রাজনীতিতে সততা

প্রফেসর ড. এস কে আকরাম আলী: রাজনীতিতে সততা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান। যদিও বাস্তবে এর পথে অনেক চ্যালেঞ্জ আছে, তবুও রাজনীতিতে সততার জন্য চেষ্টা করা সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং কার্যকর শাসনব্যবস্থা গড়ে তুলতে অপরিহার্য। সততা যে কোনো ভালো শাসনব্যস্থার ভিত্তি। রাজনীতিবিদরা যখন সৎ হন, তখন সমাজে ন্যায় ও সুবিচারের অনুভূতি জন্ম নেয়। তাঁরা অন্য নাগরিক ও প্রতিষ্ঠানের জন্য ইতিবাচক উদাহরণ তৈরি করতে পারেন এবং সমাজের সর্বত্র সততার সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠায় অনুপ্রেরণা দেন। এটি সমাজের ঐক্য ও স্থিতিশীলতায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে।

কিন্তু নির্বাচন জেতার চাপ ও দলীয় স্বার্থ রক্ষার প্রয়োজনে অনেক সময় অসৎ কৌশল অবলম্বনের প্রবণতা দেখা যায়। অনেক রাজনৈতিক বিষয় এত জটিল যে, সত্য তথ্যকে সরলভাবে উপস্থাপন করতে গিয়ে বিকৃতি বা বিভ্রান্তি তৈরি হতে পারে। তারপরও রাজনীতি এবং রাজনীতিবিদদের পথপ্রদর্শক হওয়া উচিত সত্য ও সততা। রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত ব্যক্তি বা দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে জনগণ ও দেশের স্বার্থকে সর্বাগ্রে গুরুত্ব দেওয়া।

দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের রাজনীতিতে এখনও কাঙ্ক্ষিত সততা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। অথচ এক সময় রাজনীতি পরিচালিত হতো সততা ও নৈতিকতার ভিত্তিতে। সত্যবাদিতা ছিল রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যার মধ্যে পড়তো প্রতারণা, বিভ্রান্তি ও তথ্য বিকৃতির পরিহার। রাজনীতিবিদরা ব্যক্তিগত লাভ ও দলীয় সুবিধার চাইতে জনগণের কল্যাণ ও জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিতেন। তাঁরা নিজেদের কর্মকাণ্ডের জন্য দায়ী থাকতেন এবং জনগণের কাছে জবাবদিহি করতেন।

পাকিস্তান সৃষ্টির পরও রাজনীতিতে সততার এই সংস্কৃতি বজায় ছিল। কিন্তু পাকিস্তান আমলের শেষদিকে এসে রাজনীতিতে অসততা ঢুকে পড়ে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ তাঁদের নিজস্ব নেতাদের দ্বারা ভুল তথ্য ও বিভ্রান্তির শিকার হয়েছিলেন। শেখ মুজিব নিজেও কখনো স্বাধীনতা চাননি, তিনি পূর্ব পাকিস্তানের জন্য শুধু স্বায়ত্তশাসনের দাবিই করেছিলেন। তাঁর ছয় দফা দাবিতে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ ব্যাপকভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিল এবং তাঁরা ছয় দফা আন্দোলনে পুরোপুরি সমর্থন দিয়েছিল।

ছয় দফা আন্দোলন শেখ মুজিবকে পূর্ব পাকিস্তানের নিঃসন্দেহ নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে এবং ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় লাভে সহায়তা করে। তবে, পাকিস্তানের উভয় অংশের রাজনীতিতেই অসততার উপস্থিতি ছিল। ইয়াহিয়া খানের সামরিক সরকার অসৎ রাজনীতিবিদ যেমন জুলফিকার আলী ভুট্টোর প্রতারণার ফাঁদে পড়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ মুজিবের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেনি। এটিকে গণতন্ত্রের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক অসততা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

এছাড়া ইয়াহিয়া সরকারের পূর্ব পাকিস্তানের নিরীহ মানুষের ওপর সেনা অভিযান ছিল আরেক বড় ভুল, যা পাকিস্তানের ভাঙনের পথ আরও দ্রুততর করে এবং বাংলাদেশের জন্মকে অবশ্যম্ভাবী করে তোলে। অন্যদিকে, শেখ মুজিবের রাজনৈতিক আচরণেও অসততার পরিচয় পাওয়া যায়, যা বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিয়ে তাঁর ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক তৈরি করেছে।

শেখ মুজিবের অনুপস্থিতিতে আওয়ামী লীগের নেতারা নিজেদের জীবন রক্ষার জন্য ভারতের আশ্রয় নেন এবং জনগণকে জান্তা সরকারের দয়া-দাক্ষিণ্যের ওপর ছেড়ে দেন।এর মাধ্যমে শেখ মুজিব চরম অসততার পরিচয় দিয়েছেন  ঠিক সেই সংকটময় মুহূর্তে এক সৎ সৈনিক জাতির পাশে দাঁড়িয়ে ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। জনগণ প্রথমবারের মতো মেজর জিয়াউর রহমানের মধ্যে একজন প্রকৃত দেশপ্রেমিক নেতা দেখেন, যিনি শেখ মুজিবের মর্মান্তিক পতনের পর জাতিকে বাঁচানোর পথপ্রদর্শক হয়ে ওঠেন।

জিয়াউর রহমান তাঁর সততার প্রতি অটল থেকে সর্বোচ্চ আন্তরিকতা ও সততার সঙ্গে দেশের সেবা করার চেষ্টা করেন। তিনি তাঁর রাজনৈতিক মিশন জাতির সামনে অত্যন্ত স্বচ্ছভাবে উপস্থাপন করেন এবং জনগণও তাঁর রাজনৈতিক কর্মসূচিকে পূর্ণ সমর্থন দেয়। তাঁর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে কিছুই গোপন ছিল না, এ কারণেই তাঁকে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে সৎ নেতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। জিয়াউর রহমান যথার্থভাবেই বাংলাদেশের মহান রাজনৈতিক নেতা এবং কিংবদন্তি হিসেবে স্বীকৃত।

এরশাদ রাজনৈতিকভাবে অসৎ হলেও দেশের উন্নয়নের প্রতি আন্তরিক ছিলেন। বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে কখনও অসততার প্রমাণ পাওয়া যায়নি, তবে সময়ে সময়ে তিনি তাঁর কাছের কিছু সহযোগী ও আত্মীয়দের দ্বারা বিভ্রান্ত হয়েছিলেন। তবে তিনি কখনো জনগণের স্বার্থ বা দেশের স্বার্থ নিয়ে আপস করেননি।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে চরম মাত্রার অসততা দেখা যায় শেখ হাসিনার শাসনামলে। তাঁর অসৎ রাজনৈতিক চর্চা বাংলাদেশের রাজনীতির পুরো কাঠামো ধ্বংস করেছে, এর সব প্রতিষ্ঠানকে দুর্বল করেছে। এখন ধ্বংস করার মতো কিছুই আর বাকি নেই, কেবল বাংলাদেশকে তাঁর প্রভু ভারতের হাতে তুলে দেওয়ার অপেক্ষা।

২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লব আমাদের সামনে রাজনীতিতে সততার নতুন একটি সংস্কৃতি গড়ার দরজা খুলে দিয়েছে, কিন্তু দুঃখজনকভাবে সঠিক পথে এগিয়ে যাচ্ছে না। বিপ্লবের মূল স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে ভবিষ্যতের রাজনীতির প্রতি যথেষ্ট সততা দেখা যাচ্ছে না। বরং মনে হচ্ছে, তাঁরা শুধু ক্ষমতা দখলের প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত, জাতির জন্য একটি সত্যিকারের সৎ রাজনৈতিক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠায় নয়।

আমাদের অবশ্যই একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দল দরকার, যার শিকড় তৃণমূলে বিস্তৃত থাকবে। তা না হলে দেশে রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হবে। ছোট ও অপ্রাসঙ্গিক রাজনৈতিক দলগুলো, যদিও জনপ্রিয়, তারা এই শূন্যতা পূরণ করতে পারবে না। নতুন রাজনৈতিক দল হিসেবে এনসিপি ভবিষ্যতের রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে সক্ষম নয় এবং ভারতীয় আধিপত্যবাদী রাজনীতির চাপে সহজেই ভেঙে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। মূল জাতীয়তাবাদী শক্তির বিপক্ষে যাওয়া দেশকে রাজনৈতিক সংকটে ঠেলে দিতে পারে এবং তা গৃহযুদ্ধ পর্যন্ত গড়াতে পারে। শত্রুপক্ষ বহুদিন ধরে এমন সুযোগের অপেক্ষায় আছে এবং তারা পরিস্থিতি ঘোলা হলে ফায়দা লুটতে ভুল করবে না।

রাজনৈতিক দলগুলোকে সততা ও আন্তরিকতা নিয়ে কাজ করতে হবে, নইলে পরিস্থিতি তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। দেশের ভেতর ও বাইরে সক্রিয় শক্তিগুলো আমাদের অসৎ রাজনীতিবিদদের দুর্বলতার সুযোগ নেওয়ার জন্য অপেক্ষায় আছে। আমরা কি নিজেদের দ্বন্দ্ব-দ্বিধার সুযোগে তাদের মাঠে খেলার সুযোগ করে দেব? —এটাই এখন কোটি টাকার প্রশ্ন।

অবশেষে বলা যায়, রাজনীতিতে সততা অত্যাবশ্যক, কারণ এটি সরকার ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের ওপর জনগণের আস্থা তৈরি ও বজায় রাখতে সাহায্য করে। রাজনীতিবিদরা যখন সৎ বলে পরিচিত হন, তখন জনগণ তাঁদের আন্তরিকতা বিশ্বাস করে এবং তাঁদের নীতিমালা সমর্থন করে। ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লবের পর রাজনীতিতে আর কোনো লুকোচুরি খেলা চলবে না। বাংলাদেশের মানুষ এখন রাজনীতিতে সততা দেখতে চায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *