728 x 90

যুদ্ধটা কার সাথে?

আসমা জাহান বাঁধন: এ কথা অনস্বীকার্য যে, ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টি না হলে বাংলাদেশ নামক কোন স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হতো না।  ভারতবর্ষে ১৯৩৫ সালে মুসলমানরা পৃথক নির্বাচন দাবির মাধ্যমে নিজেদের মুসলমানিত্ব টিকিয়ে রাখার যে প্রচেষ্টা চালিয়েছিল, ১৯৪৭ সালে সেটিই দ্বি-জাতিতত্ত্ব রূপে আত্মপ্রকাশ করে এবং তারই ধারাবাহিক সংগ্রামের ফসল হিসেবে মুসলমানদের জন্য পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের সৃষ্টি

আসমা জাহান বাঁধন: এ কথা অনস্বীকার্য যে, ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টি না হলে বাংলাদেশ নামক কোন স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হতো না।  ভারতবর্ষে ১৯৩৫ সালে মুসলমানরা পৃথক নির্বাচন দাবির মাধ্যমে নিজেদের মুসলমানিত্ব টিকিয়ে রাখার যে প্রচেষ্টা চালিয়েছিল, ১৯৪৭ সালে সেটিই দ্বি-জাতিতত্ত্ব রূপে আত্মপ্রকাশ করে এবং তারই ধারাবাহিক সংগ্রামের ফসল হিসেবে মুসলমানদের জন্য পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়।

আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, পাকিস্তান সৃষ্টির মূল স্লোগান ছিল ‘পাকিস্তান কি মতলব কিয়া- লাইলাহা ইল্লাল্লাহ’।  অর্থাৎ পাকিস্তানের মূলমন্ত্র বা চালিকা শক্তি হবে লাইলাহা ইল্লাল্লাহ এর চেতনা।  এই শ্লোগানের আওয়াযেই মানুষ ঈমানী প্রেরণা নিয়ে পাকিস্তান আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়েছিল।

কিন্তু স্বাধীন পাকিস্তান লাভের ঠিক পর মুহূর্তেই শাসকদের ইসলামের ব্যাপারে অনীহা, উদাসীনতা এবং মোনাফেকীর কারণে মুসলমানদের ঈমানী চেতনায় জং ধরতে থাকে।  ‘লাইলাহা ইল্লাল্লাহ’ হয়ে ওঠে অজানা অচেনা এক রুপকথা।  বৃটিশরা চলে গেলেও তাদের প্রতিষ্ঠিত শঠতায় পরিপূর্ণ সেক্যুলার শাসনব্যবস্থা ঠিকই বহাল তবিয়তে চলতে থাকে।  এমন কি নয়া পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী সেক্যুলার শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তনেরও কোন প্রয়োজন অনুভব করেনি।  ফলাফল হিসেবে পূর্ব ও পশ্চিম উভয় পাকিস্তানের জনগণ ইসলামী উম্মাহ চেতনা থেকে বেরিয়ে নিছক আঞ্চলিক ও ভাষা ভিত্তিক সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদে জড়িয়ে পড়ে।  শাসকরা হয়ে ওঠে জালিম ও বৈরী।  এর অনিবার্য পরিণতিতে এক পর্যায়ে স্বাধীন বাংলাদেশের সৃষ্টি হয়।

১৯৭১ থেকে ২০২৪ বহু ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাস গড়িয়ে চলে।  শেখ মুজিবুর রহমান মুসলমান বংশোদ্ভূত হলেও সংবিধানে সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা সংযোজন করে পূর্বসূরিদের অনুসরণে আরো একটি কঠিন সেক্যুলার রাষ্ট্র বানিয়ে সেখানে ইসলামের শেকড় কাটা শুরু করেন।  সেনা শাসক জিয়াউর রহমান ক্ষমতা গ্রহণ করেছিলেন ১৯৭৬ সালে।  নারায়ে তাকবীর- আল্লাহু আকবর ধ্বনি দিয়ে তিনিও মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে ধোঁকায় ফেলেছিলেন।  ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের স্লোগান ছিল ‘সিপাহি জনতা ভাই ভাই’, কিন্তু তাঁর শাসনামলেও মুসলমানরা ভাই ভাই হওয়ার কোন জায়গা খুঁজে পায়নি।

১৯৮২ সালে জেনারেল এরশাদ ক্ষমতা ছিনিয়ে নেয়।  ঘোষণা করে দেয় ‘ইসলাম হচ্ছে বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম’। ইসলাম হয়ে ওঠে কাগুজে ধর্ম।  মূলত এর মাধ্যমে এই স্বৈরশাসক বাংলাদেশে ইসলাম প্রতিষ্ঠার পথে কঠিন প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে।  ধোঁকা দেয় পনেরো কোটি মুসলমানকে।

এর পরের চিত্রে মুজিবকন্যা শেখ হাসিনা নামক এক নারী ড্রাকুলার উত্থান ঘটে বাংলাদেশের ইতিহাসে। তার স্লোগান ছিল, “লাইলাহা ইল্লাল্লাহ – নৌকার মালিক তুই আল্লাহ”; অর্থাৎ তার দল আওয়ামী লীগের দলীয় প্রতীক নৌকা হচ্ছে এমন এক পবিত্র ও মহান প্রতীক, যার হেফাজতকারী হচ্ছেন স্বয়ং আল্লাহ!  শুধু তাই নয়, হাসিনা তার দলের প্রতীক নৌকাকে হজরত নূহ (আ) এর নৌকার সাথে তুলনা করে চরম ধৃষ্টতা দেখাতে থাকে।  ফেরাউন, নমরুদ, আবু জাহেল ও আবু লাহাবকে পেছনে ফেলে চরম ইসলাম বিদ্বেষী এই মহিলা তার পিতা মুজিবের অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করতে বাংলাদেশের মাটিতে ইসলামকে কবরস্থ করার সকল আয়োজন সম্পন্ন করে চরম ধূর্ততা ও অতি নির্মমতার সাথে।  শুধু তাই নয় বাংলাদেশের শতকরা পঁচানব্বই ভাগ মুসলমানের দেশে ইসলামকে উৎখাত করে হাসিনা ও তার দল আওয়ামীলীগ পৌত্তলিকতার আমদানি ও তা প্রতিষ্ঠা করতে থাকে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায়।  কোরআন, হাদীসসহ ইসলামী বই-পুস্তককে চিহ্নিত করা হয় ‘জেহাদী বই’ এবং যে কোন ইসলামী কর্মকাণ্ডকে লেবেলিং করা হয় ‘জঙ্গি তৎপরতা’ বলে।  এক কথায় বিগত সতের বছর বাংলাদেশকে পরিণত করা হয়েছিল এশিয়ার গাজায়, যা বিশ্ববাসী আদৌ জানতে পারেনি।  প্রায় শতভাগ মুসলিম অধ্যুষিত একটি দেশে মুসলিম শাসকদের দ্বারা এরূপ বর্বর নির্যাতনের বিরল ইতিহাস কাউকে বিশ্বাস করানো মোটেই সহজ কোন কাজ নয়।

এক কথায় পাকিস্তান সৃষ্টি থেকে শুরু করে বর্তমান বাংলাদেশ পর্যন্ত সকল শাসকই ইসলামকে ব্যবহার করেছে মুসলমানদেরকে ধোঁকা দেয়া এবং ইসলামের উত্থানকে প্রতিহত করার জন্য।  মূলত এরাই পাক্কা হচ্ছে ধর্ম ব্যবসায়ী! নাম পরিচয়ে এরা মুসলিম হলেও বাস্তবে এরা ছিল মুনাফিকের উস্তাদ।

প্রশ্ন হচ্ছে আমরা যারা সাধারণ মুসলমান, আমরা আসলে কার সাথে লড়াই করছি? আমরা কি চিনতে পেরেছি মুসলমানদের আসল শত্রু কে? আমরা দেখছি ১৯৪৭ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত সময়ের ইতিহাস তেমন জটিল নয়।  সবগুলোই শাসকই ছিল সেক্যুলার, কেউ প্রকাশ্যে আবার কেই অপ্রকাশ্যে।  মূলত সৃষ্টির সূচনা থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত সকল সেক্যুলারই এক অভিন্ন বৈশিষ্ট্য লালন করে থাকে, আর তা হলো ইসলামের বিরুদ্ধাচারণ।  হোকনা সে পাকিস্তানি কিংবা বাংলাদেশী, তুরষ্ক কিংবা মিশর অথবা ভিন কোন দেশের।  এদের কোন দেশ, বর্ণ, গ্রোত্র, ভাষা কিংবা জাত, পাত নেই। ইসলাম উৎখাতে এরা পরস্পরের সহযোগী এবং ঐক্যবদ্ধ।   কি প্রাচ্য কিংবা পাশ্চাত্য- সর্বত্রই এদের কুচরিত্র এক ও সাযুজ্য।

এমন চিত্র কেবল বাংলাদেশ কিংবা শুধু পাকিস্তানেই নয় বরং প্রায় প্রতিটি মুসলিম দেশেই স্বাধীনতা আন্দোলনে যেসব মুসলমান নেতৃত্ব দিয়েছেন তারা সকলে মুসলমানদের ধর্মীয় আবেগকে সম্বোধন করেই কথা বলেছেন।  প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে গ্রিকরা যখন মধ্য এশিয়ার তুরষ্কে প্রবেশ করে তখন মোস্তফা কামাল পাশা এর প্রতিরোধে এগিয়ে এলেন।  তিনি তুর্কী জনতা ও সেনাবাহিনীর সামনে পবিত্র কোরআন উঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, হে তুর্কি মুসলমানবৃন্দ! আপনারা কি জানেন আমার হাতে এটি কি? সমস্বরে জবাব এলো, হ্যাঁ আমরা জানি এটি আল্লাহর কিতাব। তখন কামাল পাশা বললেন, যদি আপনারা এই পবিত্র  কোরআনের সম্মান রক্ষায় আমার সাথে মিলে মিশে যুদ্ধ না করেন তবে এই  পৃথিবী থেকে আল কোরআন নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।  আপনারা কি এমনটি চান? এই বলে সে তুর্কী মিলিটারী ও জনগণকে উত্তেজিত করেছিল।  সৈনিক-জনতা মিলেমিশে প্রাণপণ লড়াই করে শক্তিমান গ্রীসকে পরাজিত করে।  এর পরের করুণ ইতিহাস আমরা জানি।    কামাল পাশা যেই আল কোরানের দোহাই দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল, সেই কোরআনকেই তুরষ্কের মাটিতে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে এবং ইসলামী খেলাফতের শেষ ভূখণ্ড তুরস্ক থেকে ইসলামের নাম নিশানা উপড়ে ফেলে।

‘খাদেমুল হারামাইন আশ শারিফাইন’ টাইটেল গলায় লাগিয়ে পবিত্র মক্কা ও মদীনা নিয়ে ব্যবসাও বিশ্ববাসীর চোখের সামনেই ঘটছে। ইসলামকে বিকৃত করার হীন অপচেষ্টা এসব পবিত্র ভূখণ্ড থেকেই করা হচ্ছে।

ইতিহাস সাক্ষী  মুসলমান পরিচয়দানকরী সেক্যুলার শাসকগোষ্ঠী ইসলাম ও মুসলমানদের যত ক্ষতি সাধন করেছে, পৃথিবীর অন্যান্য সকল কাফির মোশরেক সকলে সম্মিলিতভাবেও মুসলমানদের সে পরিমাণ ক্ষতি করতে সক্ষম হয়নি।  কারণ নামে মুসলমান হলেও বাস্তবে ইসলামের সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিধানকে এরা মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।  মৌখিকভাবে মহানবীকে (সা)  এরা নেতা মানলেও প্রকৃত অর্থে তাদের নেতা হচ্ছে কাফের ও মোশরেক শাসক শ্রেণীর কেউ।

তাই ঈমানদার মুসলমানদের উচিত হবে কেবলমাত্র সেক্যুলার শাসকদের অপসারণ নয় বরং সেক্যুলার শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সংগ্রাম অব্যাহত রাখা।  আমাদের শপথ হবে একইসাথে সেক্যুলার শাসক, রাষ্ট্র ও ব্যবস্থার বিরুদ্ধে।  এ সংগ্রামে যারা ইসলামকে বিজয়ী দেখতে চান তাদের তাকওয়ার ভিত্তিতে একতাবদ্ধ হওয়া ছাড়া আর কোন বিকল্প আছে কি?

 

 

আসমা জাহান বাঁধন, অটোয়া, ক্যানাডা

 

Read More

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked with *

সর্বশেষ পোস্ট

Advertising