– ড. ফারুক আমিন ৫ আগষ্ট ২০২৪, সোমবার। সারা দেশের মানুষ ক্ষোভ, উৎকণ্ঠা ও প্রতিবাদে আপ্লুত। বিগত দুই সপ্তাহের অসংখ্য হত্যার ঘটনায় শোকে ভারাক্রান্ত সবাই। কেউ জানে না সামনের দিনগুলোতে কি হতে যাচ্ছে। এর মাঝেই জীবন বাজি রেখে লক্ষ লক্ষ মানুষ নেমে এসেছে ঢাকার রাস্তায়। বিভিন্ন দিক থেকে তারা এগিয়ে যাচ্ছে গণভবনের দিকে। তাদের একটাই
– ড. ফারুক আমিন
৫ আগষ্ট ২০২৪, সোমবার। সারা দেশের মানুষ ক্ষোভ, উৎকণ্ঠা ও প্রতিবাদে আপ্লুত। বিগত দুই সপ্তাহের অসংখ্য হত্যার ঘটনায় শোকে ভারাক্রান্ত সবাই। কেউ জানে না সামনের দিনগুলোতে কি হতে যাচ্ছে। এর মাঝেই জীবন বাজি রেখে লক্ষ লক্ষ মানুষ নেমে এসেছে ঢাকার রাস্তায়। বিভিন্ন দিক থেকে তারা এগিয়ে যাচ্ছে গণভবনের দিকে। তাদের একটাই দাবী, স্বৈরাচারী হাসিনার পদত্যাগ। এদিন সকালেও ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় গণহত্যার স্বীকার হয়েছে ছাত্র ও সাধারণ মানুষ। পুলিশ গুলি করে পশুপাখি শিকারের মতো মানুষ মারছে। এই বিক্ষোভ চলার সময় আর্মার্ড পার্সোনাল ক্যারিয়ার নামের সাজোঁয়া যান, হেলিকপ্টার ও স্নাইপার রাইফেল দিয়ে যেভাবে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, অনেক ক্ষেত্রে পুরোদস্তুর যুদ্ধের সময়েও সশস্ত্র শত্রুকে মানুষ সেভাবে হত্যা করতে পারে না। একই সাথে চলমান রয়েছে আওয়ামী লীগের নেতা, মন্ত্রী ও পুলিশ অফিসারদের তর্জন গর্জন। সবার মাথার উপর বসে হুংকার দিচ্ছে তথাকথিত লৌহমানবী শেখ হাসিনা ওয়াজেদ।
দুই সপ্তাহেরও বেশি রুদ্ধশ্বাস ও ভয়াবহ পরিস্থিতির পর, অসংখ্য মানুষের ত্যাগ ও অবর্ণনীয় দুর্ভোগের পর ৫ তারিখ যখন জনতা জীবন বাজি রেখে গণভবনের দিকে রওনা হলো, অল্প কয়েক ঘন্টার ভেতরেই কাপুরুষ শেয়ালের মতো লেজ গুটিয়ে নিজের জুলুম-নির্যাতন-দুর্নীতির অনুসারীদেরকে এতিম ও অসহায় ফেলে রেখে পালিয়ে গেলো সেই তথাকথিত লৌহমানবী, আসলে যার রক্তের কণায়, ডিএনএ তে এবং বংশীয় অভ্যাসে মিশে আছে পলায়নের অভ্যাস। সুদূর অতীতের অত্যাচারী রাজা লক্ষণ সেনের অনুসারী শেখ মুজিবও বারবার জনগণকে উত্তেজিত করে নিজে আত্মসমর্পন করে নিরাপদে রাজবন্দী হিসেবে চলে যেতো এবং সেই কারাবন্দী হওয়ার ঘটনা নিয়ে ক্রমাগত মিথ্যাচার করে নিজেকে নেতা বানিয়ে তুলেছিলো। বাংলাদেশের প্রথম স্বৈরাচার ও দুর্নীতিবাজ শাসক শেখ মুজিবের উপযুক্ত কন্যা হিসেবে দীর্ঘদিন কেবলমাত্র অস্ত্র ও দুর্বৃত্তপনার মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে রাখা সিন্দাবাদের ভূত শেখ হাসিনাও বিপদের প্রথম মূহুর্তেই লেঙ্গুর তুলে তার প্রভুদের কাছে নিরাপদ আশ্রয় নিয়েছে। গণহত্যার মূল হুকুমদাতা এই খুনী হাসিনার পলায়নকে উদযাপন করতে বাংলাদেশের মানুষ আজ বলছে, দিল্লী থেকে আসার দিল্লীর কুকুর আবার সেই দিল্লীতেই তার মালিকদের কাছে ফিরে গেছে।
শেখ হাসিনার ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের অপরাধের তালিকা অনেক দীর্ঘ। বিগত সাড়ে পনেরো বছরের প্রতিটি দুর্নীতি, উন্নয়নের নামে দেশের টাকা অবাধে লুটপাট, মানবাধিকার লংঘনের প্রতিটি ঘটনা, গুমের ঘটনা, বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা, বিচারের নামে ও বিচারবিভাগকে কাজে লাগিয়ে হত্যা ও প্রতিপক্ষ দমনের ঘটনা এবং অসংখ্য অন্যায় নির্যাতনের ঘটনার ন্যায় বিচার না হলে বাংলাদেশ কোনদ্নিই একটি সভ্য রাষ্ট্র ও সুস্থ সমাজ হিসেবে সামনের দিকে এগুতে পারবে না। বাংলাদেশের ইতিহাসে ফ্যাসিবাদী ও মাফিয়া শাসনের এই কালো অধ্যায় ফিরে না আসা নিশ্চিত করতে চাইলে সেক্ষেত্রে সবচেয়ে জরুরী এবং মৌলিক কাজ হলো ফ্যাসিবাদী মাফিয়াদের সমস্ত অপরাধের যথাযথ শাস্তি দেয়া। তাদের শাস্তি দেখেই ভবিষ্যতের সম্ভাব্য দুর্বৃত্তরা আবারও দেশকে দখল করার সাহস করতে পারবে না। বরং তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো অন্যায়ের শিকার মানুষদের প্রাপ্য অধিকার ফিরিয়ে দেয়া। তাদের জীবনে যে অবর্ণনীয় দুর্ভোগের শিকার তাদেরকে হতে হয়েছে দীর্ঘ সময় যাবত, সে দীর্ঘ অধ্যায়গুলোর কিছুটা প্রতিকার করার চেষ্টা করা। কিন্তু বর্তমান বাংলাদেশ কি সে পথে হাঁটছে? ড. ইউনুসের নেতৃত্বে অন্তর্বতীকালীন সরকার শপথ নেয়ার পর পার হওয়া তিন সপ্তাহের ঘটনাবলী আমাদেরকে কিসের ইঙ্গিত দেয়?
শেখ হাসিনার সরকারের সমস্ত অপকর্ম ও দুস্কৃতিমূলক কর্মকান্ড পরিচালনা করতে অন্তত এক হাজার মানুষ সবচেয়ে প্রনিধানযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। বিগত তিন সপ্তাহে তাদের মাঝে হাতে গোণা চার পাঁচ জনকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, হাসিনার উপদেষ্টা ও চুরিডাকাতির উপদেষ্টা সালমান রহমান এবং বিচারপতি শামসুদ্দিন মানিককে যেসব ঘটনার মাধ্যমে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে তাকে সচেতন মানুষরা সাজানো নাটক হিসেবেই ধরে নিয়েছে। এরপর বাংলাদেশের গোয়েবলস হিসেবে কুখ্যাত তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাতকে গ্রেফতারে গুজব ছড়িয়ে পড়লে এবং বিভিন্ন পত্রপত্রিকাতে সে খবর প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে দেখা যায় সে খবরটি মিথ্যা। এছাড়াও শোনা যাচ্ছে হাছান মাহমুদ, ওবায়দুল কাদের, শামীম ওসমান এইসব কুখ্যাত দুস্কৃতিকারীরা হয়তো সেনা হেফাজতে নিরাপদেই আছে কিংবা বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে। হাসিনার কুখ্যাত খুনীদের মাঝে কেবলমাত্র সেনাবাহিনী কর্মকর্তা জিয়াউল আহসানকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। যদিও সে বিমানে পর্যন্ত উঠে গিয়েছিলো পালিয়ে যাওয়ার জন্য। পুলিশ নামের জঘন্য খুনীদের মাঝে মনিরুল, হারুন, বেনজির, কৃষ্ণপদ বা বিপ্লবদের মতো অপরাধীদের শাস্তির ব্যবস্থা করার কোন নমুনা এখনো দেখা যাচ্ছে না। স্বৈরাচারী হাসিনার অন্যতম বড় দুটি অস্ত্র ছিলো প্রশাসন এবং বিচারবিভাগ। এ দুইটি বিভাগের বড় বড় অপরাধীদের বিষয়ে কার্যকর কোন পদক্ষেপের নমুনা দেখা যায়নি এ তিন সপ্তাহের মাঝেও। গুম হয়ে যাওয়া মানুষদের মাঝে দুই তিনজনকে রহস্যজনকভাবে ছেড়ে দেয়া হয়েছে বটে, কিন্তু বাকি শত শত মানুষ কোথায়? তাদেরকে কোথায় আটকে রেখেছিলো এই অপরাধীরা? কারা ছিলো এইসব অপরাধের পেছনে? এমন অসংখ্য প্রশ্নের উত্তর আজও পাওয়া যাচ্ছে না। বিচারের যত দেরি হয়, বিচার ততই অসম্ভবপর কিংবা প্রত্যাখ্যাত হয়, মানব ইতিহাসের চরম সত্য সে আপ্তবাক্যটি স্মরণ করলে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা নিয়ে শংকিতই হতে হয়।
বাংলাদেশ খুবই ছোট এবং জনবহুল দেশ। এই দেশে পালিয়ে থাকা সহজসাধ্য বিষয় নয়। তার উপর হাসিনার অপকর্মের দোসর এই ছোট ছোট খুনীরা সারা দেশের মানুষের কাছে পরিচিত এবং কুখ্যাত। এ মূহুর্তে বাংলাদেশের মানুষের সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, এই অপরাধীগুলো কোথায়? অনেকেই বলছে এরা নিরাপদ সেনা হেফাজতে আছে। বিপুল পরিমাণ টাকার বিনিময়ে এরা এখনো নিরাপত্তা পাচ্ছে এবং এদের অনেকেই ধীরে ধীরে এবং গোপনে দেশ থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। হাজারেরও বেশি ছাত্র-শ্রমিক-জনতার প্রাণের বিনিময়ে, অসংখ্য মানুষের আহত হওয়া ও পঙ্গুত্বের বিনিময়ে যদি এই হয় অপরাধীদের শাস্তির নমুনা, তাহলে ভবিষ্যত সম্পর্কে খুব বেশি আশাবাদী হওয়ার কিছু নেই।
তথাপি সমস্ত নিরাশাজনক বাস্তবতা ও বর্তমান পরিস্থিতির পরও বাংলাদেশের মানুষের একমাত্র এবং সবচেয়ে বড় আশার জায়গা হলো হাসিনার পলায়ন ও দুর্বৃত্ত দল আওয়ামী লীগের পতন। দীর্ঘ সাড়ে পনেরো বছর মানুষ এখন অন্তত দমনের ভয় না করে তাদের মনের কথা বলতে পারছে। বিগত বছরগুলোতে তাদের নির্যাতিত হওয়ার বিভিন্ন অভিজ্ঞতা নিয়ে মুখ খুলছে। একই সাথে দেখা যাচ্ছে দীর্ঘ সময় ধরে আওয়ামী লীগের অপরাধের দোসররাও দ্রুত তাদের রং বদলাচ্ছে। পরিস্থিতি দেখে তারা নিজেদেরকে সংগ্রামী ঘোষণা করছে এবং নিজেদের অপরাধ লুকাতে আপ্রাণ চেষ্টায় রত আছে।
আমরা আশাবাদী হতে চাই, বিশ্বাস করতে চাই বাংলাদেশে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার, মানবাধিকার, চিন্তা প্রকাশের স্বাধীনতা, দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন, সভ্য একটি সমাজের সকল বৈশিষ্ট্য প্রতিষ্ঠিত হবে ও ন্যায়ের চর্চা হবে, কিন্তু বাংলাদেশের অতীত ইতিহাস আমাদেরকে এখনই আশাবাদী হওয়া থেকে নিবৃত করে। আওয়ামী লীগ ঐতিহাসিকভাবে এবং প্রকৃতিগতভাবে একটি দুর্বৃত্ত দল। বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই দেশের সমস্ত গুন্ডা, চোর-ডাকাত ও লুটেরারা আওয়ামী লীগের ব্যানারে ও রাজনৈতিক পরিচয়ের ছত্রছায়ায় দেশের সম্পদ লুটপাট ও দেশের মানুষের উপর অত্যাচার চালিয়েছে বারবার। বাংলাদেশের মানুষ প্রকৃতিগতভাবেই ক্ষমাশীল ও স্বল্পস্থায়ী স্মৃতির অধিকারী। বাংলাদেশীদের এ স্বভাবের সুযোগ নিয়ে শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ এই দেশে ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যাও চালিয়েছে দুই হাজার চব্বিশ সালে এসে। এই গণহত্যার প্রকৃত এবং আন্তর্জাতিক মানের বিচার হওয়া প্রয়োজন। রাজনীতির নাম দিয়ে আওয়ামী লীগের করা সমস্ত অপরাধের বিচার হওয়া প্রয়োজন। এ বিচার ও প্রতিকার সুষ্ঠভাবে না করতে পারলে বাকি সমস্ত আয়োজন ও প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে তা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।
Leave a Comment
Your email address will not be published. Required fields are marked with *