বর্তমান বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়নে নারীদের ভূমিকা

আয়শা সাথী: নারীর ক্ষমতায়ন বলতে এমন একধরনের অবস্থাকে বোঝায়, যে অবস্থায় নারী তার জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত প্রতিটি ক্ষেত্রে স্বাধীন ও মর্যাদাকর অবস্থায় উন্নীত হতে পারে। নারীর ক্ষমতায়নে বিশ্বের রোল মডেল হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। নারীর রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে বাংলাদেশের অগ্রগতি সারা বিশ্বে আজ প্রশংসিত। ঘরে-বাইরে, রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে সর্বত্রই নারীর অংশগ্রহণ অনেকাংশে নিশ্চিত হয়েছে। কর্মক্ষেত্রে নারীরা দক্ষতা প্রমাণ করছেন, কৃতিত্ব দেখাচ্ছেন, নেতৃত্বও দিচ্ছেন । মুক্তিযুদ্ধপূর্ব ১৭৫৭ সাল থেকে ১৯৫২, ১৯৫৪, ১৯৬৬,১৯৬৯ কিংবা ১৯৭০ এর ইতিহাস ঘাটলে বাঙালি নারীদের যথেষ্ট রাজনৈতিক সক্রিয়তার প্রমাণ পাওয়া যায়। ১৯৭১, ১৯৯০ এবং ২০২৪ সালে সহস্র ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও অধিকার আদায়ের  জন্য পুরুষের পাশাপাশি অসংখ্য নারী যোদ্ধা সংগ্রামে বিভিন্নভাবে অংশ নিয়ে প্রমাণ করেছিলেন- তাঁদের অবদানও সমান গৌরবের। ২০২৪ সালের তথ্যানুযায়ী নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ বিশ্বে সপ্তম স্থানে। যে জনসমষ্টির অর্ধেকেরও বেশি নারী সেখানে নারীদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন ছাড়া সমাজের পূর্ণ বিকশ সম্ভব নয়। নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করার জন্য আমাদের সংবিধানের ২৮(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, রাষ্ট্র ও জনজীবনের সর্বত্র নারী পুরুষ সমান অধিকার লাভ করবে। ২০২৪ সালে জাতীয় সংসদে নারীদের জন্য ৫০টি সংরক্ষিত আসন ও নির্বাচিত ২২ জনসহ মোট ৭২ জন নারী সংসদ সদস্য ছিলেন। স্থানীয় পর্যায়ে ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত নারী প্রতিনিধিও ছিলেন ১২ হাজার জনেরও বেশি। নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ সরকার ব্যাপক অগ্রগতি অর্জন করেছে। ২০২০ সাল নাগাদ সকল রাজনৈতিক দলের কমিটিতে ৩৩ শতাংশ নারী সদস্য রাখার বিষয়টি বাধ্যতামূলক করা, প্রতিটি উপজেলা পরিষদে একজন নির্বাচিত মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানের পদ সৃষ্টি করা এবং তৃণমূল পর্যায়ে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে ৩৩ শতাংশ আসন নারীর জন্য সংরক্ষিত রাখা ছিল নারীদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের বিষয়টি নিশ্চিতকরণের লক্ষে ।

২০২০ সালের এক তথ্য অনুযায়ী ওই বছর বাংলাদেশে কর্মজীবী নারীর সংখ্যা ১৬.২ মিলিয়ন থেকে ১৮.৬ মিলিয়নে উন্নীত হয়েছিলো , গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ ইনডেক্স রিপোর্ট ২০২০ অনুযায়ী  ২০২০ সালে দক্ষিণ এশীয় সাতটি দেশের মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশ শীর্ষ ১শটি দেশের তালিকায় স্থান পেয়েছিলো যেখানে বিশ্বের ১৫৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিলো ৫০তম।এই প্রতিষ্ঠানটির  ২০১৭ সালের রিপোর্ট অনুসারে, ১৪৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের সার্বিক অবস্থান ছিল ৪৭তম, যা দক্ষিণ এশিয়ার যেকোনো দেশের চেয়ে ভালো অবস্থান নির্দেশ করে। নারী অধিকার ও ক্ষমতায়নে প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে তো বটেই, উন্নত অনেক দেশ থেকেও এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ  সংবিধানের ১৯(৩) অনুচ্ছেদে জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে নারীদের অংশগ্রহণ ও সুযোগের সমতা রাষ্ট্র কর্তৃক নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। নারীদের যথার্থ মর্যাদা প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি অর্থনৈতিক, সামাজিক, প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে ব্যাপক কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে । নারী উন্নয়নের অন্যতম সূচক হচ্ছে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) মতে, দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) নারীর অবদান প্রায় ২০ শতাংশ। সে হিসেবে বাংলাদেশে শুধু পোশাক খাতে আট মিলিয়ন শ্রমিকের মধ্যে ৭০-৮০ ভাগ নারী।  দেশের আরেকটি বৃহত্তম সেবা খাত স্বাস্থ্যসেবায়  কর্মরতদের মধ্যে ৭০ শতাংশেরও বেশি নারী। সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের সফল বাস্তবায়নের ফলে নারী উন্নয়ন আজ সুস্পষ্টভাবে দৃশ্যমান। এককথায়  রাজনীতি, বিচার, প্রশাসন, কূটনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, সশস্ত্র বাহিনী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, শান্তিরক্ষা মিশনসহ সব ক্ষেত্রে নারীর সফল অংশগ্রহণের মাধ্যমে দেশ ক্রমান্বয়ে উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে।

নারী-পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠায় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ।নারীর ক্ষমতায়নে বেশ কিছু আইননীতি ও বিধিমালা তৈরি করেছে সরকার। বর্তমানে বিচারপতি, সচিব, ডেপুটি গভর্নর, রাষ্ট্রদূত, থেকে শুরু করে মানবাধিকার কমিশনের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করছেন নারী। বাংলাদেশে  নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন নিয়ে সন্দেহের আর কোনো অবকাশ নেই। নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ বিশ্বে সপ্তম স্থানে। বাংলাদেশে আড়াই দশকেরও বেশি সময় ধরে নারী নেতৃত্ব দেশ পরিচালনা করছেন। দেশের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী এবং জাতীয় সংসদের স্পিকার নারী- এমন দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে বিরল। জাতিসংঘের এমডিজি অ্যাওয়ার্ড, প্ল্যানেট ৫০-৫০ চ্যাম্পিয়ন, গ্লোবাল উইমেন লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড, এজেন্ট অব চেঞ্জ, সাউথ-সাউথ অ্যাওয়ার্ড, শিক্ষায় লিঙ্গসমতা আনার স্বীকৃতিস্বরূপ ইউনেসকোর ‘শান্তি বৃক্ষ’ এ্যাওয়ার্ডসহ অসংখ্য আন্তর্জাতিক পুরস্কার অর্জন করেছে বাংলাদেশ। কিছু হতাশা থাকলেও নারীর ক্ষমতায়নে দেশের অর্জন অনেক।সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিকভাবে দেশের নারীদের বেশ কয়েকটি সাফল্য রয়েছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে ICDDRB এর মিউকোসাল ইমুনোলজি অ্যান্ড ভ্যাকসিনোলজি ইউনিট অব ইনফেকসিয়াস ডিজিসেস ডিভিশনের প্রধান বাংলাদেশের নারী বিজ্ঞানী ড. ফিরদৌসি কাদরি উন্নয়নশীল দেশের শিশুদের সংক্রামক রোগ সম্পর্কে গবেষণার জন্য ২২তম ল’রিয়েল-ইউনেসকো ফর ওমেন ইন সায়েন্স অ্যাওয়ার্ড অর্জন, মাহজাবিন হক নামের আরেক বাংলাদেশি নারীর যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান নাসায় যোগদান, ফাতেমা জাহারা নামক বাংলাদেশী নারী খেলোয়াড়ের অস্ট্রেলিয়ার লিজেন্ডারি নিউ সাউথ ওয়েলস ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে কোচ হিসেবে কাজ করা, জয়া চাকমার দক্ষিণ এশিয়ার ও এশিয়ার ফিফা নারী রেফারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করা। নারীরা শিক্ষায় এগিয়ে যাওয়ার কারণে সরকারি-বেসরকারি চাকরিসহ সকল পেশায় নারীর পদচারণে দ্রুত হারে বাড়ছে। সরকার নারী উদ্যোক্তাদের বিনা জামানতে ও স্বল্পসুদে ঋণ দিচ্ছে, বিপুলসংখ্যক নারী শ্রমিকের জন্য বিদেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করছে, এছাড়াও হাতে নেয়া হয়েছে ৫০ লাখ প্রান্তিক ও সুবিধাবঞ্চিত নারীকে তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে ক্ষমতায়ন করার প্রকল্প। সরকার নারী শিক্ষা বৃদ্ধির জন্য বিনামূল্যে বই, শিক্ষা, মেধাবৃত্তি,  মিড- ডে মিল, টেকনিকাল ও ভোকেশনাল শিক্ষার সুযোগ,  মেয়েদের স্কুল কলেজ স্থাপন ও নারী শিক্ষিকার হারও বৃদ্ধি করেছে। বাংলাদেশ সরকার শিশু ও নারীদের সুরক্ষায় এবং নির্যাতন রোধে  যে সকল প্রচলিত আইন সংশোধন ও আইন প্রচলন করেছে তার মধ্যে রয়েছে  মুসলিম পারিবারিক আইন ১৯৬৯, যৌতুক বিরোধী আইন ১৯৮০, বাল্যবিবাহ রোধ আইন ১৯৭৪, পারিবারিক আদালত আদেশ ১৯৮২ ও নারী ও শিশু নির্যাতন  আইন ১৯৮৩।

শুধু সরকারি পদক্ষেপ কখনো একটি সমাজে বা দেশে নারীর ক্ষমতায়ন প্রতিষ্ঠায় যথেষ্ট নয়, এজন্য বেসরকারি সংস্থা ও  বিভিন্ন নারী সংগঠনগুলোকে সমতালে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। সবচেয়ে যে বিষয়টি বেশি প্রয়োজন সেটি হলো যার যার অবস্থান থেকে প্রত্যেক নারীকে আওয়াজ তুলতে হবে, বলতে হবে তাদের অধিকারের কথা। প্রত্যেক নারীকে অর্থনৈতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ততা নিশ্চিত  করতে হবে যার মাধ্যমে সত্যিই নারীর ক্ষমতায়ন বাস্তবায়ন সম্ভব। নারীর ক্ষমতায়ন মানে পুরুষের বিরোধিতা নয়, বরং পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই, লিঙ্গ বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই। নারীর ক্ষমতায়নকে প্রতিষ্ঠা করতে হলে সমাজের সর্বক্ষেত্রে নারীকে মর্যাদা দিতে হবে, রুখতে হবে নারীর প্রতি সকল ধরনের সহিংসতা।

নারীর ক্ষমতায়ন তখনই সম্ভব, যখন কোনও বা সীমাবদ্ধতা ছাড়াই নারী শিক্ষা, কর্মজীবন এবং নিজেদের জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনতে পারবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *