ঐতিহাসিক দ্বীপ ফাইলাকা


-মঈন উদ্দিন সরকার সুমন (কুয়েত): সবে মাত্র প্রেসক্লাবের নির্বাচন শেষ হলো। বাংলাদেশ প্রেসক্লাব কুয়েত এর প্রতি নির্বাচন শেষে কেছু না কিছু করা হয় সকল সদস্য মিলে। তেমনই আলোচনায় ছিলো সমুদ্র ভ্রমণ কিংবা দ্বীপ দেখা । যে কথা সে কাজ। চলেন একটু দ্বীপ ঘুরে আসি। কুয়েতে আমার বন্ধু পলাশ কে হেসেই বললাম। সে একটু অবাক হলো। কুয়েত তো মরুভূমির দেশ, এখানে দ্বীপ কোথায়? “ফাইলাকা আইল্যান্ড, কুয়েতের বুকে এক টুকরো ইতিহাস। যদি সত্যি অনুভব করতে চান, কুয়েত শুধু শপিং মল বা বিলাসবহুল বিল্ডিং না আছে ঐতিহাসিক দ্বীপ দেখতে চাইলে চলেন একদিন। দ্বীপটিতে নৌপথে ছোট জাহাজ, অথবা বোটে যেতে হয়।বাংলাদেশ প্রেসক্লাব কুয়েত এর সহ সভাপতি পলাশ দায়িত্ব নিলেন ফাইলাকা দ্বীপে ভ্রমণ করানোর। মোটামুটি সবাই রাজি হয়ে গেলাম। পরদিন ভোরে সার্কের টার্মিনাল থেকে শুরু হবে আমাদের যাত্রা। টার্মিনালে শত শত স্পিড বোর্ড এর মাঝে আমাদের স্পিড বোর্ড হলুদ রং এর হওয়াতে চিনতে কষ্ট হয়নি। সকালে স্পিড বোর্ডে উঠার আগেই সবাই নাস্তা সেরে নিলাম। একে একে স্পিড বোর্ডে উঠতে শুরু করলো সবাই। কেউ পানি, কেউ পেপসি, জুস ভ্রমণের সময় প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র উঠাচ্ছে যে যার মতো। নির্ধারিত টার্মিনাল থেকে স্পিড বোর্ডটি আরব সাগরের বুক চিরে চলতে লাগলো। স্পিড বোর্ডের ডেকে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম সমুদ্রের ওপরে সোনালি সূর্যটা ধীরে ধীরে উঠে আসছিল। নীল আকাশ, নীল পানি আর হালকা বাতাস আমাকে যেন নতুন প্রাণ দিচ্ছিল। আমাদের কেউ সাংবাদিক কেউ ক্রিকেট প্লেয়ার। বাংলাদেশ প্রেসক্লাব, কুয়েতের সহ সভাপতি জাহাঙ্গীর খান পলাশ ও তার সহপাঠীদের সহযোগিতায় প্রেসক্লাবের সভাপতি মঈন উদ্দিন সরকার সুমন সহ ১০ জনের একটি দল প্রায় এক ঘণ্টায় বোটে চড়ে আরব সাগর দিয়ে পারস্য উপসাগরের দ্বীপটিতে পৌঁছে। সমুদ্রের মাঝে আমরা যে যার মতো ছবি তুলা ভিডিও করাতে ব্যস্ত ছিলাম। ফাইলাকায় প্রথম পা রাখার পর জেটিতে নামতেই চোখে পড়লো যুদ্ধের চিহ্ন গুলির দাগ, পুরানো বাড়ি, ভেঙে পড়া দেয়াল। এই দ্বীপ একসময় বসবাসের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কিন্তু ১৯৯০ সালের ইরাক আগ্রাসনের পর, এখানকার অনেক মানুষ তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়। ওখানে একটি রিসোর্টে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলাম। এরই মধ্যে আশ পাশের জায়গা গুলো দেখে নিলাম। দুপরের খাবার শেষ করে সবাই বেরিয়ে পরলাম একটি জিপে করে । ফাইলাকা দ্বীপ আয়তনে ২০ বর্গকিমি। এ দ্বীপটি কুয়েত শহর থেকে সমুদ্র পথেই ২০ কিমি। টাইগ্রিস-ইউফ্রেটিস নদীর মোহনা থেকে ৫০ কিমি দূরে অবস্থিত। ইতিহাস সমৃদ্ধ এ দ্বীপটিতে খ্রীস্টপূর্ব ২০০০ সালে মেসোপটেমিয়ানদের বসতি স্থাপন করতে শোনা যায়। বর্তমানে দ্বীপটি অত্যন্ত আকর্ষণীয় একটি পর্যটন এলাকা হিসেবে পরিচিত। সাপ্তাহিক ছুটিতে হাজার হাজার ভ্রমণপিয়াসীরা দ্বীপটিতে যাতায়াত করেন। যাওয়া আসার আরামদায়ক ফেরি, স্টীমার, বোট ইত্যাদির ব্যবস্থা রয়েছে। রাত্রি যাপনের জন্য মনোরম পরিবেশে হোটেলও রয়েছে দ্বীপটিতে। সেখানে ঘুরা ফেরা করার জন্য গাড়ি ভাড়া করে চড়ার সুবিধাও রয়েছে।

গুলির আঘাতে ঝাঁঝরা করা একটি পুরাতন বিল্ডিং এর দেওয়াল এবং মাটিতে ঝুঁকে দেখছিলাম, হঠাৎই এক লোক এসে বললেন এই বিল্ডিংটা কুয়েতের ন্যাশনাল ব্যাংক। এক সময় কত ব্যস্ততাই না ছিলো এখানে বর্তমানে এখন শুধু স্মৃতি রয়ে গেছে। আমার গা শিউরে উঠলো দৃশ্যগুলো দেখে। আরো অসংখ্য স্থাপনা গুলির আঘাতে ঝাঁঝরা করা স্থাপনা এখনো সংরিক্ষিত আছে দ্বীপটিতে। প্রাচীন সভ্যতার সাক্ষাৎ, দ্বীপের একপ্রান্তে গিয়ে দেখি, প্রত্নতাত্ত্বিক খনন চলছে। এখানকার নিরাপত্তাকর্মী বললেন এখানে গ্রীকরা বসতি গড়েছিল। তাদের মন্দির, গৃহস্থালির জিনিসপত্র পাওয়া গেছে। আমি চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণের জন্য দাঁড়ালাম। মনে হচ্ছিল, আমি যেন এক প্রাচীন সভ্যতার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছি। আয়তনে ছোট হলেও কুয়েতে রয়েছে অনেক ইতিহাস ঐতিহ্য। সিকান্দার বাদশার স্মৃতি বিজড়িত দ্বীপ ফাইলাকা কুয়েতেই অবস্থিত। ট্যাঙ্ক-বোন ইয়ার্ড এবং যুদ্ধ-বিধ্বস্ত কাঠামোর সঙ্গে দ্বীপটির ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে। ফাইলাকা প্রাচীন কাল থেকেই মানুষের বসবাস ছিল এবং মেসোপটেমিয়া এবং উপসাগরীয় উপকূল বরাবর অন্যান্য সভ্যতার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক স্টপ ছিল। খনন কার্যক্রম খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দের হেলেনিস্টিক যুগ পর্যন্ত একটি সভ্যতা আবিষ্কার করে, যেখানে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীর শেষের দিকে ইকারুস নামে একটি গ্রিক উপনিবেশ তৈরি করেছিলেন। ১৯৯০ সালের ২ আগস্ট ইরাক তার প্রতিবেশী দেশ কুয়েতের ওপর আক্রমণ করে। দ্বীপটিকে ধ্বংস করার দৃশ্য এখনও আছে। বিভিন্ন ভবনে গোলা বারুদের আঘাতে ছিদ্র হয়ে আছে। নিচে পরে আছে অসংখ্য গোলা বারুদ। যুদ্ধে ব্যবহৃত ট্যাংকগুলোও সংরক্ষিত আছে। এখানে সিকান্দার বাদশার প্রাসাদ, ইনজাকের সমাধিস্থল, ৬ হাজার বছর পূর্বের কারাগার, সেই আমলে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার স্থান ও কুয়েতের প্রথম আমিরের বাসস্থান। কত ইতিহাস ঐতিহ্য দেখলাম আর সেসমেয়র গল্প শুনলাম। দ্বীপের ভিতরের দিকে দেখি কয়েকটা উটের দল হাঁটছে ধীরে ধীরে। তারা যেন আমাকেও কোথাও নিয়ে যেতে চাইছে। মনে হচ্ছিল, এখানে শব্দও যেন ইতিহাসের স্তব্ধতায় হারিয়ে গেছে। বিকেল ঘনিয়ে আসছে। এবার ফেরার পালা। স্পিড বোর্ডে উপরে এক কোণে আমি একা বসে ছিলাম। সূর্যটা ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছিল। কুয়েত সিটির ঝলমলে আলোর বিপরীতে ফাইলাকা যেন এক নীরব কবিতা। ঢেউয়ের শব্দ, হালকা বাতাস আর দিগন্ত জোড়া শান্তি এই অভিজ্ঞতা আমার স্মৃতির পাতায় চিরকাল অম্লান থাকবে। ফিরে আসার সময় মনে হচ্ছিল, যেন কিছু একটা রেখে যাচ্ছি পেছনে। না, শুধু দ্বীপ নয়, একটা অনুভব। ইতিহাস, নীরবতা, মানুষের গল্প – সব মিলিয়ে ফাইলাকা শুধু এক ভ্রমণ নয়, ছিল এক উপলব্ধি। তবে কুয়েতে যারা আছেন বা যাদের কখনো কুয়েতে যাওয়ার সুযোগ হয়, ফাইলাকা দ্বীপে একদিন কাটাতে ভুলবেন না। এটি শুধুই পর্যটন স্থান নয়, এটি এক জীবন্ত ইতিহাস, যেখানে প্রতিটি ইট, প্রতিটি ধ্বংসস্তূপ কিছু না কিছু বলার জন্য দাঁড়িয়ে আছে।

লেখক পরিচিতি : মঈন উদ্দিন সরকার সুমন একজন প্রবাসী সাংবাদিক, লেখক ও ফটোজার্নালিস্ট। ছোটবেলা থেকেই ফটোগ্রাফিতে আগ্রহী সুমনের সাংবাদিকতা শুরু ১৯৯১ সালে কক্সবাজারে। দেশে ও বিদেশে বহু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে কাজ করেছেন।

কুয়েত প্রবাসে তিনি প্রবাসীদের সমস্যা, সাফল্য ও মানবাধিকার নিয়ে নিয়মিত রিপোর্টিং করছেন। তিনি একুশে টিভি, বাংলা ভিশন, নিউজ ২৪, এনটিভি-তে কাজ করেছেন এবং বর্তমানে সময় টিভির কুয়েত প্রতিনিধি।

সম্পাদকীয় ও সাংগঠনিক ভূমিকা:

– সম্পাদক ও প্রকাশক: বাংলার বার্তা (কুয়েত)

– প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি: বাংলাদেশ রিপোর্টার্স ইউনিটি, টিভি জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন ও প্রেসক্লাব (কুয়েত)

– উপদেষ্টা: বাংলাদেশ ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন, কুয়েত

সম্মাননা:

– বাংলাদেশ মিলিটারি কন্টিনজেন্ট (BMC), দূতাবাস ও সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে সম্মাননা

– মানবিক সাংবাদিকতা ও প্রবাসীদের অধিকার রক্ষায় প্রশংসিত

পেশাগত জীবন:

সাংবাদিকতার পাশাপাশি তিনি কুয়েতে একটি ওষুধ কোম্পানিতে স্টোর ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত। অবসরে লেখালেখি ও সাহিত্যচর্চা করেন। একজন মানবিক সাংবাদিক হিসেবে প্রবাসীদের জীবন ও সংগ্রাম নিয়ে কাজ করে চলেছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *