কচ্ছপের পিঠে ভর করে তিন বছর পূর্ণ হলো গফুর কসাইকে দেয়াড়া বাজারে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। নিষিদ্ধ বলতে, সে এই বাজারে আর কোনদিন মাংস বিক্রি করতে পারবে না। বাজারে আসা-যাওয়ার ক্ষেত্রে কোন বাধ্যবাধকতা নেই। গফুর কসাই তা সবই জানে। তবুও মনের দুঃখে সে বাজারের ভেতরে সেই থেকে একদিনও যায়নি। বহুদিনের অভ্যাস বদলাতে পারে না বলে
কচ্ছপের পিঠে ভর করে তিন বছর পূর্ণ হলো গফুর কসাইকে দেয়াড়া বাজারে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। নিষিদ্ধ বলতে, সে এই বাজারে আর কোনদিন মাংস বিক্রি করতে পারবে না। বাজারে আসা-যাওয়ার ক্ষেত্রে কোন বাধ্যবাধকতা নেই। গফুর কসাই তা সবই জানে। তবুও মনের দুঃখে সে বাজারের ভেতরে সেই থেকে একদিনও যায়নি। বহুদিনের অভ্যাস বদলাতে পারে না বলে বাজারে ঢোকার মুখে প্রথম চায়ের দোকানে সময় কাটিয়ে বাড়িতে ফেরে দুপুর গড়িয়ে যাবার পরেই। মাঝে মাঝে দু’এক কাপ চা পান করে সত্য; তবে তা সময়ের হিসাবে অপ্রতুল। প্রতিনিয়ত এভাবেই চলে তার কষ্ট বিলাস। যে কষ্ট তাকে কুঁরে কুঁরে খায় এবং তা উপলব্ধি করে পরম তৃপ্ততায়। ছেলেটা তাকে অনেকবার বুঝিয়েছে, চায়ের দোকানে না যাবার জন্যে। কোন কথায় কোন কাজ হয় না। সে সবার অলক্ষ্যে বাড়ি থেকে বের হয়। মনে প্রাণে বিশ্বাস করে, যে অপরাধে তাকে বাজারে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, সে অপরাধ সেতো করেইনি।
এক সময় তার সংসার ছিল বেশ স্বচ্ছল। অভাব বলতে কী তা পরিবারের কেউ বুঝতো না। এখন, বিশেষ করে বিগত তিনটি বছর কেটেছে খেয়ে না খেয়ে। মাঝে মধ্যে শুক্রবারে গ্রামের তিন রাস্তার মোড়ে একটা গরু জবাই করলেও অধিকাংশ মাংস বাকীতে বিক্রি হয়। সে টাকা উদ্ধার করতে জুতার সুখতলা ক্ষয় হয়ে বাপ বেটার পা মাটি স্পর্শ করে। আসলে গ্রামে মাংস বিক্রি করে সেই টাকা সহজে উদ্ধার করা একপ্রকার অসম্ভব। যা সে জানে। তারপরও সে মাঝে মধ্যে এটা করে। না হলে যে, স্ত্রী- সন্তান নিয়ে পথে বসতে হবে! বড় ছেলে মোবারক তাকে সবসময় ছায়াসঙ্গীর মতো সহযোগিতা করে। ছেলের ভরসায় সে বাকীতে মাংস বিক্রি করতে পারে; না হলে তার পক্ষে গ্রাম্য ব্যবসা ছিল অসম্ভব। বয়স হয়েছে। তার ওপর এই ক’বছরে বিভিন্ন চিন্তায় চিন্তায় শরীর ভেঙে বুড়ি ভৈরবের সাথে মিশেছে। নানা রকম অসুখ বিসুখ অক্টোপাসের মতো চারিদিক দিয়ে ধেয়ে আসছে তার দিকে। এখন ছেলেই তার একমাত্র ভরসা।
দেয়াড়া বাজারে তিনটে মাংসের দোকান। গফুর কসাই প্রতিদিন একটা গরু জবাই করতো। শুক্রবারে দু’তিনটা পর্যন্ত জবাই করতে হয়েছে মাংসের চাহিদা অনুযায়ী। অন্যের চেয়ে দশ-পনের টাকা কেজিতে কম থাকায় তার মাংসের চাহিদা ছিল বেশি। অথচ কী কুক্ষণে যে এমন একটা কান্ড সেদিন ঘটে গিয়েছিল তা আজও বুঝে আসেনি গফুর কসাইয়ের।
শনিবারে চাঁড়াভিটার হাট থেকে একশ’ বিশ কেজি তাক করে একটা বকনা গরু কিনে আনে সে। রবিবার ভোর পাঁচটায় বাজারে এসে গরুটাকে জবাই করে মাংস কাটার প্রক্রিয়া শুরু করে। এমন সময় গরুর পেটে বাচ্চা দেখে সে হতভম্ব হয়ে যায়। এটা কীভাবে সম্ভব! গরুর মালিক বলেছিল পেটে বাচ্চা নেই। যদি পেটে বাচ্চা থাকে তাহলে গরুর দাম দেড় গুণ বেশি হয়! মালিকের কাছ থেকে নিশ্চিত হয়েই তবে গরুটি কেনে গফুর কসাই। তাছাড়া সে ছেলেবেলা থেকেই গরু কেনায় সিদ্ধহস্ত। গরু দেখেই বলে দিতে পারে কোন গরুর মাংস কতটা হবে, বয়স কত, দাঁত কয়টা, পেটে বাচ্চা আছে কী না ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু কী হতে কী হয়ে গেল তা সে বুঝতেই পারে না। মোবারক অবস্থা বেগতিক দেখে বলে, ‘আব্বা, লোকজন আসার আগেই বাছুরডা মাটিতি পুতে ফেলে গোসত কাটার কাজ সারে ফেলি।’ গফুর কসাই বলে, ‘অসম্ভব! এমন অধর্মর কাজ কহনও করা যাবে না।’ সে বাছুরসহ সব মাংস মাটিতে পুতে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়।
ভোরের আলো ফুটতেই কাদের মাঝি সেখানে উপস্থিত হয়। সে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের ঘনিষ্ট বলে পরিচিত। শুধু পরিচিত বললেই ভুল হবে, স্বয়ং চেয়ারম্যান তাকে গরু তদারকিতে নিয়োজিত করেছে। গরু অসুস্থ কি না বা কে কয়টা গরু জবাই করছে তা দেখার দায়িত্ব কাদের মাঝির। বিনিময়ে গরু প্রতি তাকে একশত টাকা দিতে হবে। এই একশত টাকা দিলেই মিলবে গরু জবাই করার অনুমতি!
ঘটনা ধামাচাপা দেবার জন্যে গফুর কসাইয়ের কাছে বিশ হাজার টাকা দাবী করে কাদের মাঝি। এ দুর্ঘটনায় তার কোন অপরাধ নেই ভেবে টাকা দিতে অস্বীকার করে সে। কাদের মাঝি তখনি ফোন করে দলীয় লোক জড়ো করে গফুর কসাইকে ধরে বাজার কমিটির অফিসে নিয়ে যায়। ইতিমধ্যে এলাকায় রটে গেছে- ‘গফুর কসাই নিয়মিত বাছুরসহ গরু জবাই করে মাংস বিক্রি করে। আজ হাতে নাতে ধরা খেয়েছে!’ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বাজার কমিটির অফিসে আসে। সে বাজার কমিটির সকলের উপস্থিতিতে গফুর কসাইকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে তাকে সেদিন থেকে বাজারে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। সেই থেকে তার বাজারে মাংস বিক্রি করা বন্ধ হয়ে যায়।
আজ বাজারে ভোক্তা অধিকারের ম্যাজিস্ট্রেট হানা দিলে গফুর কসাইয়ের যেন কপাল খুলে যায়। ম্যাজিস্ট্রেট মাংসের দোকানে অভিযান পরিচালনা করে দুটো দোকান থেকে দুই মনের বেশি ফ্রিজে রাখা পঁচা মাংস উদ্ধার করে। তাৎক্ষণিকভাবে এক দোকানের কর্মচারীকে আটক করলে পাশের দোকানদার দোকান ফেলে দৌঁড়ে পালিয়ে যায়। ম্যাজিস্ট্রেট পালিয়ে যাওয়া কসাইকে ত্রিশ হাজার আর আটককৃত কর্মচারীর মালিককে পনের হাজার টাকা জরিমানা করে। চলে যাবার সময় জানায়, অভিযুক্ত দু’জন বাজারে আগামীতে মাংস বিক্রি করতে পারবে কি না সে সিদ্ধান্ত নেবে বাজার কমিটি ও স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ।
রাত আটটায় বাজার কমিটি জরুরী আলোচনায় বসেছে। কিছু দোকানদারসহ সাধারণ হাটুরেদের অনেকে সেখানে উপস্থিত। সাধারণ কসাই হলে হয়তো বাজার কমিটি এত গুরুত্ব দিয়ে আলোচনায় বসতো না। যাদের কাছ থেকে পঁচা মাংস উদ্ধার করেছে তারা দু’জনেই দলীয় কর্মী। ইউপি চেয়ারম্যান আর বাজার কমিটির সদস্যরা সবাই একই দলের। সে কারণে এই অবস্থায় কারো পক্ষে বসে থাকা সম্ভব হয়নি!
আলোচনায় আগামীতে পঁচা মাংস বিক্রি করবে না মর্মে মুচলেকা নিয়ে তাদেরকে এবারের মতো ক্ষমা করা হয়। ভিড়ের ভেতর থেকে একজন বলে ওঠে, গফুর কসাই না জেনেই বাছুরসহ গরু জবাই করায় তাকে বাজারে নিষিদ্ধ করা হয়েছে তিন বছর আগে। সে আদেশ এখনও বলবৎ আছে। তাদের এখন খেয়ে না খেয়ে দিন চলে। তাহলে সে কেন ক্ষমা পাবে না? জেনেশুনে পঁচা মাংস বিক্রি করে যদি সহজেই ছাড়া পেয়ে যায়, তাহলে না জেনে একটা ভুল করায় তার সাজা এত বেশি হয় কীভাবে?
প্রশ্নটিতে মন গলে চেয়ারম্যানের। তাৎক্ষণিক গ্রাম পুলিশ দিয়ে গফুর কসাইকে ডেকে আনা হয়। তার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়েছে জানালে খুশিতে তার দু’চোখ জলে ভিজে যায়।
তিন বছর মানবেতর জীবনের বুঝি অবসান হতে চলেছে। ধার দেনা করে হলেও হয়তো আবারো ঘুরে দাঁড়াতে পারবে। সমস্ত ক্লান্তি- সমস্ত অবসাদ দূর হয়ে যাবে ক’দিন পরেই। নতুন করে ফুলে ফলে সুশোভিত হয়ে উঠবে গফুর কসাইয়ের জীবন। সে নতুন উদ্দিপনা আর চোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে পরেরদিন সকালে ছেলের সাথে দেয়াড়া হাটে এসে যখন জানতে পারে তার মাংসের দোকান বহু আগেই দলীয় এক নেতা দখল করে নিয়েছে তখন হঠাৎই তার শরীর বেয়ে দরদর করে ঘাম ঝরতে থাকে।
Leave a Comment
Your email address will not be published. Required fields are marked with *