সামসুল ইসলাম টুকু: ‘অপ’ এই ছোট্ট শব্দটির অভিধানিক অর্থ কুৎসিত, ক্ষতিকার্ক, প্রতিকুল, মিথ্যা ইত্যাদি।শব্দটি ছোট হলেও ভয়ঙ্কর।এর প্রভাব এবং বিস্তৃতি এত বেশী যে লিখে শেষ করা যাবে না । এই ‘অপ’ এর প্রভাবে প্রকৃতি,মানুষ,সমাজ,ধর্ম,দর্শন সবকিছুরই ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা ।এর ব্যাপক ব্যাবহারের ফলে মানবকুল আজ ধ্বংশের দ্বারপ্রান্তে উপনীত । এ অবস্থা থেকে মুক্তির পথ নিকট ভবিষ্যতে দেখা যায় না কারন এই ‘অপ’এর সাথে জড়িয়ে আছে পৃথিবীর বৃহৎ শক্তিগুলো ।এ এক বিশাল আলোচনা । যা বিজ্ঞানী ও গবেষকরা কয়েক যুগ ধরে অব্যাহত রেখেছেন , সতর্ক করেছেন , করছেন ,এবং করবেন। কিন্তু এই ‘অপ’ এর ব্যাবহারকারীদের ভ্রুক্ষেপ নাই । তাদেরই পরবর্তী প্রজন্ম যে এর শিকার হবে সেটা তারা আমলেই নেয়না । মনে করে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিকাশ সাধন করে চলেছেন তারা নিরলশভাবে তাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্যই ।
আজ খুবই অল্প পরিসরে শুধুমাত্র খাদ্য অপচয়ের কথা বলবো । প্রাপ্ত কিছু তথ্যের ভিত্তিতে এই অপচয়ের কুফল সম্পর্কে বলবো । ফেসবুকে একজন পোষ্ট দিয়েছেন আরব দেশগুলোতে প্রতিদিন যে খাবার অপচয় হয় তাতে ১০০ কোটি মানুষের খাবার হতে পারে ।এ তথ্যের কোন সুত্র নাই ।তবে আরবরা যে খাদ্যের অপচয় করে তা সর্বজনবিদিত । তাদের খাবার এত বেশী যে তা অপচয় করা ছাড়া পথ থাকেনা । আরব এখন নবীজীর সেই সংযমের দেশ নাই । বাদশাহ আমীর ও ধনীদের দেশ ভোগ বিলাসের দেশ । সে দেশের মাটির নিচের তেল সম্পদ তাদের ভোগ বিলাসী করেছে ।
কোরআনে বলা হয়েছে “সম্পদ মানুষকে তার আসল জীবন থেকে দূরে সরিয়ে দেয়”। সত্যই তারা কোরআনের প্রদর্শিত পথ থেকে দূরেতো সরে গেছে পাশাপাশি অপচয়কারী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে । কোরআনে আরও বলা হয়েছে “নিশ্চয়ই অপচয়কারীকে আল্লাহ পছন্দ করেননা” আবার বলা হয়েছে “অপব্যায়কারীরা শয়তানের ভাই”। কোরানের এই অমোঘবাণীগুলি যে কোন ব্যাক্তি গোষ্ঠি ও জাতির জন্য প্রযোজ্য । কারো জন্যই তা ভাল নয় । এই ভাল নয় এর প্রভাব তাদের উপর কখন কতটুকু এবং কিভাবে পড়ে তা বলা মুশকিল ।যে কারনে এই ভাল নয় এর প্রভাবের তারা পরওয়া করেনা । তবে এই প্রভাব যদি তাৎক্ষনিকভাবে দৃশ্যমান হতো তাহলে তারা সতর্ক হতো । কিন্তু সেটা দৃশ্যমান নয় বলেই অপচয়কারীদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে । আর এর কুপ্রভাবের শিকার হচ্ছে সাধারন মানুষ । অভাব,অনটন,অশিক্ষা,কুশিক্ষা,রোগবালাই ও অভুক্তদের সঙ্খ্যা বৃদ্ধি হচ্ছে প্রতিদিন ।
আরবে যারা চাকুরী করেন তাদের কাছ থেকে শুনেছি আরবের ধনীরা যখন খেতে বসে তখন হ্রৃষ্ট পুষ্ট পশুর বড় বড় রানের রোষ্ট নিয়ে বসে । তার আংশিক খায় আর বাকীটুকু ফেলে দেয় । কারন উচ্ছিষ্ট খাওয়ার মত গরীব সে দেশে নাই । হজ্বের সময় তারা আল্লাহর কাছ সওয়াব নেওয়ার উদ্দেশ্যে উঁটের এবং দুম্বার মাংশ আর রুটি তৈরী করে বিভিন্ন স্থানে রেখে দেন ।আফ্রিকা সহ গরীব দেশের হাজ্বীরা সেগুলো খায় , তবে অধিকাংশই নষ্ট হয় ।আরবলীগের ৩৪টি দেশের মানুষ তিন বেলার খাবারে যে অপচয় করে তা নেহাত কম নয় । যা ১০০ কোটি মানুষের এক বেলার খাবার তো হতেই পারে । শুধু খাদ্যের অপচয়ই নয় , তাদের জীবনযাত্রার ক্ষেত্রে যে অপচয় করে সেটাও পরিমাপ করা যায়না । তারা এই অপচয় বন্ধ করলে কোটি মানুষের খাদ্যের সংস্থানসহ অনেক অভাব পূরন হতো তাতে কোন সন্দেহ নাই ।
আরবের কথা বাদ দিয়ে যদি শুধু বাংলাদেশের কথাই ধরা যায় তবে সেই অপচয়ের পরিমানও কম নয় ।সম্প্রতি একটি অনুসন্ধানী রিপোর্ট থেকে জানা যায় বছরে কোটি কোটি টাকার অপচয় হচ্ছে আর অন্যদিকে অপুষ্টিতে ভুগছে ৩ কোটি মানুষ ।রিপোর্টে বলা হয়েছে ঢাকার সিটি কর্পোরেশন ও বেসরকারী মিলে প্রায় ২০০টি কমিউনিটি সেন্টার রয়েছে । সেগুলোতে প্রতি মাসে গড়ে ১০ টি করে বিয়ে খাতনা সহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান হলে দুই হাজার অনুষ্ঠান হয় । প্রতিটি অনুষ্ঠানে গড়ে ৪০০জন অতিথি আপ্যায়নের ব্যাবস্থা হয় । এরমধ্যে ২৫ জনের খাবার নষ্ট হলে প্রায় ৫০ হাজার জনের খাবার নষ্ট হয় । প্রতিটি খাবারের মুল্য যদি ৫০০ টাকা ধরা হয় তাহলে মাসে আড়াই কোটি এবং বছরে প্রায় ৩০ কোটি টাকার খাবার নষ্ট হচ্ছে । অনুরুপভাবে শুধুমাত্র ঢাকায় রয়েছে প্রায় ১০ হাজার হোটেল ও রেষ্টুরেন্ট ।প্রতিটি হোটেলে ভোক্তাদের কাছে যে খাদ্য সরবরাহ করা হয় সে খাদ্য থেকেই কমপক্ষে ১ হাজার টাকা মুল্যের খাবার নষ্ট হলে প্রতিদিন১০ হাজার হোটেল ও রেষ্টুরেন্টের নষ্ট খাদ্যের মুল্য দাঁড়ায় এক কোটি টাকা বা বছরে ৩৬০ কোটি টাকা ।আমাদের দেশের এই বিপুল অপচয় কিভাবে রোধ করা যায় তার উপায় খুঁজতে হবে ।
জাতিসংঘের রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রতি ৬ জনে ১ জন পুষ্টিহীনতায় ভুগছে ।অর্থাৎ প্রায় ৩ কোটি মানুষ পুষ্টিহীনতায় ভুগছে । এখনও দেশের মোট জনসংখ্যার ৫০ শতাংশের বেশী মানুষের সুষম খাদ্যের ঘাটতি রয়েছে ।অথচ শুধু ঢাকার কমিউনিটি সেন্টার, হোটেল ও রেষ্টুরেন্টের নষ্ট হওয়া খাদ্য এবং যে ১৫ শতাংশ দানাদার খাদ্য নষ্ট হয় তা বাচাতে পারলে তা দেশের অপুষ্টি ও ক্ষুধা দূর করা যায় ।কিন্তু এই খাদ্য নষ্ট হওয়া বা নষ্ট করার প্রবনতা রোধ করবে কে ? এর উত্তর স্বাভাবিকভাবেই আসবে ,সরকার এবং গনসচেতনতা ।দেশের মানুষকে সংযমী হওয়ার শিক্ষা কে দেবে ?কখন সংযমী হওয়ার সংষ্কৃতি সমাজে চালু হবে তা বলা খুবই কঠিন । কারন প্রথমেই সংযমী হতে হবে দেশের উচ্চ বিত্তদের । তাদের অসংযমীতার কারনেই মানুষ গরীব থেকে গরীবতর হচ্ছে ,পুষ্টিহীনতা সহ অভাব অনটন ও অভুক্ত অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে ।
এক গবেষনায় বলছে প্রকৃতি সৃষ্ট ও মনুষয় সৃষ্ট বিভিন্ন দুর্যোগের কারনে দেশে দেড় কোটী মানুষ দরিদ্র হয়েছে । এসময় ১৩ শতাংশ শ্রমিক চাকুরী হারিয়েছেন । শহরাঞ্চলে ইনফরমাল ইকোনমি থেকে ৬.৭৮ শতাংশ মানুষ কর্মসংস্থান হারিয়েছেন । এছাড়া বিভিন্ন পর্যায়ে ৪০ থেকে ৫০ লাখ মানুষ চাকুরী হারিয়েছেন । নারী উদ্যক্তারা সবচেয়ে ঝুঁকিতে রয়েছেন ।প্রায় ৫০শতাংশ নারী উদ্যক্তা তাদের প্রতিষ্ঠান বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছেন । মানুষের আয় কমেছে ৩৭ শতাংশ । এরমধ্যে ঢাকায় ৪২ শতাংশ ও চট্টগ্রামে ৩৩ শতাংশ এবং বেতন নির্ভর মানুষের আয় কমেছে ৪৯ শতাংশ । বেশী ঝুঁকিতে রয়েছে দেশীয় শিল্প , নির্মান শিল্প , পরিবহন শিল্প ,পাইকারী ও খুচরা পর্যায়ের ব্যাবসা , খাদ্য ও ব্যাক্তিগত সেবা ।দেশ থেকে কোটি কোটি টাকা অবাধে পাচারের কারণে বেশকিছু ব্যাংক দেউলিয়ার পথে । গ্রাহকের জমানো টাকা ফেরৎ দিতে পারছেনা ।অন্যদিকে রয়েছে রাজনৈতিক ডামাডোল বর্তমান এ পরিস্থিতি কো্নদিকে মোড় নেবে তা নির্ভর করছে রাজনৈতিক স্থায়িত্ব ,উন্নতি ও অবনতির উপর ।
সাম্প্রতিককালে বিভিন্ন সংবাদপত্রে ক্ষুধার্ত মানুষের খাদ্য সংকটের খবর এসেছে । যা খুবই বেদনাদায়ক । ছিন্নমুল মানুষের ক্ষুধার যন্ত্রণা ও অসহায়ত্ব বাড়ছে । ফুটপাতের মানুষের জীবনে নেমে এসেছে চরম বিপর্যয় ।তাদের না আছে কাজ না আছে ভিক্ষা চাওয়ার জায়গাগুলো ।এরা অনেকে অপরাধের পথে চলে যাচ্ছে ।যা সামাজিক ভারসাম্য নষ্ট করছে । সাম্প্র্তি ককালের এক জরীপে দেখা যায় নিম্ন আয়ের প্রায় ৭৯ শতাংশই অর্থ সংকটে পড়েছে এবং পেটের ক্ষুধা মেটাতে ঋন করে চলছে ।এ পরিস্থিতিতে মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা দিতে সরকারী সংস্থাগুলো এবং রাজনিতিবিদরা অঞ্চল ভিত্তিক খাদ্য কর্মসুচী গ্রহন করতে পারে । নিরন্নদের অন্ততপক্ষে দুবেলা ডাল ভাতের ব্যাবস্থা করতে পারে । সমাজের বিত্তবানেরা তাদের নিজেদের খাবার অপচয় কমিয়ে সামান্য একটু খেয়াল রাখলে আশেপাশের ক্ষুধার্ত মানুষদের মুখে খাবার দিতে পারে ।
অন্যদিকে কিছু গবেষক বলেছেন বাংলাদেশের সাধারন মানুষ এখনকার চেয়ে এত ভাল কোনদিনই ছিলনা । অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে অনেক ভাল অবস্থানে রয়েছে । বাংলাদেশের মানুষ একসময় না খেয়ে থাকতো সে সংখ্যা ছিল অনেক বেশী । কিন্তু এখন মানুষের খাবার অভাব নাই । লেখাপড়া করতে পারে অনায়াসেই । বাংলাদেশে এক সময় ১৪৫০ কিলো ক্যালোরিরও কম খেত ৩০ শতাংশ মানুষ । এখন সেটা কমে ১০ শতাংশে নেমে এসেছে ।
কিন্তু আসলে কোনটি ঠিক সেটা নিয়েই গবেষনার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে । তবে সত্যি বলতে সাধারন মানুষ এসব গবেষনার ধার ধারেনা , এর ফাঁকফোকর বোঝেনা এবং গুরুত্বও দেয়না ।বোঝে বুদ্ধিজীবীরা । কিন্তু ওইসব বুদ্ধিজীবী আর গবেষকরা আদৌ গ্রামে যান? সাধারন মানুষের খোঁজ খবর নেন ? অন্ততপক্ষে ৬৪ টি জেলার ৬৪ টি গ্রামে সরেজমিনে গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করেন? কতজন অর্ধাহারে কতজন অনাহারে রাত কাটান । তাদের প্রধান সমস্যা কি । সেখানে কত শ্রেণীর মানুষ আছে । কোন শ্রেণীর জীবনযাত্রার মান কেমন । এসব সার্ভে কারো কাছে আছে বলে দাবী করতে পারেন ? উত্তর হবে না । কারন গড় পড়তা হিসাব মিলিয়ে গবেষনপত্র হাজির করলেই তো হয় ।এই কাজটি করার ঐতিহাসিক দায়িত্ব ছিল রাজনীতিবিদদের । সে কাজটা তারা বহু পুর্বেই ত্যাগ করেছেন ।কারন কালো টাকা ,গালভরা কথা , মিথ্যা প্রতিশ্রুতি আর প্রচারে জোর থাকলেই রাজনীতি হয় , ভোট পাওয়া যায় ।এরচেয়ে সহজ সরল পথ আর কিছু হতে পারেনা । অপচয়, অপব্যয় , অপব্যাবহার এসব মানবতাবাদীদের কথা । এসব কথা ভাবলে রাজনীতি হবেনা ।
লেখক- সাংবাদিক ও কলামিস্ট