রাকিব হোসেন মিলন: রবির বয়স মাত্র ১৬। বয়সটা তার কৌতূহল আর স্বপ্নে ভরে থাকার কথা। কিন্তু রবির জীবন সেই স্বাভাবিকতায় নেই। পড়াশোনা বাদ দিয়ে সে এখন একটি কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য। কখনো বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা, কখনো মাদক বহন করা, আবার কখনো এলাকার প্রভাবশালী কারও নির্দেশে ভয়ভীতি দেখানো—এসবই তার কাজ। কিশোর গ্যাংয়ে মিশে রবির মতো অনেক তরুণ হারিয়ে যাচ্ছে অন্ধকার জীবনের দিকে।
কিশোর বয়সে মনের অবস্থা অত্যন্ত সংবেদনশীল। পরিবারের অবহেলা, সময় না দেওয়া কিংবা নৈতিক শিক্ষার অভাব কিশোরদের বিপথে নিয়ে যায়। অনেক সময় কিশোররা স্রেফ বন্ধুবান্ধবের চাপ কিংবা মজার খাতিরেও এসব গ্যাংয়ে যুক্ত হয়। মাদকের সহজলভ্যতা এবং সমাজের নেতিবাচক প্রভাব তাদের অন্ধকার জগতে টেনে নেয়।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এসব গ্যাং সদস্যরা নানাভাবে অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু তারা বুঝতে পারে না যে এই পথ তাদের জন্য কেবল ধ্বংসের দরজা খুলে দিচ্ছে।
মোহনের মা প্রায়ই বলেন, “আমার ছেলে খুব ভালো ছিল। কিন্তু এলাকার কিছু ছেলের সঙ্গে মিশে সে বদলে গেল। আমরা বুঝতেও পারিনি কখন সে হাত থেকে ফসকে গেল।” মোহনের গল্প আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখায় যে পরিবারের ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
পরিবার যদি সন্তানের সঙ্গে বন্ধুর মতো আচরণ করে, তাদের সময় দেয় এবং তাদের চিন্তাভাবনা বুঝতে চেষ্টা করে, তাহলে কিশোররা এমন ভুল পথে পা দেয় না।
সমাজেরও বড় ভূমিকা রয়েছে কিশোরদের সঠিক পথে রাখার ক্ষেত্রে। কিন্তু বর্তমান সমাজ অনেক ক্ষেত্রেই উদাসীন। এলাকার কিছু বড় ভাই বা গ্যাং লিডারদের কারণে কিশোররা ভুল পথে যাচ্ছে। স্কুল ও স্থানীয় ক্লাবগুলো যদি ক্রীড়া, সাংস্কৃতিক এবং সৃজনশীল কাজের আয়োজন করে, তাহলে কিশোরদের এই অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে আসা সম্ভব বলে মনে করছি।
দীর্ঘ সময় গণমাধ্যমে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি কিশোর গ্যাং দমনে পুলিশ বাহিনী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এ বিষয়ে বলা যায় পুলিশ বাহিনী রীতিমতো দুশ্চিন্তায় রয়েছে। তারা নিয়মিত অভিযান চালিয়ে কিশোর গ্যাংয়ের নেতাদের গ্রেপ্তার করছে এবং কিশোরদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করছে। সম্প্রতি অনেক এলাকায় পুলিশ জনসচেতনতা কার্যক্রম চালাচ্ছে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে কিশোরদের সঙ্গে কথা বলছে। পুলিশের পক্ষ থেকে কিশোর গ্যাংদের বিভিন্ন গ্রুপের সাথে বিভিন্ন সময় কাউন্সেলিং প্রোগ্রাম করতে দেখেছি। এতে কিছুটা হলেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এসেছে। আইনশৃঙ্খলার উন্নয়নে পুলিশের এই উদ্যোগ অত্যন্ত প্রশংসনীয়।
পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্র যদি একসঙ্গে কাজ করে, তবে কিশোরদের অন্ধকার থেকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। এখানে সংক্ষিপ্ত পরিসরে কিছু দায়িত্ব নিয়ে কথা বলতেই হবে। আমরা যদি পরিবার, সমাজ দায়িত্ব এড়িয়ে চলি তাহলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একার পক্ষে এ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। আমরা যদি সত্যিকার অর্থে দায়িত্বশীল না হই তাহলে কিশোর গ্যাং সমস্যা বাড়তেই থাকবে, যা অত্যন্ত বিপদজনক। তাই সমাধানের কিছু দিক উল্লেখ করলাম।
পরিবারের দায়িত্ব: সন্তানের প্রতি মনোযোগ দেওয়া, সন্তানদের কে সময় দেওয়া, তাদের সাথে বন্ধুর মতো পাশে থাকা এবং তাদের মধ্যে নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ গড়ে তোলা।
সমাজের ভূমিকা: ক্রীড়া, সংস্কৃতি এবং সৃজনশীল কার্যক্রম বাড়ানো।
পুনর্বাসন কেন্দ্র: কিশোর গ্যাং থেকে উদ্ধার হওয়া কিশোরদের জন্য সঠিক পুনর্বাসনের ব্যবস্থা।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উদ্যোগ: কিশোর গ্যাং নির্মূলের পাশাপাশি গ্যাংয়ের মূল হোতাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া।
আমাদের সন্তানরা যেন রবি আর মোহনের মতো হারিয়ে না যায়, তার জন্য এখনই সচেতন হতে হবে। বাংলাদেশে এরকম হাজারো রবি ও মোহনের মতো দুর্ভাগ্যজনক গল্প রয়েছে। কিশোরদের স্বপ্নময়, সৃষ্টিশীল, ইতিবাচক এবং সুন্দর জীবন উপহার দেওয়ার দায়িত্ব আমাদের সবার। এই কর্মযজ্ঞে আমরা সবাই যদি একসঙ্গে কাজ করি, তবে কিশোর গ্যাং মুক্ত সুন্দর, শান্তিময় সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব।