- ড. ফারুক আমিন
আগষ্ট মাসের ৫ তারিখ দুপুরে বাংলাদেশের মানুষ এক অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখলো। অনেক দূর থেকে ধারণ করা ঝাপসা ভিডিও দৃশ্যে দেখা গেলো তথাকথিত পরাক্রমশালী শাসক শেখ হাসিনা একটি হেলিকপ্টারের পাশে দাঁড়ানো কয়েকটি গাড়ির পাশে হাঁটছে। সারা দেশে এবং দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে পুরো বিশ্বের দেশে দেশে প্রবাসী বাংলাদেশীদের মাঝে বিদ্যুৎগতিতে খবর ছড়িয়ে গেলো। দীর্ঘ সাড়ে পনেরো বছরের প্রতীক্ষার অবসান হয়েছে। ছাত্রজনতা যখন নিশ্চিত মৃত্যুকে উপেক্ষা করে, স্নাইপার ও ঘাতকদের বুলেটকে পরোয়া না করে গণভবনের দিকে যাত্রা করেছে, ক্ষমতা দখল করে রাখা জনবিচ্ছিন্ন প্রধানমন্ত্রীটি নিজ অনুগত মন্ত্রী, এমপি, নেতা-কর্মী, আমলা, পুলিশ সবাইকে ফেলে এবং কাউকে কিছু না জানিয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছে।
বাংলাদেশে শেখ হাসিনা ও তার অনুসারীরা এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলো। ফ্যাসিবাদের থাবায় দেশের সংস্কৃতি, সমাজ, শিক্ষা থেকে অর্থনীতি, ধর্ম; প্রতিটি খাতই মেধাশুন্যতা ও দুর্নীতিতে জর্জরিত হয়ে পড়েছিলো। দেড় দশকের অনাচারে বাংলাদেশ যে খাদে পড়েছে, কেউ প্রত্যাশা করে না যে রাতারাতি সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু দেশের মানুষ অন্তত আশা করেছিলো বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়াবে। ফ্যাসিবাদের কলংক থেকে মুক্তির জন্য দেশ নতুন পথে যাত্রা করবে। নতুন সরকার শপথ নেয়ার তিন মাস অতিবাহিত হওয়ার পর এখন অন্তত প্রশ্ন করার সময় এসেছে, বাকশালী ফ্যাসিবাদীদের তৈরি করে যাওয়া সংকট থেকে উত্তরণের পথে দেশ কতটুকু এগুতে পেরেছে?
দুই হাজার চব্বিশের আগষ্টে বাংলাদেশ থেকে আওয়ামী ফ্যাসিবাদের বিতাড়ন একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। ঊনিশশ একাত্তর সালে বাংলাদেশের মানুষ বিদেশী প্রভূদের দখল থেকে মুক্তি পেয়েছিলো। চব্বিশে তারা মুক্ত হয়েছে স্বজাতির প্রভূদের দখল থেকে। অনেক দিক থেকেই চব্বিশের স্বাধীনতাকে একাত্তরের স্বাধীনতা থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই এই ঘটনাকে অনেকে বাংলাদেশের মানুষের দ্বিতীয় স্বাধীনতা হিসেবে আখ্যা দিয়েছিলো। কিন্তু শুরু থেকেই দেখা গেলো এক শ্রেণীর মানুষ বলতে শুরু করলো একাত্তরের সাথে অন্য কিছু তুলনা হয় না। যে একাত্তর বা মুক্তিযুদ্ধের ব্যবসা করে আওয়ামী লীগ তাদের দীর্ঘদিনের ক্ষমতা দখলের নায্যতা তৈরি করেছিলো, সেই মুক্তিযুদ্ধ ব্যবসারই ধারাবাহিকতা হলো এই বক্তব্য। শুরুতেই বুঝা গেলো ফ্যাসিবাদের মূল প্রতীক শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছে বটে, কিন্তু বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদের প্রাণভোমরা এখনো জীবিত রয়ে গেছে।
এরপর বিগত আগষ্ট, সেপ্টেম্বর এবং অক্টোবর এই তিন মাসে বাংলাদেশের মানুষ একের পর এক নানা অস্থিরতা এবং অপ্রয়োজনীয় সংকট দেখে যাচ্ছে। শেখ মুজিবুর রহমান জাতির পিতা কি না তা নিয়ে তরুণ উপদেষ্টাকে কথা বলতে হয়েছে। বিজয়ের প্রথম মূহুর্তে যেখানে দেশের মানুষ স্বতঃস্ফুর্তভাবে সারা দেশজুড়ে বানানো বিশাল বিশাল মুজিব-মুর্তিকে ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিয়েছে, বাংলাদেশের প্রথম স্বৈরশাসক যেই মুজিবের নামে দেশে আবারও স্বৈরশাসন প্রতিষ্ঠা হয়েছিলো, সেই মুজিবের কোন স্থানই তো নতুন বাংলাদেশে থাকার কথা ছিলো না। তারপর দেখা গেলো সংবিধান সংস্কার নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে। শেখ হাসিনা পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করেছে কি না তা নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে। হাসিনার অনুগত ভৃত্য এবং রেখে যাওয়া রাষ্ট্রপতি পদে বসে থাকা ভাঁড়টিকে নিয়ে নানা আলোচনা হচ্ছে। পুলিশ বাহিনীর অকর্মা অবস্থা নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে। আন্দোলনে নিহত ও আহত মানুষদের প্রতি রাষ্ট্রের দায়িত্ব নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের মতো সন্ত্রাসী দলগুলোকে নিষিদ্ধ করা হবে কি না তা নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে। এমন সব বিতর্কের বিষয় এবং সংকটের তালিকা অনেক দীর্ঘ, কিন্তু একই সাথে সমাধানের গতি ততটা দ্রুত নয় বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে।
বাংলাদেশের বর্তমান এই অবস্থা এবং অস্থিরতার মূল কারণ হলো নতুন সরকারে এবং দেশের ক্ষমতার বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের মাঝে হাসিনার প্রেতাত্মা এখনো জীবিত রয়ে গেছে। হাসিনা পালিয়ে গেছে ঠিকই, কিন্তু হাসিনা নামের অসুখের বীজ এখনো উপড়ে ফেলা যায়নি। বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনরা এই গণঅভ্যুত্থানকে, জনগণের অতুলনীয় আত্মত্যাগকে ধারণ করতে পারেনি। তারা নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে নিজেদেরকে ঐকান্তিক করে তুলতে পারেনি।
অতীতমুখী অর্থহীন ও ব্যার্থতাপ্রবণ রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে বদলে ফেলে নতুন দিনের রাজনীতি করার কথা কিন্তু ড. ইউনুস বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন জাতীয় রাজনীতিকে রিসেট করার কথা। কিন্তু সেখানেও ফ্যাসিবাদের প্রেতাত্মারা ভীড় জমিয়ে অর্থহীন বিতর্কের আসর বসিয়ে দিয়েছিলো। চব্বিশের অভ্যুত্থানকে স্বার্থক ও সফল করতে হলে, অসংখ্য মানুষের ত্যাগকে মূল্যায়ন করতে হলে আজ বাংলাদেশে একটি শক্তিশালী ও প্রত্যয়ী নেতৃত্বে বড় প্রয়োজন। যে নেতৃত্ব কোন দ্বিধা ও সংশয় ছাড়া নতুন বাংলাদেশ গড়ার জন্য কাজ করতে সর্বোতভাবে প্রস্তুত। বাংলাদেশের সামনে আজ এমন সুযোগ এসেছে যা কোন দেশ ও সমাজের ইতিহাসে খুব কমই আসে। দেশের খোলনলচে বদলে ফেলে নতুন বাংলাদেশ গড়ার চিন্তা না করলে ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য একটি উত্তম দেশ ও সমাজ যেমন আমরা রেখে যেতে পারবো না, তেমনি চলমান সংকটগুলোও কাটবে না বরং একটির পর একটি নতুন সমস্যা আসতেই থাকবে। এসব সমস্যাগুলো আদতে অর্থহীন ও অপ্রয়োজনীয়। এদেরকে কোন গুরুত্ব না দিয়ে সঠিক লক্ষ্যের দিকে অটুট থাকলেই বাংলাদেশে যে কোন সরকার সফলতা অর্জন করতে পারবে। তখনই সম্ভব হবে বাংলাদেশ থেকে ফ্যাসিবাদকে সমূলে উৎপাটন করে ইতিহাসের আবর্জনায় নিক্ষেপ করা।