে দায়িত্ব গ্রহণ করতে এবং হুসাইন যেন কুফায় প্রবেশ করতে না পারেন সে ব্যবস্থা করতে । উবাইদুল্লাহ কুফায় পৌঁছে কঠোর হস্তে কুফাবাসীকে দমন করে। এরপর ৪ হাজার যোদ্ধার এক বাহিনী প্রেরণ করে হুসাইনকে (রা) প্রতিরোধ করতে। উবাইদুল্লাহর বাহিনী হুসাইনকে কারবালার প্রান্তরে অবরোধ করে। হুসাইন (রা) তাদেরকে বলেন, আমি তো যুদ্ধ করতে আসি নি। তোমরা আমাকে ডেকেছ বলেই আমি এসেছি। এখন তোমরা কুফাবাসীরাই তোমাদের বাইয়াত ও প্রতিজ্ঞা পরিত্যাগ করেছ। তাহলে আমাদেরকে ছেড়ে দাও আমরা মদিনায় ফিরে যাই, অথবা সীমান্তে গিয়ে কাফিরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করি, অথবা সরাসরি ইয়াযিদের কাছে গিয়ে তার সাথে বুঝাপড়া করি । উবাইদুল্লাহ প্রথমে প্রস্তাব মেনে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু শিমার নামক তার এক সহচর বলে, যদি হুসাইনকে বাগে পেয়েও তুমি তাকে হত্যা না করে ছেড়ে দাও তবে তোমার পদোন্নতির সব সুযোগ শেষ হয়ে যাবে। তখন সে হুসাইন (রা)-এর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে এবং তাকে হত্যার নির্দেশ দেয় ।
আশুরার দিন সকাল থেকে উবাইদুল্লাহর বাহিনী হুসাইনের সাথীদের উপর আক্রমণ চালাতে থাকে। পার্শ্ববর্তী নদী থেকে পানি গ্রহণে তারা তাদেরকে বাধা দেয়। তাদের আক্রমণে তাঁর পরিবারে দুগ্ধপোষ্য শিশু, কিশোর ও মহিলাসহ অনেকে নিহত হন। হুসাইন তাঁর পুরুষ সাথীদের নিয়ে বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করতে থাকেন। পর্যায়ক্রমে তাঁর সাথীরা সকলেই নিহত হন। তিনি বীর বিক্রমে যুদ্ধ করতে থাকেন। এক পর্যায়ে সিনান নাখয়ী নামক এক ইয়াযিদ-সৈনিক তাকে আঘাত করলে তিনি মাটিতে পড়ে যান। তখন সিনান নিজে বা খাওলী নামক অন্য এক সৈন্য বা শিমার তাঁকে আঘাত করে তাঁর মস্তক দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে তাকে শহীদ করে। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন ।
উবাইদুল্লাহ বিন যিয়াদ হুসাইনের (রা) মস্তক ও তাঁর পরিবারের জীবিত সদস্যদেরকে দামেশকে ইয়াযিদের নিকট প্রেরণ করে। ইয়াযিদ বাহ্যিক দুঃখ প্রকাশ করে বলে, আমি তো হুসাইনকে কুফা প্রবেশে বাধা দিতে নির্দেশ দিয়েছিলাম, তাকে হত্যা করতে নির্দেশ দিই নি। এরপর সে হুসাইনের পরিবার পরিজনকে মদিনায় প্রেরণ করে। (তাবারী, আত-তারীখ ৩/২৯৪-৩০৪; যাহাবী, সিয়ারু আলামিন নুবালা ৩/২৪৫-৩২১।)
কারবালার এ নারকীয় ও হৃদয়বিদারক ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ এখন সম্ভব নয় । এ ঘটনার মূল্যায়নে অনেক বিভ্রান্তি রয়েছে। বিশেষত ইসলামের বিশ্বজনীনতা অনুভবে অক্ষম এক শ্রেণীর মানুষ দাবি করেন যে, ইসলাম একটি বংশতান্ত্রিক রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রদান করেছে। এ ব্যবস্থায় রাসূলুল্লাহ -এর পরে শাসনক্ষমতার অধিকার তাঁর বংশধরদের বা আলী (রা) ও তাঁর বংশধরদের। এরা নিজদেরকে “শিয়া” বা আলীর অনুসারী বলে দাবি করেন। এরা হুসাইনের শাহাদাতের জন্য সাহাবিগণকে দায়ী করে, ঢালাওভাবে সাহাবীগণকে গালি দেয় এবং তাঁদের বিরুদ্ধে বিষোদ্‌গার করে। অন্য অনেকে ইয়াযিদের অন্যায়ের জন্য তার পিতা মুআবিয়া (রা)-কে দায়ী করেন এবং দাবি করেন যে, তিনি রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য ইয়াযিদকে মনোনয়ন দিয়েছিলেন ।
এ সকল চিন্তা সবই প্রকৃত ইতিহাস এবং কুরআন ও সুন্নাহ সম্পর্কে অজ্ঞতার ফল। কারবালার ঘটনার জন্য কোনো সাহাবীই দায়ী নন। পক্ষান্তরে আমরা ইতোপূর্বে দেখেছি যে, ইসলামী ব্যবস্থায় পূর্ববর্তী শাসক কাউকে মনোনয়ন না দিয়ে বিষয়টি জনগণের ইচ্ছার উপর ছেড়ে দিতে পারেন । অথবা জনগণের পরামর্শ ও স্বীকৃতির ভিত্তিতে যোগ্য কাউকে মনোনয়ন দিতে পারেন। সবচেয়ে বেশি যোগ্য ব্যক্তিকে মনোনয়ন দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয় নি; কারণ সবচেয়ে যোগ্য নির্ণয়ে সমাজে অকারণ সংঘাত তৈরি করে। ইসলামে জনগণের পরামর্শ ও স্বীকৃতিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। পরামর্শ ও স্বীকৃতি থাকলে নিজ পুত্র বা বংশের কাউকে পরবর্তী শাসক হিসেবে মনোনয়ন দিতে কোনোভাবে নিষেধ করা হয় নি। মূলত বিষয়টি দেশ, কাল ও সমাজের জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। মুআবিয়া (রা) ইসলামী ব্যবস্থার ব্যতিক্রম কিছুই করেন নি । ইয়াযিদের অন্যায়ের জন্য তিনি দায়ী নন ৷
অন্য অনেকে মনে করেন, ইমাম হুসাইন বংশতন্ত্র উৎখাতের জন্য অথবা এযিদের জালিম সরকার উৎখাতের জন্য কারবালায় যুদ্ধ করতে গিয়েছিলেন। এরূপ চিন্তও কুরআন, সুন্নাহ, সাহাবীগণের কর্মধারা ও কারবালার ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত জ্ঞানের অভাব প্রকাশ করে। বংশতন্ত্রের কারণে কেউই ইয়াযিদের বিরুদ্ধে আপত্তি করেন নি। যারা আপত্তি করেছিলেন তারা তার ব্যক্তিগত যোগ্যতার বিষয় ভেবে আপত্তি করেছিলেন। মুআবিয়া (রা)-এর ওফাতের মাধ্যমে রাষ্ট্রপ্রধানের পদ খালি হয় । মুআবিয়া (রা) জীবিত থাকতেই তার পুত্র ইয়াযিদের মনোনয়ন দেন। কিন্তু এরূপ মনোনয়ন কার্যকর হয় মনোনিত ব্যক্তির ক্ষমতাগ্রহণে নাগরিকদের স্বীকৃতির মাধ্যমে। এ সময়ে অনেকে ইয়াযিদকে মেনে নিয়েছেন। কিন্তু কুফাবাসীরা ইমাম হুসাইনকে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে বাইয়াত করে তার নেতৃত্বে পরিপূর্ণ সুন্নাত প্রতিষ্ঠা ও অন্যায় দূর করার দাবি জানান। হুসাইন তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে কুফায় যাচ্ছিলেন।

ইমাম হুসাইন এযিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বের হন নি। তিনি এ জন্য কোনো সেনাবাহিনীও তৈরি করেন নি। তিনি নিজের ও পরিবারের সম্ভ্রম ও অধিকার রক্ষায় যুদ্ধ করে শহীদ হন । শীয়া সম্প্রদায়ের মানুষেরা কারবালার ঘটনার শোক প্রকাশের নামে প্রতি বৎসর আশূরার দিনে শোক, মাতম, তাযিয়া ইত্যাদির আয়োজন করে। এগুলি সবই ইসলাম বিরোধী কর্ম । আলী, ফাতিমা, হাসান, হুসাইন (রা)-সহ রাসূলুল্লাহ -এর পরিবার বা আহলে বাইতকে মহব্বত করা আমাদের ঈমানের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাদের কষ্টে আমরা ব্যথিত এবং তাদের যারা কষ্ট দিয়েছে তাদের
প্রতি আমাদের ঘৃণা অপরিসীম। পাশাপাশি সাহাবীগণের মর্যাদা ও ভালবাসা কুরআন ও হাদীসের নির্দেশ অনুসারে আমাদের ঈমানের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কাজেই নবী-বংশের ভালবাসার নামে শুধুমাত্র ধারণা বা ইতিহাসের ভিত্তিহীন কাহিনীর উপর নির্ভর করে সাহাবীগণ বা কোনো একজন সাহাবীর প্রতি বিরক্তি প্রকাশ আমাদের ঈমানের জন্য ধ্বংসাত্মক ।
কারবালার ঘটনার মধ্যে আমাদের জন্য অনেক শিক্ষা রয়েছে। বিস্তারিত আলোচনা সম্ভব নয়। তবে আমরা বুঝতে পারি যে, দুনিয়ার সাময়িক জয় বা পরাজয় দিয়ে চূড়ান্ত ফলাফল বিচার করা যায় না। ইয়াযিদের বাহিনী কারবালায় বাহ্যিক বিজয় লাভ করলেও তারা মূলত পরাজিত হয়। হুসাইনের হত্যায় জড়িত প্রতিটি ব্যক্তি কয়েক বছরের মধ্যেই মুখতার সাকাফীর বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে নিহত হয়। মাত্র ৪ বছরের মধ্যে ইয়াযিদ মৃত্যু বরণ করে এবং তার পুত্র মুআবিয়াও কয়েক দিনের মধ্যে মৃত্যু বরণ করেন। এরপর আর কোনোদিন তার বংশের কেউ শাসক হয় নি। দুনিয়ার জয়-পরাজয়, সফলতা-ব্যর্থতা, ক্ষমতা বা শক্তি দিয়ে মহান আল্লাহর কবুলিয়্যাত মাপা যায় না। সত্যকে আঁকড়ে ধরা এবং সত্যের পথে সকল বিপদ ও কষ্ট অকাতরে মেনে নেওয়াই মুমিনের দায়িত্ব। মহান আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর সন্তুষ্টির পথে চলার তাওফীক দান করুন। আমীন ।

 

Read More

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked with *

সর্বশেষ পোস্ট

Advertising