৩ মে অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ফেডারেল নির্বাচন, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনা। প্রতিবারের মতো এ নির্বাচনটিও এদেশের ভবিষ্যতের দিক নির্ধারণে আগামী তিন বছর সরাসরি ভূমিকা রাখবে। হয়তো পরবর্তীতেও। এই নির্বাচনে এদেশের নাগরিকরা অবাধে ভোট দেবেন। যাদের মাঝে বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশী বংশোদ্ভুত অস্ট্রেলিয়ানও আছে। তারা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অংশ হয়ে নিজেদের মতামত ব্যালটের মাধ্যমে প্রকাশ করতে যাচ্ছেন। স্বাধীনভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগের এই সুযোগ শুধু একজন নাগরিকের অধিকারই নয়, বরং এটি একটি রাষ্ট্রের পরিণতমনস্ক গণতান্ত্রিক চর্চার নিদর্শন।
আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এদেশের রাজনৈতিক দলগুলো যেসব প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে, তার মধ্যে অভিবাসন নীতি, বিদ্যুৎ বা শক্তি সংক্রান্ত নীতি, আবাসন সংকট নিরসন, স্বাস্থ্যসেবা, জলবায়ু পরিবর্তন, কর্মসংস্থান ও শিক্ষা অন্যতম। বাংলাদেশি প্রবাসীদের জন্য এগুলোর প্রতিটি ইস্যু গভীরভাবে গুরুত্বপূর্ণ। অভিবাসী হিসেবে তারা যেমন নিজের পরিবারের জন্য স্থায়ী নিরাপত্তা চান, তেমনি চান একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজব্যবস্থা যেখানে ধর্ম, বর্ণ বা জাতিগত পরিচয়ের কারণে বৈষম্যের শিকার হতে হয় না।
অস্ট্রেলিয়ার মতো একটি গণতান্ত্রিক দেশে ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ পেয়ে যখন আমরা গর্ববোধ করি, তখনই বাংলাদেশের বাস্তবতা আমাদের মনে পড়ে যায়। সেখানে বিগত ষোলো বছর ধরে প্রকৃত কোনো জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। বিরোধী দলগুলোকে দমন, রাষ্ট্রযন্ত্রের একচেটিয়া ব্যবহার, এবং ভোটারদের ভোট দিতে না দেওয়া, এই সমস্ত চর্চা বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে অকার্যকর করে যাদুঘরে পাঠিয়ে দিয়েছে। দেশের মানুষ এক পর্যায়ে অতিষ্ঠ ও মরিয়া হয়ে ফ্যাসিবাদী খুনী শাসক শেখ হাসিনা ও তার সাঙ্গপাঙ্গদেরকে তাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু নতুন ও পরিবর্তিত বাংলাদেশে সেই গণহত্যাকারী দল আওয়ামী লীগের বিষাক্ত সাপেরা আবার দুধকলা পেয়ে পরিপুষ্ট হচ্ছে। কখন একটি সুষ্ঠ ও স্বাভাবিক নির্বাচন হবে বাংলাদেশে, এখনো তার কোন নিশ্চয়তা নেই। কতটা দুর্ভাগ্যের বিষয় যে বাংলাদেশে একজন নাগরিক তার নিজ জন্মভূমির ভবিষ্যৎ নির্ধারণে অংশ নিতে পারে না, অথচ অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক হলে তারাই সে অধিকার পূর্ণ স্বাধীনতা নিয়ে পালন করতে পারে।
এই দুই দেশের বাস্তবতা আমাদের শেখায়, গণতন্ত্র কেবল একটি নির্বাচনী ব্যবস্থা নয়, বরং এটি একটি নৈতিক কাঠামো যেখানে অংশগ্রহণ, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হয়। বাংলাদেশ যদি এই মূলনীতিগুলো থেকে শিক্ষা নেয়, তবে হয়তো একদিন সেখানেও গণতন্ত্র তার প্রকৃত রূপে ফিরে আসতে পারবে। একটি শক্তিশালী, নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন এবং জনগণের মতামতকে সম্মান করার সংস্কৃতি ছাড়া তা সম্ভব নয়।
আসন্ন নির্বাচনের প্রাক্কালে বর্তমানে একটি আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটও প্রবাসী বাংলাদেশী সহ নানা জাতের, বর্ণের, সংস্কৃতির ও ধর্মের সকল শ্রেণীর অস্ট্রেলিয়ান মানুষদের বিবেককে নাড়া দিচ্ছে। তাদের মনে থাকা বড় একটি প্রশ্ন হলো, ন্যায়বিচার ও মানবিকতার অবস্থান কোথায়? ফিলিস্তিনে চলমান গণহত্যা, শিশুহত্যা ও হাসপাতালের ওপর হামলা, ইত্যাদি সবকিছু দেখে বিশ্ব বিবেক যখন নীরব, তখন অনেক অস্ট্রেলিয়ানও ফেডারেল নির্বাচনকে তাদের নৈতিক অবস্থান জানানোর মাধ্যম হিসেবে দেখছেন। বাংলাদেশি ভোটারদের মাঝেও ফিলিস্তিন ইস্যু এক গভীর আবেগের জায়গা দখল করে আছে। কোন দল ফিলিস্তিনের পক্ষে কথা বলছে, কোন দল যুদ্ধবিরতির পক্ষে স্পষ্ট অবস্থান নিয়েছে, এমন বিষয়গুলোও এখন ভোটের বিবেচনায় আসছে। গণহত্যার পক্ষে সমর্থন করা ডেমোক্রেট প্রার্থী কমলা হ্যারিসকে প্রত্যাখ্যান করার ফলে আরও বেশি বর্ণবিদ্বেষী এবং মানবতা বিদ্বেষী ট্রাম্প কিভাবে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট পদে এসে গেছে, অস্ট্রেলিয়ান ভোটারদেরকে এই সাম্প্রতিক ঘটনাও বেশ ভাবাচ্ছে। সবমিলে এই নির্বাচনে উপযুক্ত প্রার্থীকে ভোটের জন্য বাছাই করা মুসলিম ও মানবতাবাদী ভোটারদের জন্য একটি চ্যালেঞ্জের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই নির্বাচনের মাধ্যমে যারা ভোটাধিকার প্রয়োগ করছেন, তারা শুধু একটি সরকার নির্বাচন করছেন না, বরং তারা এক নৈতিক অবস্থান গ্রহণ করার সুযোগ পাচ্ছেন। এটি এমন একটি মূল্যবান সুযোগ, যেখানে আমরা দেখাতে পারি যে গণতন্ত্র কেবল ভোট দেওয়ার মাধ্যম নয়, বরং এটি এমন একটি মূল্যবান চর্চা যা ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানোর, দুর্বলদের পাশে থাকার, এবং অধিকতর মানবিক সমাজ গঠনের অঙ্গীকারকে সুদৃঢ় করতে পারে। অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে আমরা যেন নিজের দেশ ও জাতির জন্য একটি বার্তা পাঠাই, যে আমরা একটি সুস্থ, অংশগ্রহণমূলক ও দায়িত্বশীল গণতন্ত্র চাই। আমরা চাই, বাংলাদেশেও মানুষ যেন একদিন স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারে, আর ফিলিস্তিনসহ বিশ্বের নির্যাতিতরা যেন ন্যায়বিচার পায়। আমাদের ভোট হলো আমাদের কণ্ঠস্বর, এই কণ্ঠগুলো হয়ে উঠতে পারে একটি বৃহত্তর পরিবর্তনের সূচনা।