একটি গোলাপের অকস্মাৎ প্রস্থান

  • অরুণ বর্মন

জানি মৃত্যু অমোঘ সত্য। পৃথিবীতে কেউই অনন্তকাল বাঁচবে না। জন্ম হলে তার মৃত্যু অবসম্ভাবী। এই চরম সত্যকে মেনে নিয়েও এমন অপ্রত্যাশিত মৃত্যু মেনে নিতে হৃদয় ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে। এভাবে অসময়ে একান্ত আপনজনের চলে যাওয়া অন্তরকে ব্যথায় মথিত করেছে। শোকস্তব্ধ করেছে গোটা যশোরবাসীকে। রক্ত ক্ষরণ হচ্ছে বিদ্রোহী সাহিত্য পরিষদসহ যশোর সাহিত্যাঙ্গনের প্রতিটি প্রাণে। একটা গোলাপের এভাবে আকষ্মিক প্রস্থানে নির্বাক, শোকস্তব্ধ যশোরবাসী। কখনো কখনো এমন কিছু আকষ্মিক মৃত্যুর ঝঙ্কার কানে আসে যা জীবনকে ক্ষণিকের জন্য স্তম্ভিত করে দিয়ে যায়, প্রাণের স্পন্দনে সাময়িক ফুলস্টপ দিয়ে যায়, বোধশক্তিকে নির্বাক করে দিয়ে যায়, সমস্ত সত্ত্বাকে অবসন্নতার আঁধারে ভরিয়ে দিয়ে যায় । আমাদের বেঁচে থাকাকে অর্থহীন করে তোলে। তেমনই একটি মৃত্যু যশোর সাহিত্যাঙ্গনের উদীয়মান নক্ষত্র, প্রতিবাদী কন্ঠস্বর, সময়ের সাহসী সৈনিক কবি নূরজাহান আরা নীতির। তার এই হঠাৎ চলে যাওয়া যশোরের সাহিত্যাঙ্গনের হৃদস্পন্দনকে এলোমেলো করে দিয়ে গেছে। এমন মৃত্যু সত্যি মেনে নেওয়া কঠিন। যে মানুষটি একদিন আগে অর্থাৎ শনিবার বিকালে ভরা মঞ্চে দাঁড়িয়ে তার হাতে গড়া প্রাণের সংগঠন বিদ্রোহী সাহিত্য পরিষদকে নিয়ে একটা দীর্ঘ প্রবন্ধ উপস্থাপন করলো সেই মানুষটিকেই কিনা সোমবার সকালে কফিনে বয়ে তার গ্রামের বড়িতে দাফনের উদ্দেশ্যে রওনা দিতে হলো। এ কেমন মৃত্যু? চোখের সামনে দেখতে দেখতে শেষ হয়ে গেলো এমন একটা তরতাজা প্রাণ। কাঁদিয়ে গেলো যশোরবাসীকে, কাঁদিয়ে গেলো তার প্রাণের সংগঠন বিদ্রোহী সাহিত্য পরিষদসহ সকল সfহিত্যানুরাগীকে। তার এই হঠাৎ চলে যাওয়ায় যশোর সাহিত্যাঙ্গনে নেমে এসেছে এক বিষাদের ছায়া। শোকে মূহ্যমান সকল কবি সাহিত্যকসহ যশোরের আপামর জনতা। কবি ও সংগঠক নূরজাহান আরা নীতি একটি সাহসী ও সংগ্রামী প্রতিবাদী কন্ঠের নাম। কবি নূরজাহান আরা নীতি জীবন সংগ্রামের স্মারক। গরীব, দীন-দুঃখী ও নারীর অধিকার আদায়ের সামনের সারির সংগ্রামী কর্মি । কবি নূরজাহান আরা নীতির জন্ম ১৯৭৯ খৃষ্টাব্দের ১লা আগস্ট নড়াইল জেলা সদরের শহরস্থ ডুমুরতলার ঐতিহ্যবাহী মোল্যা পরিবারে। যে পরিবার ছিলো তৎকালীর সময়ের দক্ষিণবঙ্গের বাম আন্দোলনের আঁতুড় ঘর । তাঁর পিতামহ ছিলেন তেভাগা আন্দোলনের প্রাণ পুরুষ নূর জালাল মোল্যা। তাঁর পিতা বাম আন্দোলনের একজন একনিষ্ট কর্মী নওরোজ মোল্যা। তাঁর মাতা ছিলেন হাজারো কৃষকের নেত্রী হাসিনা মমতাজ। কবি নূরজাহান আরা নীতি ছয় ভাই-বোনের মধ্যে ছিলেন সবার বড়। তাঁর শৈশব কৈশোর কেটেছে বিশ্বনন্দিত চিত্রশিল্পী এস.এম সুলতানের পূণ্যভূমি নড়াইলের আলো, বাতাস, নদী, বৃক্ষরাজি, ফুল, ফল ভালোবেসে। তার শিক্ষাজীবন কেটেছে নড়াইল শহরেরই বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। তিনি নড়াইলে সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক ও নড়াইল সরকারী মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয় থেকে ১৯৯৪ সালে এস.এস.সি পাশ করেন। এরপর ভর্তি হন নড়াইল সরকারি মহিলা কলেজে। এখান থেকে ১৯৯৭ সালে এইচ.এস.সি পাস করে চলে আসেন উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য যশোর শহরে। তিনি স্কুল ও কলেজ জীবনে আবৃত্তি, বক্তৃতা, বিতর্কসহ যে কোনো প্রতিযোগিতায় ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তার পারিবারিক উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া কথা বলার সাবলীলতা ও দক্ষ বাচনভঙ্গী তাঁকে সবসময় জীবনের সাফল্যের দ্বার প্রান্তে নিয়ে গেছে। শত ঘাত প্রতিঘাত বাঁধাকে অতিক্রম করে তুলে দিয়েছে কৃতিত্ত্বের উচ্চ শিখরে। তাঁর জীবনটা কখনও কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। শৈশব থেকেই অত্যন্ত কষ্টের সাথে সংগ্রাম করে মানুষ হয়েছেন। মাত্র তের বছর বয়সে মা মারা যায়। তিনি তখন সবে নবম শ্রেণির ছাত্রী অর্থাৎ ১৯৯২ সালের ২ জুলাই তাঁর মা যখন তাদের ছেড়ে ইহলোকে পড়ি জমান তখন তিনি বালিকা কিশোরীর সন্ধিক্ষণে। এই অসময় মাতৃহারা হয়ে পুরো পরিবারের সাথে তিনিও যখন দিশেহারা, কি করবে কুলকিনারা খুঁজে পাচ্ছেনা তখন বড় বোন হিসেবে নিতে হলো পরিবারের দায়িত্ব। তাকে সেই বালিকা বয়সেই পরিবারের মায়ের কর্তব্য কাঁধে তুলে নিয়ে ছোট ছোট ভাই-বোনদের সকলকে মায়ের স্নেহে লালন-পালন করতে হয়, পড়ালেখা শিখাতে হয়। তবু তিনি কোথাও পিছপা হননি। তাদের আদর ,স্নেহ, যত্ন, দায়িত্বশীলতা দিয়ে মানুষ করেছেন। স্কুল জীবন থেকেই লেখাপড়ার পাশাপাশি তার পিতামহ-পিতামহীর অনুপ্রেরণায় শুরু করেছিলেন সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক চর্চা। পারিবারক ঐতিহ্যকে ধারণ করে উদার মন নিয়ে এগিয়েছিলেন একটি প্রগতিশীল মুক্ত চিন্তার সমাজ ব্যবস্থা কায়েমের লক্ষ্যে। মনে ছিল একজন আদর্শ মানুষ হওয়ার প্রত্যয়। মাত্র তের বছর বয়সে মায়ের মৃত্যু। তারপর ছোট ছোট পাঁচটা ভাই-বোনকে দেখাশোনা করা, মানুষ করা পাশাপাশি নিজে লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া, সাহিত্য সাংস্কৃতিক অঙ্গনে সবজায়গায় সরব পদচারণা করা, বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনে সংযুক্ত থাকা। একসঙ্গে এতোগুলো কাজ করা কম কথা নয়। ঐসময় তাকে কতটা ধৈর্য্যশীলতার পরিচয় দিতে হয়েছে তা ভাবলে অবাক হতে হয়। তবু তিনি হাল ছাড়েননি। তিনি তার পিতামহ পিতামহীর সহযোগিতা ও অনুপ্রেরণায় ভাই-বোনদের মানুষ করার পাশাপাশি নিজের পড়াশোনা চালিয়ে যান এবং সাহিত্যচর্চা ও সাংস্কৃতিক জগতে পদচারণা অব্যাহত রাখেন। তেভাগা আন্দোলনের প্রাণ পুরুষ পিতামহ নূর জালাল মোল্যার আদর্শ ধারণ করে স্কুল ও কলেজ জীবনেই ছুটে বেড়িয়েছেন গ্রাম থেকে গ্রামাঞ্চলে। যেখানে অন্যায় সেখানেই প্রতিবাদ করেছেন। শিরদাঁড়া শক্ত রেখে স্পষ্ট বক্তব্য রেখেছেন। সত্য প্রকাশে তিনি ছিলেন আপোসহীন। বিভিন্ন প্রতিবাদ সমাবেশ, মিছিল, গণসংযোগে সামিল হয়ে নানান অসংগতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন, প্রতিবাদ করেছেন। ধনী-গরীব, উঁচু-নিচু, নারী-পুরুষ বৈষম্য দুরীকরণের আন্দোলনে সবসময় থেকেছেন সামনের সারিতে। যার রক্ত অস্থি মজ্জায় প্রতিবাদের ফোয়ারা, চূড়ান্ত শিখরে উঠার প্রবল উন্মাদনা। তাকে কি কেউ পারে পায়ে বেড়ি পরিয়ে আটকে রাখতে? ১৯৯৭ সালে এইচএসসি পাস করার পর ছুটে  এসেছেন পরিবার থেকে বাইরের জগতে। চলে এসেছিলেন যশোর শহরে। ডিগ্রি ভর্তি হয়েছিলেন যশোর সরকারি এম এম কলেজে। সেখান থেকে ডিগ্রি পাস করে পারিবারিক ঐতিহ্য অনুসারে আইন পেশায় যুক্ত হওয়ার জন্য ভর্তি হয়েছিলেন যশোর শহীদ মশিয়ুর রহমান আইন মহাবিদ্যালয়ে। সেখান থেকে এলএলবি পাস করলেন। তারপর যাত্রা শুরু করলেন আইন পেশায়। যশোর জজ কোর্টে শিক্ষানবীশ আইনজীবী হিসাবে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন।  তার খুব ইচ্ছা ছিলো বার কাউন্সিল পরীক্ষায় পাস করে বারের সম্মানিত সদস্য হবেন। দক্ষ আইনজীবী হয়ে সাধারণ মানুষের অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে পাশে দাঁড়াবেন। এই লক্ষ্যে তিনি দুই দুইবার বার কাউন্সিলের পরীক্ষা দিয়েছিলেন কিন্তু নিজের দুই বাচ্চাকে সামলাতে যেয়ে পেরে ওঠেন নি। কিন্তু মনে কঠিন প্রত্যয় ছিলো আগামীতে বার কাউন্সিল পরীক্ষায় পাস করে দক্ষ আইনজীবী হয়ে সমাজের কল্যাণে কাজ করে যাবেন। এই সংগ্রামী নারী জীবন সংগ্রামে উত্তীর্ণ হতে বিভিন্ন সময়ে নানা পেশার সাথে জড়িত হয়েছিলেন। করেছিলেন নানা ছোটখাটো প্রাইভেট চাকরি। কিন্তু যেখানেই দেখেছেন অন্যায়, অসঙ্গতি সেখানেই করেছেন প্রতিবাদ। ফলশ্রুতিতে চলে গেছে বেশ কয়েকটা চাকরি। তবু কোথাও অন্যায়ের কাছে মাথানত করেননি। যার মনে সাহিত্যের উন্মাদনা সে তো খুঁজে নেবেই সাহিত্য চর্চার পীঠভূমিকে। পড়ালেখা চলাকালীনই যুক্ত হয়ে যান যশোরের সাহিত্য সংগঠন বিদ্রোহী সাহিত্য পরিষদের সাথে। সাধারণ কর্মি থেকে তার কর্ম দক্ষতা দিয়ে একসময় হয়ে ওঠেন বিদ্রোহী সাহিত্য পরিষদের নেতৃস্থানীয়দের একজন। একসময় বিদ্রোহী সাহিত্য পরিষদের সাথে কবি নূরজাহান আরা নীতি মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। তখন বিদ্রোহী সাহিত্য পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা ও সাধারণ সম্পাদক কবি গোলাম মোস্তফা মুন্নার সাথে পরিচয় ও পরবর্তীতে জড়িয়ে পড়েন গভীর সম্পর্কে। সম্পর্ক থেকে প্রেম। প্রেম থেকে পরিণয়। ২০০৭ সালের ১১ মে তারা বিবাহ বন্ধনে আবাদ্ধ হন। গোলাম মোস্তফার মুন্না একাধারে কবি, গবেষক, সাংবাদিক এবং দক্ষ সাংস্কৃতিক সংগঠক। তার গ্রামের বাড়ি যশোর জেলার মণিরামপুর উপজেলার কপালিয়া গ্রামে। তাদের দাম্পত্য জীবন ছিল সুখে দুঃখে গড়া এক নন্দনকানন। একে একে তাদের ঘরে আসে দুই পুত্র সন্তান সাক্ষর এবং অক্ষর। বর্তমান জ্যেষ্ঠ পুত্র স্বাক্ষর এবারের এস.এস.সি পরীক্ষার্থী এবং কনিষ্ঠ পুত্র অক্ষর পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র। এতিহ্যবাহী বাম ঘরনার পরিবেশে জন্মগ্রহনকারী কবি নূরজাহান আরা নীতি ছিলেন যেমন প্রগতিশীল, উদারমনা তেমনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক মানসিকতার একজন মানুষ। তার কাছে জাত পাত ধর্ম বলে কোনো বিভেদ ছিলো না। ধর্মের চাইতে শ্রেণী বৈষম্য তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তিন সবসময় ধনী ও গরীব ব্যবধান খুঁজতেন। শোষক ও শোষিতের শ্রেণী বৈষম্য দূর করতে সোচ্চার হতেন। আমার দেখামতে তিনি ছিলেন একজন অত্যন্ত মেধাবী, দক্ষ এবং সাহসী, স্পষ্টবাদী নারী। তার কাছে না বলে কোনো জিনিস ছিলো না। যে কোনো কাজ হতেই হবে এই মানসিকতা নিয়ে তিনি দৌড়াতেন। তিনি কি ছিলেন না! তিনি একাধারে ছিলেন একজন কবি, আবৃত্তি শিল্পিী, পরোপকারী সমাজ সেবক, সাংবাদিক, আইনজীবী, দক্ষ সংগঠক, পতিব্রতা স্ত্রী, মমতাময়ী মা সর্বোপরি একজন আদর্শ গৃহিনী। তিনি জীবনে করেননি এমন কাজ খুব কম আছে। তিনি চাকরি করেছেন বিভিন্ন সমাজ সেবা সংস্থায় ও এতিমখানায়। এতিমদের খাবার, অর্থ আত্মসাতের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে চাকরি ছেড়েছেন। ২০০৬ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত সাপ্তাহিক প্রাত্যহিকী পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেছেন। তুলে এনেছেন ধনিক বা শোষক শ্রেণীর বিভিন্ন অপকর্ম। সমাজের বহু অসংগতি দূর করার সংগ্রামে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। বন্যার্তদের বা অসুস্থ মানুষের সাহায্যের জন্য সামনের কাতারে থেকে মাইকিং করে অনুদান সংগ্রহ করেছেন। সাহিত্য সাংস্কুতিক আন্দোলনের এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে তিনি অগ্রণী ভূমিকায় থাকেন নি। এই বহুধা প্রতিভার অধিকারী মহিয়সী কবি এমনই মেধাবী ছিলেন যে, কোনো অনুষ্ঠানে শীট দেখে কবিতা পড়েননি। তিনি তার স্বরচিত কবিতা বা যে কোনো কবির কবিতা পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠার অনর্গল মুখস্থ আবৃত্তি করতেন। তার বাচনভঙ্গি ছিলো এতই চমৎকার যে তার কথাই কবিতা হয়ে যেতো। তিনি অত্যন্ত চমৎকার আবৃত্তি করতেন, চমৎকার করে অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করতেন। কয়েকটি সামাজিক নাটকেরও পার্শ্বচরিত্রে দক্ষতার সাথে অভিনয় করেছেন। তিনি একজন পরোপকারী নারী ছিলেন। কবি, সাহিত্যক, বন্ধু, বান্ধব বা তাদের ছেলেমেয়ে যেখানে যার বিপদের কথা শুনেছেন দৌড়ে গেছেন সাহায্যের হাত নিয়ে। ছুটেছেন সাধ্যমতো। তার সাহসী ও স্পষ্টবাদীতায় যেকোনো কঠিন কাজও সহজে হয়ে গেছে । অতিমাত্রায় আত্মবিশ্বাসী এই মহিয়সী নারী কখনো পরাজয় স্বীকার করতে শেখেননি। যেখানে গেছে সেখানেই তিনি জিতে এসেছেন। পৃথিবী নামক রঙ্গমঞ্চে যেখানে যে অভিনয় করার দরকার তিনি সেখানে সেই অভিনয় দ্বিধাহীন চিত্তে সার্থকভাবে করে গেছেন। সন্তান হিসেবে পিতামাতার কাছে তিনি ছিলেন সার্থক আত্মজা। পরিবারের জ্যেষ্ঠ সন্তান হিসেবে পিতামাতার কাছে যেমন ছিলেন নির্ভরতার প্রতীক তেমনি ভাই-বোনের কাছে তিনি ছিলেন মাতৃতুল্য। পিতা-মাতার, ভাইবোনের যে কোনো প্রয়োজনে, যে কোনো দুঃসময়ে তিনি এগিয়ে এসেছেন। সফলতার সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন। স্ত্রী হিসেবে স্বামীর কাছে ছিলেন আদর্শ প্রিয়তমা সহধর্মিণী। তিনি তার স্বামী গেলাম মোস্তফা মুন্নাকে সবসময় হ্রদয়তন্ত্রী দিয়ে বেঁধে রেখেছিলেন। তার সুবিধা অসুবিধায় একান্ত সঙ্গী হিসেবে পাশে থেকেছিলেন। ছায়াসঙ্গী হয়ে প্রতিটি কাজে সহযোগিতা করে গেছেন। যখন মিথ্যা অভিযোগে তার স্বামীকে সেনাবাহিনী তুলে নিয়ে গিছিলো তখন অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে তিনি একা সবকিছু মোকাবেলা করে ম্বামীকে উদ্ধার করে এনেছিলেন। আবার যখন তার স্বামীর হার্টের সমস্যা ধরা পড়ে একাই দৌড়াদৌড়ি করে খুলনার থেকে নামকরা ডাক্তার দ্বারা রিং পরিয়েছিলেন। তাকে সুস্থ্য করে তুলতে বারবার ঢাকা খুলনায় নিয়ে গেছেন। কোমল পরশ দিয়ে তার ব্যথিত হৃদয়কে শান্ত করেছেন। তার স্বামীকে তিনি ডাকতেন স্বাক্ষরের আব্বু বলে। আবার কখনো কখনো ভালোবেসে নাম ধরে ডাকতেন আমার মুন্না বলে। আমরা কতবার তাকে সকলের সামনে বলতে শুনেছি, আমার স্বাক্ষরের আব্বু খুব ভালো। আবার তার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছে আমার মুন্না আমাকে খুব ভালোবাসে। এতে তার স্বামী মুন্না যেমন ইতস্তত হতো তেমনি আমরাও লজ্জিত হতাম। কিন্তু তিনি ছিলেন দ্বিধাহীন। যেন কত সহজ সাবলীলতায় সত্য উচ্চারণ করছেন। ভালোবাসাকে কাছে টেনে নিচ্ছেন। এমন অনেক ছোট ছোট ঘটনা এখন তার স্বামী-পুত্রকে যেমন কাঁদাচ্ছে তেমন আমাদের স্মৃতির পাতাকেও ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করছে। মা হিসেবে সন্তানের কাছে তিনি ছিলেন গর্বিত জননী। অক্ষর এবং স্বাক্ষরকে মানুষের মতো মানুষ করতে ছুটে বেড়িয়েছেন এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। কখনো স্কুলে, কখনো কোচিংয়ে, কখনো ক্রিকেট মাঠে। ছেলেকে সফল ক্রিকেটার বানানোর উদ্দেশ্যে কত বিকেল পার করেছে রাজ্জাক কলেজের ক্রিকেট কোচিংয়ে। কখনো কোনা অভাব তাদের বুঝতে দেয়নি। মায়ের আঁচলের তলে স্বযত্নে আগলে রেখেছিলেন দুই সন্তান স্বাক্ষর অক্ষরকে। স্বাক্ষরের অসুস্থতার সময় কি না করেছেন। এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে দৌড়িয়েছেন। অর্থ সংগ্রহ করেছেন চিকিৎসা করিয়েছেন। এখন অল্পবয়সে মাতৃহারা হয়ে স্বাক্ষর অক্ষর আকুল পাথারে ভাসছে। বিশেষ করে ছোট ছেলে অক্ষর যার বয়স মাত্র দশ বছর। যে মাকে ছাড়া পৃথিবীর আর কাউকে আপন ভাবতে শেখেনি সে এই বয়সে মাতৃহারা হতে হলো। মাকে হারিয়ে সে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। কর্মি হিসেবে সংগঠনের কাছে তিনি ছিলেন একনিষ্ঠ সহযোগী। বিদ্রোহী সাহিত্য পরিষদের জননী বলা চলে। বিদ্রোহী সাহিত্য পরিষদের সেই ৩৩ তম মাসিক সাহিত্য সভায় তিনি নতুন সদস্য হিসেবে যুক্ত হয়ে পথ চলা শুরু করেন। সেই থেকে ২৫২ তম মাসিক সাহিত্য সভা পর্যন্ত অর্থাৎ প্রায় আঠারোটি বছর বিদ্রোহী সাহিত্য পরিষদের সাথে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ছিলেন। দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেছেন বিদ্রোহী সাহিত্য পরিষদের সহসভাপতিসহ বিভিন্ন পদে। কখনো মাইক্রোফোন হাতে উপাস্থাপনা করেছেন, কখনো আবৃত্তি করেছেন, কখনো অতিথি আপ্যায়ন করেছেন, কখনো ব্যানার হাতে র‌্যালি, সভা, মিছিল করেছেন। বিদ্রোহী সাহিত্য পরিষদের ইফতারী প্রথা চালু হওয়ার পর থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নিজের বাসা থেকে মায়ের মমতা দিয়ে নিজ হাতে প্রায় একশ কবি সাহিত্যিকের জন্য ইফতারী বানিয়েছেন।  বিদ্রোহী সাহিত্য পরিষদের বিভিন্ন সংকটকালীন সময়ের দাতব্যের হাত নিয়ে এগিয়ে এসেছেন তিনি। প্রথমে বিদ্রোহী সাহিত্য পরিষদের মাসিক সভা হতো কারুকাজে। সেখানে কবি সাহিত্যিকদের স্থান সংকুলান না হওয়ায় তারই উদ্দীপনায় ভাড়া সাপেক্ষে যশোর ইন্সিটিটিউটের নাট্যকলা সংসদে স্থানান্তরিত করা হয়। সেই ভাড়াটা তিনি সিংহভাগ বহন করতেন। এর পর কবিসাহিত্যিকের উপস্থিতি বেড়ে গেলে সেখান থেকে বেশি ভাড়ায় যশোর প্রেসক্লাবে স্থানান্তর করা হয়। সেখানেও দীর্ঘদিন সিংহভাগ ভাড়া তিনি বহন করেছেন। সংসারের শত অভাব অনটনের মধ্যেও সংগঠনের কল্যানে ব্যয় করতে কখনো দ্বীধাবোধ করেননি। এক কথায় তিনি সংগঠনের জুতো সেলাই থেকে চন্ডি পাঠ সব কাজে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। সংগঠনের প্রতিটি কাযর্ক্রমে তিনি আগে থেকেছেন। সংগঠনে তার কার্যক্রম দেখে মনে হতো এই সংগঠন তার কাছে সন্তানসম। তিনি এই সংগঠনের মা। এতো আপন করে নিয়েছিলেন বিদ্রোহী সাহিত্য পরিষদকে সংগঠনের সাথে তার মা সন্তান সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। কবি নূরজাহান আরা নীতিকে হারিয়ে বিদ্রোহী সাহিত্য পরিষদ মাতৃহারা হয়েছে। মা হারানোর বেদনায় রক্তক্ষরণ হচ্ছে বিদ্রোহী সাহিত্য পরিষদের প্রতিটি সদস্যের হৃদয়ে। এ ক্ষতি বিদ্রোহী সাহিত্য পরিষদের কখনো পূরণ হওয়ার নয়। শব্দ শ্রমিক হিসেবে সাহিত্যাঙ্গনে তিনি ছিলেন একনিষ্ঠ কর্মি। তার লেখনী ছিলো যেমন প্রতিবাদের ঝংকর বিদ্রোহীর প্যাকেজ তেমনি ভালোবাসায় সুবাসিত গোলাপের স্পন্দন। তিনি কখনো কবিতা দেখে দেখে পড়েননি। আমি এই কবি নূরজাহান আরা নীতির কবিতা পড়ার সময় হাতে কোনদিন চিরকুট দেখিনি। যা কিছু সব তার মনের চিরকুটেই লেখা থাকতো। অনর্গল মুখস্ত বলে যেতেন পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা কবিতা। তার কথাই যেন কবিতা হয়ে উঠতো। সর্বশেষ সংসারী হিসেবে তিনি পরিবারের কাছে ছিলেন একজন সফল গৃহিনী, বিকল্পহীন শ্রমিক। পরিবার তার কাছে ছিলো প্রাণ। সংসারকে টেনে তোলার জন্য. স্বামী সন্তানদের একটু ভালো রাখার জন্য তিনি কি না করেছেন। সংসারের কোনো দিকে স্বামীকে মাথা ঘামাতে দেননি। জমিজমার মামলা মকদ্দমা থেকে শুরু করে জমিজমা রক্ষা, শ্বশুর বাড়ি বা শহরের বাসা দেখাশোনা করা, স্বামী সন্তান শাশুড়ীদের চাহিদা পুরণ করা সব একা হাতে সামলিয়েছেন। একা বুদ্ধি করে জমি বন্ধকী নিয়েছেন। সেখানে নিজ হাতে ধান চাষ করেছেন । নিজে কেটে মাড়াই করেছেন। যাতে সংসারে দুটো পয়সা থাকে। সর্বশেষ তার একটা খুব ইচ্ছা ছিল প্যারিস রোডে একটা দোকান নিয়ে ছিটে রুটি আর হাঁসের মাংসের দোকান দেবেন। আমাকে মাঝে মাঝে বলতো,  দাদা যদি দোকানটা দিতে পারি প্রতিদিন কম করে হলেও পাঁচশ টাকা যদি থাকে তাহলে মাসে পনেরো হাজার টাকা। তাতে স্বাক্ষর অক্ষরের পড়ালেখার খরচ চলে সংসারটাও ভালোভাবে চলে যাবে। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার হয়তো ইচ্ছা ছিল না, তাই তার সে আশা আর পূরণ হলো না। তার আগেই চলে যেতে হলো পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে। এই কবির অজস্র স্বপ্নের মাঝে প্রতিবন্ধক হয়ে উঠেছিলো একমাত্র কাশিই। এই কাশিই তার জীবনে কাল্ হয়ে দাঁড়ালো। প্রথমে করোনা হলো, তারপর নিউমোনিয়া, তারপর যক্ষা। একের পর এক মরণঘাতী রোগ তার শরীরে বাসা বাঁধতে থাকলো। ফুসফুসে তৈরি হতে থাকলো নীরব ক্ষত। প্রাথমিক অবস্থায় কোনো ডাক্তারই তার রোগ ধরতে পারিনি। প্রচন্ড কাশি নিয়ে বারবার ভর্তি হয়েছেন হাসপাতালে। স্বামী গোলাম মোস্তফা মুন্না;র হাত ধরে  ঘুরেছেন এ হাসপাতাল থেকে ও হাসপাতালে। এক পর্যায়ে ধরা পড়ে রক্তে যক্ষার জীবাণু। টিবি ক্লিনিকে চিকিৎসা নিয়ে ডাক্তারদের আশ্বস্থতায় বেশ কিছুদিন সুস্থ ছিলেন। কিন্তু ভিতরে ভিতরে মরণঘাতী ব্যাধি তাকে নিঃশেষ করে ফেলছিলো। ফুসফুসটাকে অকেজো করে ফেলছিলো। সেটা তিনি টের পাননি। হঠাৎ করে একদিন অসুস্থ হয়ে পড়লেন। চোখ মুখ শরীর ফুলে গেলো। সেই অবস্থায় ত্রিশে আগষ্ট শনিবার করলেন জীবনের শেষ অনুষ্ঠান। বিদ্রোহী সাহিত্য পরিষদের সেই তার শেষ যাওয়া। সেদিন ছিলো বিদ্রোহী সাহিত্য পরিষদের কৃতি শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠান। সেই অনুষ্ঠানে তিনি বিদ্রোহী সাহিত্য পরিষদের ইতিহাস নিয়ে চার পাতার এক প্রবন্ধ উপস্থাপন করলেন। সেদিন তার গলায় যেন মারণশক্তি। এতো অসুস্থতার মধ্যেও তার উপস্থাপনা শেষ করলেন। সেখান থেকে বাসায় ফিরে অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তখনো কবির মনে ছিলো প্রচন্ড শক্তি। আমার কিছু হবে না। আমি সুস্থ হয়ে উঠব। কিন্তু যখন আর পেরে উঠলেন না ভর্তি করা হলো যশোর সদর হাসপাতালে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য তার পাশে থাকার মতো কোনো মহিলাকে সেদিন পাওয়া গেলো না। যেহেতু সেটা মহিলা ওয়ার্ড সেখানে পুরুষ কাউকে থাকা এলাউ ছিলো না। আমরা রাত এগারোটা পর্যন্ত কবির পাশে থেকে সবাই বাসায় ফিরলাম। সেই রাতেই অর্থাৎ ২ সেপ্টেম্বর সোমবার ভোররাতে এই মহিয়সী কবি অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। দুঃখজনক হলো পরিস্থিতির কারণে কবি মৃত্যুর সময়ে আপনজনদের কাউকে পাশে পেলেন না। একবুক অভিমান নিয়ে চলে গেলেন এমন এক দেশে সেখান থেকে কেউ আর কখনো ফিরে আসে না। মাত্র ৪৭ বছর বয়সে এই মহিয়সী নারীর জীবনা প্রদীপ নিভে গেলো। নগর জুড়ে নেমে এলো বিষন্নতার হাহাকার। স্বামী হারালো তার আদর্শ পত্নিকে। দুই নাবালক সন্তান এতিম হলো আকষ্মিক মাকে হারিয়ে। যশোরের সাহিত্যাঙ্গন হারালো এক প্রতিবাদী কন্ঠ শ্রুতিধর কবিকে। তার এ চলে যাওয়ায় তার পরিবারসহ যশোর সাহিত্য পরিমন্ডলে যে অপূরনীয় ক্ষতি হয়েছে তা পূনরায় কখনো পুরণ হওয়া সম্ভব নয়। তবু বিধির বিধান মেনে নিয়ে আমাদের চলতে হবে সামনের দিকে। জীবনতো কচুর পাতার উপর পড়ে থাক একটুকরা শিশির বিন্দু। কার, কখন কিভাবে টুপ করে পড়ে যাবে কেউ জানে না। এখন তার জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে শুধু প্রার্থণা আনন্দলোকে, মঙ্গলালোকে সে যেন ভালো থাকে। হে আল্লাহ তুমি তাকে জান্নাতের ফুলবাগানে স্থান দিও। সে যেন চিরশান্তিতে সেখানে ঘুমাতে পারে সেই ব্যবস্থা তুমি কোরো। তুমি তাকে বেহেস্ত নসীব করো। পৃথিবীতে তিনি যেসব ভালো কাজ করেছেন তার প্রতিদান তুমি দিও।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *