ড. ফারুক আমিন: ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে ঘটে যাওয়া গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন সাধন করেছে। দীর্ঘদিনের দমন-পীড়ন, বাকস্বাধীনতা দমন ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি, সর্বোপরি দেশের সার্বভৌমত্ব লুটিয়ে দিয়ে বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতার অধিকারকে বঞ্চনা করার ফলে জনগণের মনে যে গভীর ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছিলো, গত বছর এই সময় তা বিস্ফোরণের রূপ নেয়। তরুণদের নেতৃত্বে শুরু হওয়া আন্দোলন ক্রমে পরিণত হয় জাতীয় জাগরণে।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বসবাস করা প্রবাসী থেকে শুরু করে পল্লীর চায়ের দোকান পর্যন্ত একযোগে উচ্চারিত হয় একটাই দাবি, ভোটের অধিকার ফিরিয়ে দাও। মাত্র বারো মাস আগে এই সময়ে অধিকারের দাবীতে বাংলাদেশের মানুষ অকাতরে প্রাণ দিয়েছে। মায়ের কোলে নিরাপদে থাকা শিশু পর্যন্ত গুলিবিদ্ধ হয়েছে স্বৈরাচারী দানবের লেলিয়ে দেয়া বাহিনীর হাতে। এতো মানুষের আত্মত্যাগ ভুলে যাওয়ার মতো কোন বিষয় নয়। এতো প্রাণের বিনিময়ে পাওয়া দ্বিতীয় স্বাধীনতাকে আবার স্বার্থবাদী দুর্নীতিবাজদের হাতে হাতের খেলনা হতে দেয়া যাবে না। সুতরাং জুলাই বিপ্লবের বর্ষপূর্তিতে আমাদেরকে নির্মোহ ও নিরপেক্ষভাবে বিগত এক বছরের পর্যালোচনা করতে হবে।
বিচার
জুলাই-আগস্টে গণহত্যা ও দমন নিপীড়ন পরিচালনা করা সরকারী বাহিনীর সদস্যদের যথাযথ বিচার হবে, এমন কোন সম্ভাবনা এখনো দেখা যাচ্ছে না। এর আগে দীর্ঘ ষোল বছর গুম-খুন করা, গ্রেফতার ও অত্যাচার করা বাহিনী সদস্যদের কোন বিচার হবে, সে সম্ভাবনাও এখনো সুদূর পরাহত। মাঝে মাঝে কদাচিত এই কমিশন বা সেই ট্রাইবুনালের কিছু মুখরোচক বর্ণনা ও আচমকা গ্রেফতার দেখা যায় বটে। কিন্তু পদ্ধতিগতভাবে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা বিগত এক বছরেও বাংলাদেশে হয়ে উঠেনি। বিচার প্রত্যাশার এই আঙ্গিক থেকে নিঃসন্দেহে বলা যায় দেশের সাধারণ মানুষ ফ্যাসিবাদকে দূরীভুত করেছে ঠিকই, কিন্তু তারপর যারা দেশের পরিচালনার দায় হাতে নিয়েছে তারা সেই মানুষের মৌলিক অধিকার, বিচার পাওয়ার অধিকারকে প্রতিষ্ঠা করতে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে।
দুর্নীতি
শেখ হাসিনার শাসনামলের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিলো লাগামছাড়া আওয়ামী দুর্নীতি। বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য হলো আগষ্টের পটপরিবর্তনের পর কেবলমাত্র সাইনবোর্ড পরিবর্তন হয়েছে, জাতির ঘাড়ে চেপে বসেছে নতুন দুর্নীতিবাজ ও চোরের দল। সমন্বয়ক পরিচয়ে অল্পবয়সী ছাত্রদের দুর্নীতিই হলো জুলাই বিপ্লবের ব্যার্থতায় পর্যবসিত হওয়ার মূল কারণ। একই সাথে যোগ দিয়েছে পুরনো রাজনৈতিক সংস্কৃতির ধারক বাহকরা। তারা দীর্ঘদিনের বঞ্চনার পর চুরি দুর্নীতি শুরু করার জন্য উন্মুখ হয়ে ছিলো। যখন দেখলো বিপ্লবের সামনে থাকা অথবা যে কোনভাবেই হোক বিপ্লবের ব্যানার বহন করা ছেলেরা নিজেরাই চুরিতে অবতীর্ণ হয়েছে, তখন তারাও প্রতিযোগিতায় নেমে গেলো।
গত এক বছরের বাংলাদেশে আমরা পুরনো ও নতুন প্রতিটি রাজনৈতিক দলের হালুয়া রুটির ভাগ নিয়ে মারামারি দেখেছি। কোন সুস্থ ও সচেতন মানুষ বাংলাদেশে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপি এইসব রাজনৈতিক দলের নাম ধারী চোর ও লুটেরা ছোটলোকদেরকে মন থেকে পছন্দ করতে বা সমর্থন করতে পারেনা। আমরা সামাজিক কারণে অনেক সময় এসব চোরদের সাথে কথা বলি। কিন্তু বিগত এক বছরের অভিজ্ঞতা আমাদেরকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছে দুর্নীতি ও লুটপাটের দিক থেকে আওয়ামী লীগ এবং অন্যরা আসেই একই। জাতি হিসেবে এটি আমাদের চরম দুর্ভাগ্যের বিষয়।
গণতান্ত্রিক অধিকার
বাংলাদেশের মানুষ দীর্ঘ বহু বছর নিজেদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেনি। যদিও সেই ভোটের মাধ্যমে পুরনো রাজনৈতিক দুর্বৃত্তদের হাতেই ক্ষমতা যাওয়া প্রায় নিশ্চিত, কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের সামনে গণতন্ত্রের চেয়ে আপাতত অন্য কোন উত্তম সুযোগও নেই। পুরো এক বছর অতিবাহিত হওয়ার পরও দেশে নির্বাচনের কোন পরিস্কার রোডম্যাপ নেই। এই এক বছরে আমরা দেখেছি নির্বাচন প্রসঙ্গে একেক রাজনৈতিক দলের একেক মতামত ও ড. ইউনুসের অনির্বাচিত সরকারের সাথে তাদের প্রকাশ্য ও নেপথ্য নানা দড়ি টানাটানির খেলা। গত এক বছরের ঘটনাবলীতে যদি কোন কিছু পরিস্কার বুঝা যায় তা হলো বাংলাদেশে সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার দেশের মানুষের হাতে আসেনি। তাদের প্রত্যাশার কথাও কেউ বিবেচনা করে না। বরং প্রতিটি রাজনৈতিক দলের নিজেদের স্বার্থের বিষয়টিই এখানে মুখ্য। এ কারণে বাংলাদেশে নির্বাচন, সুশাসন ও গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার ভবিষ্যত এখনো পুরোপুরি অনিশ্চিত।
ভূ-রাজনৈতিক পরিবর্তন
আওয়ামী লীগের সময় বাংলাদেশ আক্ষরিক অর্থেই ইন্ডিয়ার করদরাজ্যে পরিণত হয়েছিলো। হাসিনার পলায়নের পর এখন বাংলাদেশ পশ্চিমামুখী হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ ঐতিহাসিকভাবেই কিছুটা গোলামীতে অভ্যস্ত। একাত্তরে আমরা আলাদা একটি স্বাধীন দেশের পরিচয় পেয়েছি বটে, কিন্তু এই স্বাধীন দেশের প্রতিটি রাজনৈতিক সংকটে আমরা দুতাবাসগুলোতে ছুটে গিয়েছি। বিদেশী বিভিন্ন রাষ্ট্র ও পক্ষের অঙ্গুলি হেলনে আমাদের জাতীয় নেতারা উঠেন বসেন, শক্তি পান। এসব কিছুর পরও ইন্ডিয়ার নগ্ন সাম্রাজ্যবাদী নীতি ও কাজকর্ম বাংলাদেশের মানুষের মনে গভীর ও চাপা ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। ইন্ডিয়ার সাথে এই সংঘাতে ধর্মীয় পরিচয় একটি অনস্বীকার্য উপাদান।
অন্যদিকে বর্তমানে ড. ইউনুসের সরকার পরাশক্তি আমেরিকা সহ ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভূক্ত দেশ ও পশ্চিমের নানা দেশের সাথে সরাসরি যোগাযোগ বাড়িয়েছেন। তাদের স্বার্থ ও কার্যক্রমের উপস্থিতি বর্তমান বাংলাদেশে অনেক সক্রিয়। বাংলাদেশের ও দেশের সাধারণ মানুষের স্বার্থ এই বিনিময়ে কতটা অর্জিত হবে, তা ভবিষ্যতই বলে দেবে। কিন্তু অন্তর্বতী সরকার যেহেতু নির্বাচিত সরকার নয়, আবার বিপ্লবের চেতনায় গঠিত সরকারও নয়, বরং পরিস্থিতির সুবিধাভোগী এনজিও সরকার, তাদের উপর আস্থা রাখার কোন সুযোগ এ দেশের মানুষের নেই।
উপসংহার
২০২৫ এর আগস্টে এসে বিগত এক বছর সময়কালকে পর্যালোচনা করলে দেখা যায় সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশের মানুষের জন্য আশাবাদী হওয়ার মতো কোন ঘটনা ঘটেনি। এমন কিছু হয়নি যে দেশের ভবিষ্যত নিয়ে স্বপ্ন দেখা যায়। গত বছর জুলাইয়ে হাজার হাজার প্রবাসী পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশে ফিরে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলো। আজ এক বছরের মাথায় কোন উম্মাদও তার অস্ট্রেলিয়ান পাসপোর্ট পরিত্যাগ করে বাংলাদেশে ফিরবে না। বাংলাদেশ সেই একই সুযোগসন্ধানী ও অসৎ মানুষদের স্বর্গরাজ্য রয়ে গেছে। বিগত এক বছরে বাংলাদেশে যদি কোন ভালো ঘটনা ঘটে থাকে, তাহলে সেই একমাত্র ভালো ঘটনা হলো মানসিকভাবে অসুস্থ দানব ও খুনী শাসক শেখ হাসিনা ও তার অনুসারী দুর্বৃত্তদের পলায়ন। ক্ষমতা থেকে ফেরাউন পালিয়ে গেলে তার বিপরীতে চরম অযোগ্য এবং দুর্বল শাসককেও তুলনামূলকভাবে ভাল শাসক হিসেবে বিবেচনা করা যায়।
২০০৮ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৪ সালে আগষ্ট হলো বাংলাদেশের ইতিহাসের কালো অধ্যায়, যার তুলনা কেবল ১৯৭২ সালের জানুয়ারী থেকে ১৯৭৫ সালের আগষ্ট পর্যন্ত শেখ মুজিবের শাসনকালের সাথেই দেয়া সম্ভব। মুজিবকন্যা এবং গণহত্যাকারী হাসিনার কার্যক্রমে বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশ পৃথিবীর গুম-রাজধানী হিসেবে পরিচিত হয়েছিলো। সেই অন্ধকার সময় পেরিয়ে এসে বাংলাদেশের মানুষ কিছুটা মুক্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে। কিন্তু জুলাই বিপ্লবের ব্যার্থতা এবং সুযোগসন্ধানীদের নির্বোধ ও সাময়িক স্বার্থ হাসিল করা কাজকর্মের কারণে বাংলাদেশে আওয়ামী বাকশালী দুর্বৃত্তদের ফিরে আসার পরিবেশ তৈরি হচ্ছে, বাংলাদেশের মানুষের জন্য এটাই হলো প্রকৃত ভীতি ও আশংকার বিষয়।