গাজার সমর্থনে সিডনির রাস্তায় লক্ষ মানুষের ঢল: ইতিহাসের বৃহত্তম বিক্ষোভ

ফারুক আমিন : ৩ আগস্ট ২০২৫, রবিবার অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে ফিলিস্তিনে চলমান গণহত্যা বন্ধ এবং ইসরায়েলী গণহত্যাকারীদের বিচারের দাবিতে আয়োজিত হয় অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসে অন্যতম বৃহৎ প্রতিবাদ সমাবেশ। প্যালেস্টাইন অ্যাকশন গ্রুপের উদ্যোগে আয়োজিত এই কর্মসূচিতে সিডনির বিখ্যাত হারবার ব্রিজের উপর মিছিলে অংশ নেন লাখেরও বেশি মানুষ। তাদের সাথে ছিলেন উইকিলিকস প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ, গ্রিন পার্টির সিনেটর ডেভিড শুব্রিজসহ অনেক রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ।

গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে প্যালেস্টাইন অ্যাকশন গ্রুপ প্রতি রবিবার হাইড পার্কে ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছে। সম্প্রতি তারা ঘোষণা দেয় যে ৩ আগস্টের কর্মসূচি হবে হারবার ব্রিজের উপর দিয়ে মিছিল।

অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক হিসেবে সিডনি হারবার ব্রিজ সাধারণত কেবল রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান ছাড়া বন্ধ করা হয় না। আয়োজকেরা পুলিশের কাছে অনুমতি চাইলেও নিউ সাউথ ওয়েলস পুলিশ তা নাকচ করে এবং সমাবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এমনকি রাজ্যের প্রিমিয়ার ও লেবার পার্টির নেতা ক্রিস মিনসও এ সমাবেশের বিরোধিতা করেন। পাশাপাশি ডানপন্থী রাজনীতিক ও গণমাধ্যমগুলোর অনেকেই এই কর্মসূচিকে টার্গেট করে সমালোচনায় মুখর হন।

প্যালেস্টাইন অ্যাকশন গ্রুপ পুলিশের নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে গেলে শুক্রবার পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। অবশেষে শনিবার আদালতের বিশেষ শুনানিতে বিচারক বেলিন্ডা রিগ পুলিশের আদেশ বাতিল করে দেন এবং প্রতিবাদকে মতপ্রকাশের অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেন। সিডনির লর্ড মেয়র ক্লোভার মোর এক বিবৃতিতে বলেন, এই কর্মসূচি ছিল অস্ট্রেলিয়ান মানুষের রাজনৈতিক অধিকার চর্চার এক শক্তিশালী প্রকাশ। আদালতের রায় অনুসরণ করে পুলিশ বাধ্য হয়ে রবিবার আজ দুপুরে পাঁচ ঘণ্টার জন্য হারবার ব্রিজ যানচলাচলের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে।  লর্ড মেয়র নিজেও এ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেছেন।

সকাল থেকেই সিডনির বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজার হাজার মানুষ বাস, ট্রেন বা মিছিল করে সিবিডিতে জড়ো হতে থাকেন। প্রচণ্ড ঠান্ডা ও বৃষ্টি উপেক্ষা করে সব বয়স, ধর্ম ও পেশার মানুষ এই বিক্ষোভে অংশ নেন। দুপুর একটার আগেই সিডনির সিবিডি এলাকা পুরোপুরি অচল হয়ে পড়ে। ইয়র্ক স্ট্রিট থেকে শুরু করে চায়নাটাউন, সারি হিলস, রেডফার্ন পর্যন্ত রাস্তায় জনস্রোত উপচে পড়ে।

বিক্ষোভকারীদের অনেকেই নিজেরা খাবার ও প্লাস্টিক কভার নিয়ে এসেছিলেন বৃষ্টিতে অন্যদের সাহায্য করতে। ছোট শিশুদেরকে প্র্যামে চড়ে এবং বৃদ্ধদেরও হুইলচেয়ারে বসিয়ে বিক্ষোভে অংশ নিতে দেখা গেছে। পুরো সিডনি যেন আজ গাজার পাশে দাঁড়িয়েছিল।

দুপুরের পর বিপুল সংখ্যক মানুষ হারবার ব্রিজ পার হতে শুরু করলে বিকেল আড়াইটায় পুলিশ জানায় প্রায় ৯০ হাজার মানুষ ব্রিজের উপর উঠে গেছেন, যা নিরাপত্তার ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। এরপর পুলিশ জিওলোকেশন প্রযুক্তি ব্যবহার করে অংশগ্রহণকারীদের মোবাইলে বার্তা পাঠিয়ে শৃঙ্খলা বজায় রাখার অনুরোধ জানায়।

এত মানুষ অংশ নেওয়ায় বহু অংশগ্রহণকারী ব্রিজে উঠতেই পারেননি। আয়োজকদের দাবি অনুযায়ী তিন লক্ষাধিক মানুষ বিক্ষোভে অংশ নেন। মূলধারার গণমাধ্যমগুলো অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা দেড় থেকে দুই লাখ বলে জানায়।

বিকেলের দিকে বৃষ্টি বাড়লেও সমাবেশ শান্তিপূর্ণভাবেই শেষ হয়। পুলিশ হেলিকপ্টার, অশ্বারোহী ও পদাতিক পুলিশের উপস্থিতিতে মিছিলকারীরা ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে ট্রেন স্টেশন ও ফেরিঘাটের দিকে ফিরে যান। এই সমাবেশে কোনো কেন্দ্রীয় মঞ্চ বা বক্তৃতা ছিল না। ছোট ছোট দলের মানুষজন নিজেদের মতো নিজস্ব স্লোগান নিয়ে প্রতিবাদে অংশ নেন। হাজারো স্বেচ্ছাসেবক হাতে হ্যান্ডমাইক নিয়ে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে কাজ করেন।

অসংখ্য ধর্মীয়, পেশাজীবী, সামাজিক সংগঠন নিজেদের ব্যানার নিয়ে আজকের বিক্ষোভে অংশ নিয়েছে। সমাবেশ জুড়ে ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এবং নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে ধিক্কার জানানো হয়। প্রধানমন্ত্রী আলবানিজিকে গণহত্যার প্রতি সমর্থনের জন্য ব্যঙ্গচিত্রে তুলে ধরেন অনেক বিক্ষোভকারী। লেবার পার্টি ও অস্ট্রেলিয়ান সরকারের ভূমিকাও বিভিন্ন স্লোগানে তীব্রভাবে সমালোচিত হয়। এত বিপুল সংখ্যক সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ রাজনৈতিক ও অন্যান্য স্বার্থের উর্ধ্বে উঠে অস্ট্রেলিয়ান সমাজে ফিলিস্তিনের নির্যাতিত মানুষের প্রতি ক্রমবর্ধিত সহানুভূতি ও সমর্থনের একটি শক্তিশালী প্রকাশ হিসেবেই আজ পুরো দেশের সামনে পরিস্কারভাবে প্রতিভাত হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *