ডাঃ নিজাম (মেলবোর্ন): ওলামাদের মধ্যে মতভেদ ও মতপার্থক্য চিরকাল ছিল এবং থাকবে। অনেক সময় এই মতবিরোধ উম্মতের জন্য কল্যাণকরও হতে পারে। তবে আমাদের সবার জন্য সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলো মানবীয় গুণাবলী বা ইনসানিয়াতের বৈশিষ্ট্য জীবিত রাখা। যদি মানুষের ভেতর থেকে এই ইনসানিয়াত বিলীন হয়ে যায়, তবে মানুষের মাঝে পশু ও শয়তানের বিভিন্ন নিকৃষ্ট স্বভাব প্রবেশ করতে শুরু করে।
প্রথমতঃ কুকুরের স্বভাব
যেমন একটি কুকুর যদি একটি মৃত পশু খেতে থাকে, তখন আরেকটি কুকুর দূর থেকে আসলে সে ঘেউ ঘেউ করে তাকে তাড়িয়ে দেয়। অর্থাৎ শেয়ার করার বা ইকরামের কোনো গুণ থাকে না। সে শুধু নিজের স্বার্থকেই আঁকড়ে ধরে। মানবীয় গুণ হারালে মানুষের মধ্যেও এই স্বভাব প্রকাশ পায়—সে শুধু নিজের জন্য বাঁচে, অন্যকে কিছু দিতে চায় না।
দ্বিতীয়তঃ সাপের স্বভাব
সাপের বৈশিষ্ট্য হলো—যে-ই তার আশেপাশ দিয়ে যাক, সে ছোবল মারে। অথচ এতে সাপের কোনো উপকার হয় না, কিন্তু অন্যের জীবন বিনষ্ট হয়ে যায়। সমাজে এমন মানুষও কম নেই যারা নিজের কোনো লাভ ছাড়াই অন্যকে কষ্ট দেয়—এটাই সাপের স্বভাব মানুষের মাঝে প্রকাশ পাওয়া।
তৃতীয়তঃ শূকরের স্বভাব
শূকরকে যদি সবচেয়ে সুন্দর পরিবেশেও রাখা হয়, সুগন্ধিময় বাগানে ছেড়ে দেওয়া হয়, তবুও সে দুর্গন্ধের খোঁজ করে। অর্থাৎ সুন্দর ও পবিত্র জিনিসের কোনো মর্যাদা দেয় না। মানবতা হারালে মানুষের ভেতরও এই স্বভাব তৈরি হয়—যেখানে সৌন্দর্য ও কল্যাণ আছে, সেখানে না গিয়ে কুৎসিত, হীন ও নোংরার দিকেই আকৃষ্ট হয়।
চতুর্থতঃ শয়তানের স্বভাব
শয়তান কখনো মানুষের মঙ্গল চায় না। সে চায় সামান্য ভালো কাজটুকুও মানুষ না করতে পারে। প্রসঙ্গত একটি ঘটনা—
একজন বুড়ো ওলীআল্লাহ বৃষ্টির দিনে কর্দমাক্ত পথে হেঁটে জামাতে নামাজ পড়তে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ পিছলে পড়ে গেলেন। তখন এক যুবক এসে বলল, “চাচা, এই অবস্থায় গেলে যদি পা ভেঙে যায় তবে অনেক দিন নামাজে যেতে পারবেন না। আজ বাসায় পড়ে নিন।” কিন্তু তিনি অটল থাকলেন—জামাতে নামাজ পড়তেই যাবেন। দ্বিতীয়বার আবার পড়ে গেলে যুবক আরও জোর দিল, কিন্তু বৃদ্ধ অনড়। শেষ পর্যন্ত যুবক কাঁধে তুলে মসজিদে পৌঁছে দিল। মসজিদের বারান্দায় নামিয়ে বৃদ্ধ বললেন, “বাবা, তুমি-ও ভেতরে এসে নামাজ পড়ো।” তখন যুবক উত্তর দিল, “আমি তো নামাজ পড়ি না, কারণ আমি শয়তান।”
বৃদ্ধ অবাক হলে সে ব্যাখ্যা দিল, “আপনি প্রথমবার পড়ে গিয়ে আবার রওনা হলে আল্লাহ আপনার গুনাহ মাফ করেছেন। দ্বিতীয়বার পড়ে আবার রওনা হলে আল্লাহ আপনার পরিবারের সকলের গুনাহ মাফ করেছেন। আমি ভয় পাচ্ছিলাম তৃতীয়বার পড়লে হয়তো পুরো এলাকাবাসীর গুনাহ মাফ হয়ে যাবে! তাই আমি নিজেই আপনাকে মসজিদে পৌঁছে দিলাম।”
এটাই শয়তানের স্বভাব—মানুষ যেন কোনো ভালো কাজ করতে না পারে, সেজন্য সে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে।
পঞ্চমতঃ শয়তানের চেয়েও নিকৃষ্ট স্বভাব
শয়তান আল্লাহর সমস্ত ব্যবস্থা দেখে, জেনে, শুনেও কখনো নিজেকে ‘খোদা’ দাবি করার সাহস করেনি। অথচ মানবতা হারালে মানুষ কখনো কখনো ফেরাউন ও নমরূদের মতো নিজেকেই ‘খোদা’ বলে দাবি করতে পিছপা হয় না। এটাই মানবতা লোপ পাওয়ার সবচেয়ে ভয়াবহ স্তর।
তাই আসল শিক্ষা হলো—মতভেদ থাকতে পারে, কিন্তু মানবীয় গুণাবলী হারানো চলবে না। ইনসানিয়াতই মানুষের প্রকৃত পরিচয়, আর তা হারালে মানুষ পশু ও শয়তানের স্তরে নেমে যায়