দাওয়াত তাবলীগের বিভেদ: উম্মতের জন্য মহাসংকট

-এম এ ইউসুফ শামীম: বাংলাদেশসহ গোটা মুসলিম উম্মাহ আজ যে সংকটের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে, তার একটি বড় কারণ অভ্যন্তরীণ বিভেদ। ইসলামের নাম নিয়ে, দাওয়াত ও তাবলীগের নামে যারা মাঠে নেমেছেন,তাদের ভেতরকার মতভেদ আজ নতুন কোনো বিষয় নয়, তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এটি ক্রমেই প্রকাশ্য রূপ নিচ্ছে। যা হওয়া উচিত ছিল উম্মাহকে ঐক্যবদ্ধ করার হাতিয়ার, তা পরিণত হয়েছে বিরোধ, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব এবং দ্বিধাবিভক্তির জালে।

তাবলীগ জামাত মূলত আত্মশুদ্ধি, আল্লাহর পথে মানুষকে দাওয়াত দেওয়া এবং দ্বীনকে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা করার একটি শান্তিপূর্ণ প্রচেষ্টা। শত বছরের এই আন্দোলন অসংখ্য মুসলমানদেরকে  আল্লাহর দিকে ফিরিয়ে এনেছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, আজ এর ভেতরকার দ্বন্দ্ব উম্মতের জন্য একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মসজিদ-মাদরাসায়, এমনকি গ্রামের টং দোকানের আড্ডাতেও তাবলীগের ভিন্ন ভিন্ন “দল” নিয়ে আলোচনা হয়। এক পক্ষ আরেক পক্ষকে ছোট করে দেখে, নিন্দা করে, কখনো কখনো শারীরিক সংঘর্ষেও জড়িয়ে পড়ে।

দাওয়াত ও তাবলিগ নবী-রাসুলদের কাজ। আদম (আ.) থেকে মুহাম্মদ (স.) পর্যন্ত সকলের অভিন্ন দায়িত্ব ছিল দ্বীনের দাওয়াত ও তাবলিগ। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি আপনার আগে যে রাসুলই প্রেরণ করেছি, তার প্রতি অবশ্যই এ ওহি পাঠিয়েছি যে, আমি ছাড়া কোনো উপাস্য নেই। অতএব, আমার ইবাদত করো। (সুরা আম্বিয়া: ২৫)

দাওয়াত-তাবলিগের কল্যাণেই মুসলিম উম্মাহ দ্বীন ইসলামকে চিনতে পেরেছে, গ্রহণ করে ধন্য হয়েছে। তালিমের মাধ্যমে নিজেদের আকিদা-কর্ম পরিশুদ্ধ করেছে। নবী (স.) প্রথমে দ্বীনের দাওয়াত দিতেন, যারা দাওয়াত কবুল করতেন তাদের গড়ে তুলতেন দ্বীনের তালিম-তাজকিয়ার মাধ্যমে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন- لَقَدْ مَنَّ اللهُ عَلَی الْمُؤْمِنِیْنَ اِذْ بَعَثَ فِیْهِمْ رَسُوْلًا مِّنْ اَنْفُسِهِمْ یَتْلُوْا عَلَیْهِمْ اٰیٰتِهٖ وَ یُزَكِّیْهِمْ وَ یُعَلِّمُهُمُ الْكِتٰبَ وَ الْحِكْمَة ‘মুমিনদের ওপর আল্লাহ বড় অনুগ্রহ করেছেন যে, তাদের মাঝে এমন একজন রাসুল পাঠিয়েছেন, যিনি তাদের সামনে আল্লাহর কালাম তেলাওয়াত করে শোনান, তাদেরকে পরিশুদ্ধ করেন, তাদেরকে কিতাব ও হেকমতের তালিম প্রদান করেন।’ (সুরা আলে ইমরান: ১৬৪)

আল্লাহ তাআলা দাঈদের প্রেরণা দিয়ে বলেন: ‘সে ব্যক্তির চেয়ে আর কার কথা উত্তম হতে পারে যে মানুষকে আল্লাহর পথে দাওয়াত দেয় এবং নিজে সৎকাজ করে আর বলে আমি মুসলামনদের অন্তর্ভুক্ত।’ (সুরা হা-মিম সাজদাহ: ৩৩)

মহানবী (স.) দাওয়াতের এই গুরুদায়িত্ব এই উম্মতের উপর অর্পণ করেছেন। বিদায় হজের ভাষণে তিনি বলেন: ‘হে লোক সকল! তোমরা যারা উপস্থিত আছ তাদের দায়িত্ব হচ্ছে অনুপস্থিতদের এ বাণী পৌঁছে দেওয়া’। (বুখারি: ৪৪০৬) অন্য হাদিসে রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘আমার একটি বাণী হলেও তোমরা পৌঁছে দাও।’ (বুখারি: ৩৪৬১)

দাওয়াত মানে আহ্বান, তাবলিগ অর্থ পৌঁছানো। ইসলামের অনুপম আদর্শের প্রতি মানুষকে ডাকা হলো দাওয়াত। ইসলামের কল্যাণের বিষয়গুলো মানুষের দ্বারে দ্বারে পৌঁছে দেওয়া হলো তাবলিগ। এই দাওয়াত ও তাবলিগের কাজ থেকে দূরে থাকা অন্তত এই উম্মতের বৈশিষ্ট্য হতে পারে না। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে- ‘তোমরা শ্রেষ্ঠ উম্মত। তোমাদের মানুষের কল্যাণে সৃষ্টি করা হয়েছে। তোমরা মানুষদের সৎ কাজের আদেশ করবে এবং অন্যায়মূলক কাজ থেকে বাধা প্রদান করবে। এবং আল্লাহ ওপর ঈমান আনবে।’ (সুরা আলে ইমরান: ১১০)

আরও ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনগণ, তোমাদিগকে কি এমন একটি ব্যবসার সন্ধান দান করব যা তোমাদেরকে কঠোর আজাব থেকে রক্ষা করবে? তা হলো- তোমরা আল্লাহর ওপর ও আল্লাহর রাসূলের ওপর ঈমান আনবে, মেহনত করবে আল্লাহর রাস্তায় মাল ও জান দিয়ে।’ (সুরা আস-সাফ: ১০)

দাওয়াতি কাজ অনেক মুবারকময় আমল। হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহর রাস্তায় একটা সকাল বা একটা বিকাল ব্যয় করা সারা দুনিয়ার মধ্যে যা কিছু আছে তার চেয়ে উত্তম।’ (বুখারি: ২৭৯২; মুসলিম: ১৮৮০)

অমুসলিমদের মাঝে দ্বীনের দাওয়াত দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ জিম্মাদারি হলেও মুসলিমদের মাঝেও দাওয়াতি কার্যক্রম থাকতে হবে। কোনো খাস আমল ও বিধানের ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করার জন্যও দাওয়াত হতে পারে, শিরক-বিদআত ও নাস্তিকতার ব্যাপারে সতর্কতা তৈরির জন্য দাওয়াত হতে পারে। দাওয়াতের আরও অনেক ক্ষেত্র আছে। তাছাড়া এক ময়দানের কাজও কয়েক পদ্ধতিতে কয়েক স্তরে করা যায়। সঠিক নিয়মে যুক্তিতর্ক করা, ওয়াজ-নসিহত করা দাওয়াতেরই এক তরিকা, যার কথা কোরআনে এসেছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘আপনি মানুষকে আপনার প্রতিপালকের পথে আহ্বান করুন হেকমত ও সদুপদেশ দ্বারা এবং তাদের সঙ্গে তর্ক করবেন উত্তম পন্থায়।’ (সুরা নাহল: ১২৫)

রাসূল সাঃ ইরশাদ করেন-আমার পক্ষ থেকে একটি বাণী হলেও [মানুষের কাছে] পৌঁছে দাও। {তাহাবী শরীফ, হাদীস নং-৫৫৭০, সহীহ বুখারী, হাদীস নং-৩২৭৪, সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস নং-৬২৫৬, সুনানে তিরমিযী, হাদীস নং-২৬৬৯

সাহাবায়ে কিরাম রাসূল সাঃ এর উক্ত নির্দেশের বাস্তবায়ন ঘটিয়েছেন যথাযথভাবে। পরবর্তীতে সর্বযুগেই উলামায়ে উম্মত “ওলামায়ে কিরামই হলেন নবীদের ওয়ারিস” হাদীসের সফল বাস্তবায়নের জন্য জীবন বাজী রেখে সংগ্রাম করেছেন।

উল্লেখিত আয়াত ও হাদীস ছাড়াও অসংখ্য আয়াত ও হাদীসে তাবলীগ তথা দ্বীন প্রচার ও প্রসারের প্রতি উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে।

এ বিভেদের সুযোগ সবচেয়ে বেশি নিচ্ছে শয়তান। কারণ শয়তানের মূল কৌশলই হলো মুসলমানদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করা। কোরআনে আল্লাহ তাআলা সতর্ক করেছেন, “তোমরা সবাই আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরো এবং বিভক্ত হয়ো না।” কিন্তু আজ আমরা সেই আদেশকে পাশ কাটিয়ে বিভেদকেই লালন করছি। দাওয়াতের কাজ, যা হওয়ার কথা ছিল মানুষের হৃদয়কে আল্লাহর দিকে টেনে আনার মাধ্যম, তা আজ অনেক ক্ষেত্রে হয়ে উঠছে অহংকার, হিংসা আর পার্থিব নেতৃত্বের লড়াই।

বিশ্বের প্রায় ২০০ দেশে দাওয়াতের কাজ চলছে। দাওয়াত ছিল প্রতিটি নবী-রাসূলের মূল দায়িত্ব। শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ ﷺ এর সম্মানিত সাহাবাগণ (রা.) সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছিলেন এ দাওয়াতের কাজ নিয়েই। তাঁরা যে দেশে গেছেন, সেখানকার বাদশাহকে প্রথমেই বলেছেন—

“লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ।”

অর্থাৎ, “আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্য মাবুদ নেই, আর মুহাম্মদ ﷺ তাঁর রাসূল।” যদি দাওয়াত গ্রহণ না করা হয়, তবে জিজিয়া প্রদানের আহ্বান জানাতেন—জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তার শর্তে। আর সবকিছু অস্বীকার করলে তারা সম্মুখযুদ্ধে অবতীর্ণ হতেন।

আজকের যুগে মুসলমানরা সবচেয়ে দুর্বল অবস্থায় রয়েছে। এর ফলেই পুরো বিশ্বে অশান্তি ও হাহাকার বিরাজ করছে। তাই দাওয়াতে তাবলীগ প্রথমেই মুসলমানদের ঈমান ও আমল মজবুত করার দাওয়াত দেয়। পাশাপাশি অমুসলমানদের প্রতি তাওহীদের দাওয়াতও পৌঁছে দেয়। এ মেহনতের ফলে বিশ্বের নানান প্রান্তে পরিবর্তন আসছে—মানুষ ইসলাম গ্রহণ করছে, মসজিদ-মাদরাসা বাড়ছে, দ্বীনের কাজ বিস্তৃত হচ্ছে। তবে তাবলিগ জামাতের কোনো অফিসিয়াল ওয়েবসাইট বা সামাজিক মাধ্যম না থাকায় এসব পরিবর্তনের খবর সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছায় না।

অস্ট্রেলিয়াতেও সিডনি, মেলবোর্ন, ব্রিসবেনসহ প্রায় প্রতিটি শহরে এবং দূরবর্তী দ্বীপাঞ্চলেও মেহনত চলছে। সেখানে জামাত যাচ্ছে, মানুষ মুসলমান হচ্ছে, মসজিদ নির্মিত হচ্ছে।

কারগুজারি: এক দ্বীনের দাঈ, যিনি একজন ডাক্তার, একটি জামাত নিয়ে এডিলেইড গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি অনেক ডাক্তারকে দ্বীনের দিকে আহ্বান করেছেন। অবশেষে তাঁর দীর্ঘদিনের পরিচিত একজন সিনিয়র ডাক্তারের কাছে দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছাতে গিয়ে তিনি প্রবল হতাশার অভিজ্ঞতা অর্জন করেন এবং বিষয়টি আমার সাথে শেয়ার করেন।

এ থেকে স্পষ্ট, আমাদের উলামায়ে কেরামের বিভক্তির কারণে গোটা উম্মত আজ কষ্ট ভোগ করছে। অথচ আল্লাহ চাইলে সম্মানিত উলামাবৃন্দ আবারও একসাথে বসতে পারেন। তখন আমাদের কী হবে? সবাই দ্বীনের কাজ করছেন, বিভেদ আছে—তবুও কি ন্যূনতম সৌজন্যবোধও আমরা ত্যাগ করব? এক মুসলমান আরেক মুসলমানকে সালাম দেবে—এটা ফরজের কাছাকাছি একটি দায়িত্ব। কেউ সালাম দিলে তার উত্তর দেয়া ওয়াজিব।

তাহলে আমরা যদি সালাম-কালাম বর্জন করে দাওয়াতের কাজ করি, সেটার প্রকৃত উপকার কার হবে? যে ব্যক্তি নিজের পরিবারকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাতে পারে না, রাস্তার সাধারণ মানুষের সাথে তার পার্থক্যই বা কী?

প্রশ্ন হচ্ছে, এর ক্ষতি কার? নিঃসন্দেহে উম্মতের। সাধারণ মুসলমান যারা দাওয়াতের পরিবেশ থেকে আত্মশুদ্ধি শিখতে চেয়েছিল, তারা বিভ্রান্ত হচ্ছে। অনেকে দূরে সরে যাচ্ছে, বলছে “এরা নিজেদের মধ্যেই একমত হতে পারে না, আবার মানুষকে ইসলাম শেখাবে কীভাবে?” এতে ইসলামবিরোধীরা হাসছে, শয়তান লাভবান হচ্ছে, আর মুসলমানরা হারাচ্ছে আধ্যাত্মিক শক্তি ও ঐক্য।

আজ প্রয়োজন সৎ সাহস ও বিনয়ের সঙ্গে বিভেদের অবসান ঘটানো। যারা দ্বীন নিয়ে কাজ করছেন, তাদের মনে রাখতে হবে , এ কাজ কোনো ব্যক্তি বা দলের স্বার্থে নয়, এটি একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। তাই মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও একে অপরকে অপমান বা অস্বীকার করা কখনোই সমাধান নয়। বরং দরকার পারস্পরিক শ্রদ্ধা, আলাপ-আলোচনা, এবং সর্বোপরি আল্লাহর পথে একসাথে চলার দৃঢ় সংকল্প।

যতদিন আমরা নিজেরা নিজেদের মধ্যে লড়াই করব, ততদিন উম্মাহ দুর্বল থাকবে। তাই এখনই সময়—“আমরা” এবং “তারা”র রাজনীতি বাদ দিয়ে “আমরা সবাই মুসলমান” এই পরিচয়ে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার। শয়তানের জয় নয়, ইসলামের জয় নিশ্চিত করতে হলে দাওয়াতের ময়দানে ভ্রাতৃত্ব, বিনয় ও সহনশীলতাকেই সর্বাগ্রে স্থান দিতে হবে।আজকের এই বিভেদে শয়তান হাসছে, আর মুসলমান কাঁদছে। ঐক্যের পথে ফিরে আসার, আল্লাহর কাজে নিজেকে নিবেদিত করার এবং উম্মতকে আবার সেই আলোয় ফিরিয়ে নেওয়ার, যে আলো দাওয়াত ও তাবলীগের আসল চেতনা।

আমাদের মনে রাখতে হবে, দাওয়াত কোনো ব্যক্তিগত গোষ্ঠীর সম্পত্তি নয়, বরং এটি নবীদের মিশন, সমগ্র উম্মতের দায়িত্ব। বিভেদ নয়, ঐক্যই উম্মতের শক্তি। যদি আমরা কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে ঐক্যবদ্ধভাবে দাওয়াতের কাজ চালিয়ে যাই, তবে উম্মত উপকৃত হবে এবং শয়তান পরাজিত হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *