প্রফেসর ডঃ শফিকুর রহমান, সিডনী প্রবাসী বাংলাদেশী:
যেভাবে ঘটনা শুরুঃ
আজকের লেখা এক সিডনী প্রবাসীর হৃদয়ের রক্তক্ষরণ। ২০২৪ সালের ১৫ জুলাই থেকে হাসিনার পতন পর্যন্ত আওয়ামী হানাদার বাহিনীর মাধ্যমে (ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবকলীগ, পুলিশলীগসহ অন্যান্য অনুগত বাহিনী) বাংলাদেশে নিরীহ ছাত্রজনতার উপর যে নির্বিচারে গুলি ও নির্যাতন চালায়, যার ভয়াবহতা হিটলারের নির্যাতনকেও হার মানিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেই সংবাদ দাবানলের মত ছড়িয়ে পরে সব খানে। ভয়াবহ রাতগুলো আমাদের চোখের সামনে এখনও ভাসে। গুলি ও নির্যাতনে অসহায় মানুষের রক্তের গন্ধে ভারী হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশের আকাশ বাতাস। আন্দোলনকারীদের গ্রেফতার, গুম, আর নির্মম হত্যার ধারাবাহিক গণহত্যার উৎসব চলতে থাকে। চারদিকে শুধু আর্তনাদ—মায়েরা ছেলের খোঁজে রাস্তায় কাঁদছেন, স্বামীদের খুঁজে ফেরেন স্ত্রীরা, আর শিশুরা খুঁজছে বাবাকে—যে কখনো হয়তো আর ফিরবে না। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেশের খবর খুলতাম, আর প্রতিদিনই বুকটা কেঁপে উঠত।
১৬ই জুলাই আবু সাঈদ, একজন মেধাবী তরুণ, রংপুরের রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, যার স্বপ্ন ছিল বাংলাদেশকে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করা, তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হলো যা সারা বিশ্ব প্রত্যক্ষ করলো। ১৮ই জুলাই মুগ্ধ, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেসনালসের ছাত্র, আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের পানি পান করাতে গিয়ে ঘাতকের গুলিতে নিহত হন। এই সময়টা শেখ হাসিনার সরকারের নিষ্ঠুরতার এক ভয়াবহ দলিল। ইন্টারনেট বন্ধ, মিডিয়া সেন্সর, আর সোশ্যাল মিডিয়ায় সক্রিয়দের টার্গেট করে হত্যা—একটা ডিজিটাল ডার্ক এইজ তৈরি করেছিল। বিরোধীমতকে দমনের জন্যে আয়নাঘরের মত মৃত্যুকুপ বানিয়েছিল আওয়ামী জাহিলিয়াত। এভাবেই অসংখ্য জানা না জানা শহীদের রক্তে লেখা হলো বাংলাদেশের নতুন ইতিহাস।
ডেটলাইন – ৩৬শে জুলাই –
৩৬শে জুলাই—যা ইতিহাসের পাতায় এক নতুন নাম, আর হৃদয়ের পাতায় এক অসীম আবেগ—সে দিনটি কখনো ভুলতে পারব না। দিনটা ছিল ৫ই অগাস্ট, ২০২৫। সিডনির আকাশ ছিল পরিষ্কার, কিন্তু আমাদের হৃদয় ছিল ভারী—বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া হত্যা, গুম আর দমন-পীড়নের খবরে। প্রতিদিন সকালবেলা ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে মোবাইল হাতে নিই—যেন প্রিয় কারো খোঁজে অস্থির হয়ে উঠি। কারো সন্তান নিখোঁজ, কারো ভাই নেই, কারো পিতা গুম। বুকের মধ্যে এক অজানা কষ্ট জমে ছিল দীর্ঘদিন। আর সেই কষ্টের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল ৩৬ জুলাই বৃহত্তর সিডনীর মিন্টর এলাকার বিক্ষোভ মিছিলে।
এই দিনটি ছিল অন্য আর দশটা দিন থেকে ভিন্ন। কাজ শেষ করে সরাসরি মিন্ট স্টেশনে নেমে গেলাম, যেখানে বিকেলে একটি প্রতিবাদ মিছিল ও সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছিল। মনে হচ্ছিল, এ কেবল মিছিল নয়, যেন প্রবাসে বসেও দেশের হৃদয়স্পন্দনে অংশ নেওয়া। সেখানে এসে দেখি—ছোট-বড়, নারী-পুরুষ, ছাত্র-ছাত্রী, বৃদ্ধ মানুষ—সবাই প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে। কোনো প্ল্যাকার্ডে লেখা—”গুম বন্ধ করো”, কোনোটায়—”খুনিদের বিচার চাই”, আবার কোথাও লেখা—”হাসিনা নিপাত যাক”। মিছিলটি যখন শুরু হয়, তখন আমাদের চিৎকার ছিল শোকের, ক্রোধের, প্রতিবাদের। প্রবাস থেকে আমরা কতটুকুই বা করতে পারি—তবু কণ্ঠে চিৎকার জুড়ে দিয়েছিলাম প্রাণপণে। আমাদের চোখে ছিল অশ্রু, গলায় ছিল কাঁপুনি। এই কষ্ট ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। কারণ, দেশের প্রতিটি সংবাদ আমাদের বুকের মধ্যে একেকটা ছুরি চালাচ্ছিল।
আর ঠিক এমন সময়, ভিড়ের মধ্য থেকে একজন চিৎকার করে বলল, “হাসিনা পালিয়ে গেছে!” প্রথমে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল। কেউ ফোনে যাচাই করল, কেউ ভিডিও দেখাল—বিশ্বাস হচ্ছিল না যে এমন একটা সময় আমাদের জীবদ্দশায় আমরা দেখতে পাব। মুহূর্তেই যেন একটা বিস্ফোরণ ঘটল জনতার মাঝে—একদিকে অশ্রু, অন্যদিকে উল্লাস। মিছিলটি মুহূর্তের মধ্যেই আনন্দ মিছিলে রূপ নেয়। এই আনন্দ একেক জনের ভেতরে ভিন্ন ভিন্নভাবে ধরা দিচ্ছিল—কেউ কাঁদছিল, কেউ আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করছিল, কেউ সেজদায় যাচ্ছিল।
সেই সন্ধ্যায় সিডনি যেন হয়ে উঠেছিল ঢাকা। আমাদের হৃদয়ে ছিল বিজয়ের স্বাদ, প্রতিবাদের অর্জন, আর ভবিষ্যতের আশার আলো। কেউ কেউ জাতীয় সংগীত গেয়ে উঠল, কেউ আবার কবিতা আবৃত্তি করল। কেউ শিশুদের কপালে বাংলাদেশ পতাকার স্টিকার লাগিয়ে দিচ্ছিল—এ যেন এক অনন্য মুহূর্ত, এক বিশুদ্ধ অনুভব, এক জাতিগত জাগরণ। এ সময় মিন্ট ছাড়াও ল্যাকেম্বার রেলওয়ে প্যারেড ও হালডন স্ট্রিটের মোড়ে CYCDO ছোট পরিসরে মাত্র ২০০ জনের জন্য একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করে। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার হওয়ার পর এই আয়োজনটি সিডনির প্রবাসী বাংলাদেশিদের হৃদয়ে আলোড়ন তোলে। আবেগঘন পোস্ট ও ভিডিও দেখে সিডনির নানা প্রান্ত থেকে প্রায় ১০ হাজার মানুষ ছুটে আসে। রাস্তায় জনতার ঢল নামে, যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। সবার চোখে ছিল আনন্দ, উচ্ছ্বাস আর দেশের প্রতি হৃদয়ের টান।
আমার জীবনে অনেক প্রতিবাদে অংশ নিয়েছি, কিন্তু এমন একটি বিকেল, এমন একটি সন্ধ্যা—যেখানে একসঙ্গে শোক, প্রতিবাদ, বিজয়, আর মুক্তির আনন্দ এক হয়ে যায়—তা আর কখনো অনুভব করিনি। মনে হচ্ছিল, ৩৬শে জুলাই এক ঐতিহাসিক দিন হয়ে রইল। শেখ হাসিনার পালিয়ে যাওয়া শুধুমাত্র একজন স্বৈর শাসকের পরাজয় নয়—এটা ছিল অন্যায়ের পরাজয়, নিপীড়নের পতন এবং একটি দেশের মুক্তির প্রতিশ্রুতি। আমরা সেই রাতে ঘরে ফিরেও ঘুমাতে পারিনি—প্রতিটি চোখে ছিল স্বপ্ন, প্রতিটি মনে ছিল আশা—যে বাংলাদেশ আমরা চেয়েছিলাম, সেই বাংলাদেশ হয়ত আর বেশি দূরে নয়।