নির্বাচনের পথে: ঐক্যবদ্ধ মঞ্চে কৌশলগত বিভাজন

মিজানুর রহমান সুমন: গত ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের পর দেশের রাজনীতিতে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে। শান্তিতে নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে যখন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে, তখন দেশের প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলোর মধ্যেকার কৌশলগত টানাপোড়েন এখন স্পষ্ট। একসময় যারা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সরকার পতনের আন্দোলন করেছে, সেই বিএনপি এবং তার দীর্ঘদিনের মিত্র জামায়াতে ইসলামী এখন নির্বাচনের বৈতরণী পার হতে সম্পূর্ণ ভিন্ন পথ ও কৌশল অবলম্বন করছে। এই দ্বিমুখী প্রস্তুতি কেবল নির্বাচনী কৌশল নয়, এটি দেশের রাজনীতিতে এক নয়া মেরূকরণের ইঙ্গিতও বটে।

জামায়াতে ইসলামীর তৎপরতা দেখলে মনে হয় তারা দ্রুততম সময়ে নির্বাচনের মাঠে নিজেদের অবস্থান সুসংহত করতে চাইছে। ইতোমধ্যেই তারা দেশের প্রায় সব আসনেই অনানুষ্ঠানিকভাবে একক প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছে এবং তাদের প্রার্থীরা ‘নির্বাচনী’ ব্যানার-পোস্টার সাঁটিয়ে কার্যত নির্বাচনী প্রচার শুরু করে দিয়েছেন। একই সঙ্গে, তারা জুলাই সনদ ঘোষণা ও বাস্তবায়ন এবং সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতিতে নির্বাচনসহ পাঁচ দফা দাবিতে আন্দোলনের মাধ্যমে রাজনীতির মাঠ দখলের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। এই কৌশলটির দুটি উদ্দেশ্য—প্রথমত, নির্বাচনের আগে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করা; দ্বিতীয়ত, বিএনপির ওপর কৌশলগত চাপ সৃষ্টি করে নির্বাচনী জোটে আরও অনুকূল শর্ত আদায় করে নেওয়া। জামায়াতের এই ‘একলা চলো’ নীতি যেন বৃহত্তর ঐক্যের চেয়ে দলীয় প্রাধান্য বিস্তারের দিকেই বেশি মনোযোগী।

অন্যদিকে, বিএনপি তুলনামূলকভাবে ধীরে ও সুচিন্তিতভাবে এগোচ্ছে। তাদের সম্ভাব্য প্রার্থীদের ‘নির্বাচনী’ ব্যানার-পোস্টার এখনো দৃশ্যমান না হলেও, ভেতরে ভেতরে প্রার্থী বাছাই প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে সম্ভাব্য প্রার্থীদের ডেকে কথা বলছেন। দলটির নেতারা চান দ্রুত নির্বাচনের মাধ্যমে নিজেদের জনপ্রিয়তা প্রমাণ করে ক্ষমতায় ফিরতে। তবে এই মুহূর্তে তাদের প্রধান মনোযোগ কেবল সাংগঠনিক প্রস্তুতিতে নয়, বরং জনসম্পৃক্ততা ও সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে। বাঙালি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজায় সনাতন সম্প্রদায়ের পাশে থেকে কাজ করার তাদের সিদ্ধান্ত সেই জনসম্পৃক্ততারই অংশ। পূজা শেষে তারা নির্বাচনমুখী জনসম্পৃক্ত কর্মসূচি নিয়ে সাধারণ মানুষের দ্বারে দ্বারে যাবেন বলে জানা গেছে, যা সাংস্কৃতিক সংবেদনশীলতা দিয়ে ভোটারদের মন জয়ের একটি প্রচেষ্টা।

এই কৌশলগত বিভাজন ও তৎপরতার বাইরে এসে বৃহত্তর ঐক্যের দিকে দৃষ্টি দিলে, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এবং গণতন্ত্র মঞ্চের অন্য দলগুলোর তৎপরতাও চোখে পড়ে। এনসিপি এবং গণঅধিকার পরিষদের মতো নতুন শক্তিগুলো কোনো বৃহৎ দলের ‘ট্যাগ’ না নিয়ে ‘মধ্যপন্থী’ দল হিসেবে নিজেদের পরিচিতি গড়ে তুলতে এবং তৃতীয় একটি জোট বা নির্বাচনী মোর্চা তৈরির চেষ্টায় আছে। বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের দূরত্ব ও পিআর পদ্ধতি নিয়ে তাদের মধ্যেকার মতভেদ কাজে লাগিয়ে এই ছোট দলগুলো রাজনীতিতে স্বতন্ত্র অবস্থান তৈরি করতে চাইছে। এই বহুমাত্রিক মেরুকরণ ইঙ্গিত দেয় যে, ট্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন কেবল ক্ষমতা পরিবর্তনের নির্বাচন হবে না, এটি একই সঙ্গে সাবেক মিত্রদের মধ্যকার রাজনৈতিক প্রাধান্য ও কৌশলগত শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইও হবে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. মো. সাহাবুল হক যেমনটি বলেছেন, প্রতিটি দলেরই নিজস্ব নির্বাচনী কৌশল থাকে, কিন্তু এই কৌশলগত দূরত্ব যদি গণতান্ত্রিক ঐক্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, তবে তা জাতীয় নির্বাচনকে কিছুটা অনিশ্চিত করে তুলতে পারে। একটি স্বৈরাচারী সরকারের পতনের পর যখন একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের আশা জেগেছে, তখন দেশের দুই প্রধান বিরোধী শক্তির এই ‘দ্বিমুখী প্রস্তুতি’ শেষ পর্যন্ত কোন দিকে মোড় নেয়, তা কেবল কে জিতল বা হারল সেটির চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এই কৌশলগত প্রতিযোগিতা যেন জনগণের কাঙ্ক্ষিত সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনকে কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না করে, সেই দিকেই এখন দেশের আপামর জনতার নজর।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *