বিপ্লব এখনো শেষ হয়নি

-প্রফেসর ড. শেখ আকরাম আলী: একটি জাতির জন্য বিপ্লব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, এবং বিপ্লবীদের দায়িত্ব হচ্ছে সেটিকে সফল করা। সব বিপ্লব সফল হয় না, এর সাফল্য নির্ভর করে নেতৃত্বের আন্তরিকতার ওপর। শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট শাসনামলে রাজনৈতিক দলগুলো বিপুল ত্যাগ ও নিপীড়নের মধ্য দিয়ে এই বিপ্লবের মাটি প্রস্তুত করেছিল, কিন্তু তারা পরিবর্তনের আশা কখনো ছেড়ে দেয়নি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নেতৃত্ব দিয়েছে ছাত্রসমাজ, তারাই এই বিপ্লবকে বাস্তবে পরিণত করেছে। জাতি তাদের এই অবদানের জন্য চিরঋণী।

বিপ্লব এখনো শেষ হয়নি। বিপ্লবীরা সব সময় প্রস্তুত থাকতে হবে যেকোনো পাল্টা বিপ্লব মোকাবিলার জন্য। কিন্তু দুঃখজনকভাবে দেখা যাচ্ছে, বিপ্লবের মূল অংশীদারদের মধ্যেই এখন বিভাজন দেখা দিচ্ছে। বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির মতো রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের মধ্যে ক্ষমতার জন্য লড়াইয়ে নেমেছে, এবং তারা যেন ভুলে গেছে—এই বিপ্লবকে সফল করার দায়ভার তাদেরই।

জাতি আজ এমন এক সংকটময় মুহূর্ত অতিক্রম করছে, যা অতীতে কখনো দেখেনি। বিপ্লবের অংশীদাররা যদি এই পরিস্থিতির গুরুত্ব না বোঝে, তবে সেটা হবে জাতির জন্য বড় দুর্ভাগ্য।

দেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতা আশাব্যঞ্জক কোনো বার্তা দেয় না। সেনাপ্রধানের সাম্প্রতিক বক্তব্য সমাজে ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে—অনেকে এটিকে তার এখতিয়ার অতিক্রম বলা হলেও, আবার কেউ কেউ এটিকে বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে তার উদ্বেগ হিসেবে দেখছেন। এটা সত্য, সেনাপ্রধানও জুলাই বিপ্লবের অংশীদার এবং তিনি সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করার অধিকার রাখেন। আমরা তার অবদান ভুলে যাই না, যা তিনি জুলাই বিপ্লব ২০২৪-এ রেখেছেন। যদিও অনেকে দেশে আরেকটি ‘ওয়ান-ইলেভেন’ ঘটনার সম্ভাবনা দেখছে, আমরা বিশ্বাস করতে চাই যে আমাদের গর্বের সেনাবাহিনী ভবিষ্যতে এমন কোনো পদক্ষেপ নেবে না। বাংলাদেশের জনগণ এখন এমন মেজাজে নেই, এবং এরকম কোনো পদক্ষেপ সমাজে ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনবে।

ড. ইউনুসের প্রধান উপদেষ্টা পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর ইচ্ছা জাতির মধ্যে এক ভয়ংকর আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু যখন জানা গেল তিনি সবার সমর্থন থাকা পর্যন্ত দেশের জন্য কাজ চালিয়ে যাবেন, তখন জাতি কিছুটা স্বস্তি পেল।

জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে যে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, তা হাতছাড়া করা যাবে না। অংশীদারদের যেকোনো মূল্যে এই বিপ্লবকে সফল করতে হবে। বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির ওপর এখন বড় দায়িত্ব বর্তেছে। যদি সামান্য মতপার্থক্য থেকেও থাকে, সেটি ভুলে তাদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে।

সমাজে একটি ধারণা আছে যে, ভারত সফলভাবে বিএনপির নেতৃত্বে অনুপ্রবেশ করেছে এবং দলটির ভিতরে গোপনে কাজ করে যাচ্ছে। যদি এটি সত্য প্রমাণিত হয়, তাহলে দল এবং জাতি দুটোই দীর্ঘকাল ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তখন জনগণ বিএনপিকে দায়ী করবে এবং দলটির প্রতি সমর্থন ফিরিয়ে নেবে। বাংলাদেশের মানুষ যদি বিএনপির মধ্যে কোনো ভারতীয় যোগসূত্র খুঁজে পায়, তবে তা দলটির দীর্ঘদিনের অর্জিত ভাবমূর্তিকে ধ্বংস করে দেবে। এমনকি যদি বিএনপি ক্ষমতায়ও আসে, তবু দলটি দীর্ঘস্থায়ী হবে না। বিএনপির প্রকৃত শক্তি দেশের জনগণ—কোনো বাইরের শক্তি নয়।

জামায়াত ও এনসিপি-কে অবশ্যই বিএনপির রাজনৈতিক ধারার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কাজ করতে হবে এবং বাংলাদেশে সম্ভাব্য ভারতীয় আধিপত্যবাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। এই দুই দলের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে, এবং তাদের উচিত বিএনপির সঙ্গে কোনো রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে জড়ানো নয়। এখন নেতৃত্ব দেওয়ার পালা বিএনপির, এবং অন্যদের দায়িত্ব হচ্ছে তাদেরকে সহায়তা করা, যেন বিপ্লব সফল হয়। দেশ এখন একটি রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, এবং রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্ব হচ্ছে পরিপক্বতা ও বিচক্ষণতা প্রদর্শন করে একটি ভালো রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তোলা।

জুলাই বিপ্লবের অংশীদারদের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা ও বোঝাপড়া তৈরি করতে হবে, যেন অদূর ভবিষ্যতে একটি নতুন বাংলাদেশ গড়া সম্ভব হয়।

জুলাই ঘোষণা অবিলম্বে ঘোষণা করা উচিত—আর দেরি নয়। এটি এখন একটি অত্যাবশ্যকীয় কাজ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে, এবং সব অংশীদারকে এগিয়ে এসে এটিকে কার্যকর করতে হবে। সমাজ এই ঘোষণার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। এটি বাংলাদেশের জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ করবে এবং ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লবের ‘ম্যাগনা কার্টা’ হিসেবে বিবেচিত হবে।

জুলাই বিপ্লবের কাজ এখনো শেষ হয়নি—এটি এখনো পূর্ণ উদ্যমে ও দায়বদ্ধতার সঙ্গে চলমান। নিঃসন্দেহে আমাদের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে এই বিপ্লবের সাফল্যের ওপর, এবং একটি নতুন ও সুন্দর বাংলাদেশ গঠনে কোনো ভুলের সুযোগ আমাদের নেই

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *