728 x 90

ইসলামে মানুষের  জীবনের নিরাপত্তা বিধান

ইমাম হেসেন ইকবাল:  ইসলাম মানবজীবনকে একান্তই সম্মানের বস্তু হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং একজন মানুষের জীবন সংহারকে সমগ্র মানব গোষ্ঠীর হত্যার সমতুল্য সাব্যস্ত করে জীবনের নিরাপত্তার গুরুত্বের প্রতি যতটা জোর দিয়েছে তার নজীর পৃথিবীর কোন ধর্মীয়, নৈতিক কিংবা আইনশাস্ত্রীয় সাহিত্যে কোথাও মিলে না। মহান আল্লাহ্ তায়ালার বাণী : “নরহত্যা অথবা পৃথিবীতে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তি

ইমাম হেসেন ইকবাল:  ইসলাম মানবজীবনকে একান্তই সম্মানের বস্তু হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং একজন মানুষের জীবন সংহারকে সমগ্র মানব গোষ্ঠীর হত্যার সমতুল্য সাব্যস্ত করে জীবনের নিরাপত্তার গুরুত্বের প্রতি যতটা জোর দিয়েছে তার নজীর পৃথিবীর কোন ধর্মীয়, নৈতিক কিংবা আইনশাস্ত্রীয় সাহিত্যে কোথাও মিলে না।

মহান আল্লাহ্ তায়ালার বাণী : “নরহত্যা অথবা পৃথিবীতে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তি ব্যতিরেকে কেউ কাউকে হত্যা করলে সে যেন পৃথিবীর সমগ্র মানব গোষ্ঠীকে হত্যা করল, আর কেউ কারো প্রাণ রক্ষা করলে সে যেন পৃথিবীর সমগ্র মানব গোষ্ঠীকে প্রাণে রক্ষা করল” – (সূরা মাইদা: ৩২)।

-সূরা বনী ইসরাঈলে ইরশাদ হচ্ছে :  আল্লাহ যে প্রাণ হত্যা নিষিদ্ধ করেছেন যথার্থ কারণ ব্যতিরেকে তাকে হত্যা কর না” (বনী ইসরাঈল : ৩৩)।

ইসলামী আইন ‘কতল বিল-হাক্ক’ (সংগত কারণে হত্যা) ছয়টি ক্ষেত্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে দিয়েছে :

১. ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যার অপরাধীকে তার অপরাধের প্রতিশোধস্বরূপ হত্যা করা (কিসাস)।

২. জিহাদের ময়দানে সত্য দীনের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারীদের হত্যা করা ।

৩. ইসলামের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার পতনের চেষ্টায় লিপ্তদের অপরাধের শাস্তিস্বরূপহত্যা করা।

৪. বিবাহিত নারী-পুরুষকে ব্যভিচারের অপরাধে হত্যা করা।

৫. ধর্মত্যাগের অপরাধে হত্যা করা ।

৬. ডাকাত অর্থাৎ রাজপথে রাহাজানি ইত্যাদি অপরাধের শাস্তিস্বরূপ হত্যা করা।এই ছয়টি কারণ ছাড়া অন্য কোন কারণে মানুষের প্রাণের মর্যাদা বিনষ্ট হয় না । কুরআনুল করীমের সূরা আনআমের ১৫২ নং আয়াত, বাকারার ১৭৮ ও ১৭৯ নং আয়াত এবং সূরা ফুরকানের ৬৮ নং আয়াতে এতদসম্পর্কিত নির্দেশ রয়েছে। মহান আল্লাহ ‘হত্যা’কে এমন গুরুতর ও জঘন্য অপরাধ সাব্যস্ত করেছেন যে, এই অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তি ইহকালে কিসাসের শাস্তি ভোগ করা সত্ত্বেও আখেরাতে জাহান্নামী হবে। উপরন্তু সে মহান আল্লাহর গজব ও চরম অভিসম্পাতের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হবে।

“এবং কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে কোন মুমিন ব্যক্তিকে হত্যা করলে তার শাস্তি জাহান্নাম, যেখানে সে স্থায়ী হবে এবং তার প্রতি আল্লাহর গজব ও অভিসম্পাত এবং তিনি তার জন্য মহাশাস্তি প্রস্তুত রেখেছেন” (সূরা নিসা : ৯৩)। কুরআন মজীদে দুর্ভিক্ষ ও দারিদ্র্যের ভয়ে সন্তানদের হত্যা করতে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে।

“দারিদ্র্যের ভয়ে তোমরা তোমাদের সন্তানদের হত্যা কর না। আমিই তোমাদের জীবিকার ব্যবস্থা করি এবং বিশেষত তাদেরও” (সূরা আনআম : ১৫১)। অনুরূপ উপদেশ সূরা বনী ইসরাঈলের ৩১নং আয়াত ও সূরা আনআমের ১৪০ নং আয়াতেও দেওয়া হয়েছে। জাহিলী যুগে আরবদেশে কন্যা সন্তানদের জীবন্ত কবর দেওয়ার অমানুষিক প্রথা প্রচলিত ছিল। এই জঘন্য অপকর্মের জন্য পরকালের ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে ইঙ্গিত দিয়ে অত্যন্ত ভয়ংকর বাচনভঙ্গীতে ইরশাদ হচ্ছেঃ “যখন জীবন্ত প্রোথিত কন্যাকে জিজ্ঞেস করা হবে কি অপরাধে তাকে হত্যা করা হয়েছিল” (তাকবীর : ৮-৯)?

আল্লাহ তাআলা কেবল অপরকে হত্যা করাই নিষিদ্ধ করেননি, বরং তিনি মানুষকে নিজের জীবন ধ্বংস না করারও নির্দেশ দিয়েছেন এবং এভাবে আত্মহত্যার পথও বন্ধ করে দিয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, “তোমরা আত্মহত্যা কর না (নিসা : ২৯)।

জীবনের মর্যাদা সম্পর্কে কুরআনের এইসব সুস্পষ্ট বিধানের পর এখন নবী করীম (স)-এর বাণীসমূহ ও তাঁর কল্যাণময় যুগের কতিপয় ঘটনা লক্ষণীয়। বিদায় হজ্জের ভাষণে তিনি দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করেন :

“হে লোকসকল। তোমাদের জানমাল ও ইজ্জত-আব্রুর উপর হস্তক্ষেপ তোমাদের উপর হারাম করা হল। তোমাদের আজকের এই দিন, এই (জিলহজ) মাস এবং এই শহর (মক্কা শরীফ) যেমন পবিত্র ও সম্মানিত, অনুরূপভাবে উপরিউক্ত জিনিসগুলোও সম্মানিত ও পবিত্র। সাবধান। আমার পরে তোমরা পরস্পরের হস্তা হয়ে কাফেরদের দলভুক্ত হয়ে যেও না যেন” (বুখারী, আবু দাউদ, নাসাঈ, মুসনাদে আহমাদ)।

অতঃপর তিনি তাঁর এই নসিহত কার্যকর করতে গিয়ে সর্বপ্রথম দৃষ্টান্ত স্থাপন করে বলেন: “জাহিলী যুগের যাবতীয় হত্যা রহিত হল। প্রথম যে হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণ আমি রহিত করলাম তা হচ্ছে আমার বংশের রবীআ ইবনুল হারিস-এর দুগ্ধপোষ্য শিশু হত্যার প্রতিশোধ, যাকে হুযাইল গোত্রের লোকেরা হত্যা করেছিল। আজ আমি তা ক্ষমা করে দিলাম” (বুখারী, আবু দাউদ, নাসাঈ ও মুসনাদে আহমাদ)

মহানবী (স) একবার বলেছিলেন : “কোন মুসলিম ব্যক্তির নিহত হওয়ার তুলনায় সমগ্র পৃথিবীর পতন আল্লাহ্রদৃষ্টিতে অতি তুচ্ছ ব্যাপার” (মুসলিম)।

কেবল মুসলমানের জীবনই সম্মানিত নয়; আল্লাহর প্রত্যেক বান্দার জীবনই সম্মানিত। কোন মুসলমানের হাতে অন্যায়ভাবে কোন জিম্মি নিহত হলে সেই মুসলমানের জন্য জান্নাত হারাম। এই পর্যায়ে নবী করীম (স) বলেন : “যে ব্যক্তি কোন যিম্মীকে হত্যা করবে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দিবেন”(নাসাঈ)।

“যে ব্যক্তি চুক্তিবদ্ধ কোন অমুসলিমকে হত্যা করল সে কখনো জান্নাতের সুগন্ধিও পাবে না” (বুখারী)। একবার কোন এক যুদ্ধে মুশরিকদের কতিপয় শিশু আক্রমণের পাল্লায় নিহত হয়। এতে মহানবী (স) অত্যন্ত মর্মাহত হন। কোন কোন সাহাবী আরজ করলেন,এরা তো মুশরিকদের সন্তান। তিনি বলেন : “মুশরিক শিশুরাও তোমাদের চাইতে উত্তম। সাবধান। শিশুদের হত্যা কর না, সাবধান। শিশুদের হত্যা কর না। প্রতিটি জীবন আল্লাহর নির্ধারিত ফিতরতে (সৎ স্বভাব নিয়ে) জন্মগ্রহণ করে থাকে”(মুসনাদে আহমাদ)।

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত আছে যে, নববী যুগে এক ব্যক্তির মৃতদেহ পাওয়া গেল, কিন্তু হত্যাকারীর সন্ধান পাওয়া গেল না। মহানবী (স) চরম অসন্তোষ অবস্থায় ভাষণ দিতে গিয়ে বলেন : “হে লোকসকল। ব্যাপার কি, আমি তোমাদের মাঝে বর্তমান থাকতে মানুষ নিহত হচ্ছে এবং তার হত্যাকারীর পরিচয় মিলছে না! একজন মানুষকে হত্যা করার জন্য আসমান জমিনের সমগ্র সৃষ্টিও যদি একত্র হয়ে যায় তবুও আল্লাহ এদের সকলকে শাস্তি না দিয়ে ছাড়বেন না” (তাবারানী)।

কোন এক যুদ্ধে একটি স্ত্রীলোক নিহত হয়। মহানবী (স) তার লাশ দেখে বলেনঃ “আহ! তোমরা এ কি কাজ করলে? সে তো যোদ্ধাদের মধ্যে শামিল ছিল না। যাও সেনাপতি খালিদকে বলে দাও যে, নারী, শিশু ও দুর্বলদের হত্যা কর না”- (আবু উবায়েদ, কিতাবুল আমওয়াল, অনু. আবদুর রহমান তাহের, ইসলামাবাদ ১৯৬৯ খৃ., ১ম খন্ড, পৃ. ১৫৮) ।

মক্কা বিজয়ের প্রাক্কালে ঘোষিত সাধারণ ক্ষমার নজিরবিহীন ঘটনা থেকে আমরা যথার্থই অনুমান করতে পারি যে, মানুষের প্রাণের মূল্য এবং এতদসংক্রান্ত বিষয়ে ইসলামের অনুসৃত কর্মপন্থা ছিল কত উন্নত। তখনও কাফেররা আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছিল, মদীনার ইসলামী রাষ্ট্রের অস্তিত্ব নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল, তাদের সাথে একটি হামলাকারী দেশের সৈন্যদের মত আচরণ দেখানো হয়েছিল।

বদরের যুদ্ধবন্দি কাফেরদের সম্পর্কে হযরত আবু বাক্ সিদ্দীক (রা) মুক্তিপণের বিনিময়ে তাদের মুক্তি দেওয়ার পক্ষে অভিমত ব্যক্ত করেন। পক্ষান্তরে হযরত উমার (রা) এদের হত্যার পক্ষে অভিমত ব্যক্ত করেন। হযরত উমার (রা)-র রায়ের অনুকূলে পবিত্র কুরআনের আয়াত নাযিল হলঃ

“দেশে ব্যাপকভাবে শত্রুকে পরাভূত না করা পর্যন্ত বন্দি রাখা কোন নবীর জন্য সংগত নয়। তোমরা কামনা কর পার্থিব সম্পদ এবং আল্লাহ চান পরকালের কল্যাণ; আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। আল্লাহ্র পূর্ব বিধান না থাকলে তোমরা যা গ্রহণ করেছ সেজন্য তোমাদের প্রতি মহাশাস্তি আপতিত হত”

(আনফাল : ৬৭-৬৮)। মক্কা বিজয়ের পর কাফেরদের অবস্থার আমূল পরিবর্তন সূচিত হল। তাদের রাজত্ব খতম হয়ে গেল। পরিসমাপ্তি ঘটলো তাদের আক্রমণাত্মক ভূমিকারও। সর্বোপরি তারা বিজিত অঞ্চলের অধিবাসীদের ন্যায় ইসলামী রাষ্ট্রের অধীনে সাধারণ নাগরিকে পরিণত হল এবং মহান আল্লাহ্র অভিপ্রায় অনুসারে নতশিরে বশ্যতা স্বীকার করল।“যে পর্যন্ত না তারা নত হয়ে স্বহস্তে জিয়া দেয়” (তওবা: ২৯)।

তাই মহানবী (স) আল্লাহর পক্ষ থেকে মক্কা বিজয়ের সুসংবাদ পেয়েছিলেন, ইসলামী রাষ্ট্রের প্রধান হিসাবে মক্কা বিজয় পর্ব পরিপূর্ণ হওয়ার পূর্বেই যুদ্ধাবস্থায়ই নিজ রাষ্ট্রের নতুন নাগরিকদের জীবনের নিরাপত্তার অসাধারণ ব্যবস্থা অবলম্বন করেন।

মক্কা ছিল মহানবী (স)-এর প্রাণের শত্রু এবং ইসলামের ঘোর বিরোধীদের আড্ডা। এখানে সেইসব লোক বাস করত যারা প্রতি পদে তাঁর চলার পথে কাঁটা বিছিয়ে রাখত, তাঁকে ও তাঁর সঙ্গীদের নানাভাবে কষ্ট দিত, তাঁকে আবু তালিব গিরিসংকটে দীর্ঘ তিনটি বছর অবরুদ্ধ করে রেখেছিল, তাঁকে হত্যার জঘন্য ষড়যন্ত্র পর্যন্ত করেছিল এবং তিনি মাতৃভূমির মায়া বিসর্জন দিয়ে সুদূর মদীনায় পৌঁছলে সেখানেও তাঁকে শান্তিতে বসবাস করতে দেয়নি। তারা মদীনার উপরে বারংবার হামলা চালিয়েছিল। বদর, উহুদ ও খন্দকের যুদ্ধে তারা রসূলে করীম (স)-এর নিবেদিত প্রাণ অনেক সাহাবীকে শহিদ করেছিল এবং স্বয়ং তাঁকেও আহত করেছিল। যে সব সাহাবী মক্কা থেকে হিজরত করে ইয়ামান, সিরিয়া, আবিসিনিয়া ও নজদ-এ আশ্রয় নিয়েছিলেন ওরা সেখানেও তাদের পেছনে লেগে থাকে। মক্কা বিজয়ের প্রাক্কালে রসূল (স)-এর চাচা হযরত হামযা (রা)-র হত্যাকারী ওয়াহশী, তাঁর বক্ষ বিদারণ করে কলিজা চর্বনকারিণী হিন্দ, ইকরামা ইবনে আবু জাহল, সাফওয়ান ইবনে উমাইয়া, কাব ইবনে যুহায়র এবং এদের মত অসংখ্য ইসলাম দুশমন শহরে বর্তমান ছিল। মহানবী (স) আজ এদের এক একটি অপকর্মের প্রতিশোধ নিতে সক্ষম ছিলেন। কিন্তু তিনি প্রতিশোধ গ্রহণে সক্ষম হওয়া সত্ত্বেও তাদের প্রাণভিক্ষা দেওয়ার জন্য সেনাবাহিনীর উদ্দেশ্যে নিম্নোক্ত ফরমান জারি করেন :

১. যারা অস্ত্র সমর্পণ করবে তাদের হত্যা করবে না;

২. যে ব্যক্তি কাবা ঘরের অভ্যন্তরে আশ্রয় নেবে তাকে হত্যা করবে না;

৩. যে ব্যক্তি আবু সুফিয়ানের বাড়িতে আশ্রয় নেবে তাকে হত্যা করবে না;

৪. যে ব্যক্তি নিজের বাড়িতে বসে থাকবে তাকে হত্যা করবে না;

৫. যে ব্যক্তি হাকীম ইবনে হিযামের বাড়িতে আশ্রয় নেবে তাকে হত্যা করবে না;

৬. পলায়নকারীদের পিছু ধাওয়া করবে না;

৭. আহত ব্যক্তিকে হত্যা করবে না।

মক্কা বিজয়ের পরে কাবার প্রাঙ্গণে জমায়েত জনতার উদ্দেশ্যে তিনি বলেন : “তোমরা কি জান আজ আমি তোমাদের সাথে কীরূপ ব্যবহার করব?” জনসমুদ্র থেকে সমস্বরে ধ্বনিত হল, “আপনি একজন সম্ভ্রান্ত ভাই এবং সম্ভ্রান্ত ভাইয়ের সন্তান।” মহানবী (স) জবাবে বলেন : “আজ তোমাদের উপর আমার কোন প্রতিশোধ স্পৃহা নেই, যাও তোমরা সবাই মুক্ত স্বাধীন” (কাযীমুহাম্মাদ সুলায়মান মনসূরপুরী, রহমাতুল লিল আলামীন, ১ম খণ্ড, পৃ. ১১৮)।

মক্কা মুআযযমায় তিনি ক্ষমা ও অনুগ্রহের যে অনুপম দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন পরবর্তী কালে তা ইসলামের যুদ্ধনীতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হয়ে আছে।

খুলাফায়ে রাশেদীনের আমলে সিরিয়া, ইরাক, ইরান, মিসর এবং রোমের যত অঞ্চল বিজিত হয়েছে সেগুলোতেও জয়লাভের পরে অনুরূপভাবে খুন-খারাবী ও রক্তপাত পরিহার করা হয়েছিল। হযরত আবু বাক্ (রা), হযরত উমার (রা), হযরত উসমান (রা) এবং হযরত আলী (রা) তাদের সেনাধ্যক্ষ ও প্রাদেশিক গভর্নরদেরকে এই প্রসঙ্গে যেসব নির্দেশনা ও ফরমান জারি করেছিলেন সেগুলো গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে স্পষ্টভাবেই অনুমিত হয় যে, এসব বিজয়ের উপর মক্কা বিজয়ের সাধারণ ক্ষমার কার্যকরী প্রভাব বিদ্যমান ছিল।

জীবনের নিরাপত্তা প্রসঙ্গে একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে- কখন থেকে এর প্রয়োগ হবে? পৃথিবীর সাধারণ আইনে ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর থেকে প্রাণের নিরাপত্তার অধিকার কার্যকর হয়। কিন্তু আল্লাহ্র আইনে মাতৃ উদরে গর্ভ সঞ্চার হওয়ার পর থেকেই প্রাণের মর্যাদার স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এই কারণে মহানবী (স) গামেদ গোত্রের এক নারীকে ব্যভিচারের সুস্পষ্ট স্বীকারোক্তি সত্ত্বেও হত্যার নির্দেশ প্রদান করেননি। কেননা সে তার জবানবন্দিতে নিজেকে গর্ভবর্তী ব্যক্ত করে। অতঃপর সন্তান প্রসব ও দুগ্ধ পানের সময়সীমা অতিক্রান্ত হওয়ার পর তাকে মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি দেওয়া হয়েছিল। তাৎক্ষণিকভাবে শাস্তি কার্যকর করলে অন্যায়ভাবে সন্তানের প্রাণ নাশের আশঙ্কা ছিল। ইসলামী আইন বিশারদগণ সন্তান গর্ভধারণের ১২০ দিনের মাথায় প্রাণের নিরাপত্তার অধিকার ধার্য করেছেন। কেননা এই সময়সীমায় গর্ভ সঞ্চার (Fetus) গোশত পিন্ডে রূপান্তরিত হয়ে মানুষের আকৃতি ধারণ করতে শুরু করে এবং তার উপর ‘মানুষ’ পরিভাষা প্রযোজ্য হয়। আমাদের ফকীহ্গণের এই অভিমত শত-সহস্র বছর পর আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানও স্বীকার করে নিয়েছে।

আমেরিকার সুপ্রীম কোর্ট রো বনাম ওয়েড (Roe Vs. Wade) – এর বিখ্যাত মামলায় আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান বিষয়ক তথ্যের বরাতে রায় দিয়েছে যে, মাতৃগর্ভে “মানব অস্তিত্ব”-কে গর্ভ ধারণের তিনমাস পরে আইনত স্বীকার করে নিতে হবে (আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রীম কোর্টের প্রতিবেদন, অক্টোবর ১৯৭২ খৃ., নিউইয়র্ক ১৯৭৪ খৃ., পৃ. ১৪৭)।

ইসলাম ইচ্ছাকৃতভাবে মানবসন্তানকে হত্যা করা কঠোর ভাষায় নিষিদ্ধ করেছে। নিরপরাধ জনগণকে গুলি করে, বোমা মেরে বা যাত্রীবাহী বাসে অগ্নিসংযোগে হত্যা করা, পুড়িয়ে মারা বা প্রাণহানি ঘটানো ইসলামের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। ইসলাম বিশ্বজনীন শান্তি, সম্প্রীতি ও মানবজাতির জন্য কল্যাণকামী পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। ‘ইসলাম’ অর্থ আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করে তাঁর আদেশ-নিষেধ মেনে চলার মাধ্যমে ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক জীবনে শান্তি ও নিরাপত্তা অর্জন। ধর্মপ্রাণ মুসলমানের পরিচয় তুলে ধরে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘প্রকৃত মুসলমান সেই ব্যক্তি, যার হাত ও মুখ থেকে অন্য মুসলমান নিরাপদ।’ (বুখারি ও মুসলিম) তাই পৃথিবীতে সত্য ও ন্যায়নীতির বাস্তব প্রতিফলনের মাধ্যমে সমাজজীবনে শান্তিশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা ও জনগণের জানমালের নিরাপত্তা বজায় রাখা ইসলামের দৃষ্টিতে অপরিহার্য কর্তব্য এবং ইমানি দায়িত্ব।

Read More

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked with *

সর্বশেষ পোস্ট

Advertising