ভয়ংকর এক দুষ্টচক্রের কবলে দেশের স্বাস্থ্যখাত 

আবুল কালাম আজাদ (যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী কলামিষ্ট): বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা ও স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা, দায়ীত্বহীনতা, অবহেলা-উদাসীনতা নিয়ে লিখলে দিনরাত্রি পার হয়ে যাবে তবুও লেখা শেষ হবেনা। এ যেন লাগামহীন ঘোড়ার ন্যায় লক্ষ্যহীন গন্তব্যে ছুটে চলেছে আমাদের দেশের স্বাস্থ্য খাত। দেশের স্বাস্থ্য খাতে দায়িত্বশীলরা যে কতটা উদাসীন ও দায়িত্বহীন তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ভুয়া ডাক্তার মুনিয়া খান রোজা, পাপিয়া আক্তার স্বর্না, রিপা আক্তার ও ডালিয়া আক্তার নামে ভুয়া নারী চিকিৎসকগণ।
শুধুমাত্র ২০২৩, ২০২৪ ও ২০২৫ সালের মধ্যে উক্ত চার ভুয়া চিকিৎসকের সন্ধান মেলে ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালের মত গুরুত্বপূর্ন জায়গায়। ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালের বাইরে রাজধানী সহ সারাদেশে কত হাজার ছদ্মবেশী ভুয়া চিকিৎসক আছে তার কোনো হিসাব নাই।
এরা ডাক্তারের অবয়বে স্টেথোস্কোপ, অ্যাপ্রোন ও বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের আইডি কার্ড ব্যবহার করে হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ড এমনকি আইসিউতে পর্যন্ত প্রবেশ করে। এই ঘটনা দুয়েকদিনের জন্য নয়, মাসের পর মাস ধরে চলে আসছিল। ভুয়া ওই নারী চিকিৎসকেরা রুগীদের প্রেসক্রিপশন পর্যন্ত লিখতেন। কতটা ভয়ংকর ও অনিরাপদ দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা ভাবা যায়?
স্বীকৃত পোষ্ট গ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রী না থাকা সত্ত্বেও চিকিৎসকদের কেউ কেউ নিজেকে ‘বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক’ হিসেবে পরিচয় দিয়ে যাচ্ছেন যা বিএমডিসি আইনের পরিপন্থী এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সাইনবোর্ড, প্রেসক্রিপশন প্যাড, ভিজিটিং কার্ড ইত্যাদিতে ‘বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক’ লেখা দেখে চিকিৎসা করাতে গিয়ে প্রত্যাশিত চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন রোগীরা। শুধু তাই নয়, আইন অমান্য করে কোন কোন চিকিৎসক তাদের ব্যবস্থাপত্রে এমন কিছু ওষুধ লিখছেন, যা সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ।
ন্যূনতম এমবিবিএস অথবা বিডিএস ডিগ্রীপ্রাপ্ত না হয়েও অনেকে তাদের নামের পূর্বে ডাক্তার পদবি ব্যবহার করে যাচ্ছেন। দেশের সর্বত্র চলছে বিএমডিসির দেয়া এমন সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি অমান্য করার প্রতিযোগিতা। এতে একদিতে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা হয়ে পড়ছে প্রশ্নবিদ্ধ, অন্যদিকে ভুল চিকিৎসার শিকার হয়ে রোগীরা অকালে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন অনেক রোগী। রোগী ও তাদের স্বজনরা পড়ছেন আর্থিক ক্ষতিতে।
আবার স্বীকৃত মেডিকেল কলেজ থেকে ডাক্তার হয়েও অনেকে ভুয়া ডিগ্রী ব্যবহার করে থাকেন। নামের আগে ভুয়া ডিগ্রী লাগিয়ে রোগীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করাই এ ধরনের চিকিৎসকদের মূল উদ্দেশ্য। রোগীদের ভাল-মন্দ বিবেচনায় রাখেন না তাঁরা। মহান পেশা চিকিৎসাসেবা তাদের কাছে হয়ে ওঠে ‘রোগী মেরে টাকা উপার্জনের সেন্টার’। স্বীকৃত চিকিৎসকদের পাশাপাশি অস্বীকৃত কোয়াক চিকিৎসকদের সংখ্যাও কম নয়। তারা চিকিৎসা সেক্টরের জন্য বেশ হুমকিস্বরূপ।
দেশে রয়েছে প্রায় আড়াই লাখ ‘কোয়াক চিকিৎসক’। এ ধরনের চিকিৎসকদের থাকে না কোন প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রী ও অভিজ্ঞতা। কোন চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান বা অভিজ্ঞ ব্যক্তির সংস্পর্শে এসে তারা কিছু চিকিৎসা জ্ঞান অর্জন করে। সেই সীমিত জ্ঞান দিয়ে তারা নিজেদের মতো করে চিকিৎসাসেবা দিয়ে যায়। এতে অনেক রোগী ভুল চিকিৎসার শিকার হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। সরকারী অনুমোদন না থাকলেও এ ধরনের চিকিৎসকরা দেশের আনাচে কানাচে চিকিৎসা-বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন। স্বাস্থ্যখাতে এই দুর্নীতিকে কেউ জবাবদিহির আওতায় আনে না, তদন্ত হয় না, শাস্তি হয় না। ফলে এই প্রাতিষ্ঠানিক অব্যবস্থা ও দণ্ডমুক্তির সংস্কৃতি ক্রমেই স্থায়ী রূপ নিচ্ছে।
এ তো গেল ভুয়া চিকিৎসকদের কথা। এবার আসি বিশেষজ্ঞ ও রেজিস্টার্ড ডাক্তারদের প্রসঙ্গে –
দরিদ্রপীড়িত বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ২৫% মানুষ দরিদ্র সীমার নীচে বাস করে। আর মোট জনসংখ্যার প্রায় ৭০% মানুষ বাস করে গ্রামে। অপরদিকে দেশের প্রতি ১,৮৪৭ জন মানুষের জন্য (২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারী মাস পর্যন্ত) একজন রেজিস্টার্ড চিকিৎসক আছেন, যেখানে সরকারি ও বেসরকারি সকল চিকিৎসককে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশকৃত অনুপাত অনুযায়ী এই সংখ্যাটি বেশ কম।
উপরের জরিপটি বিবেচনা করলে বাংলাদেশের মানুষের স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্যতা সহজেই অনুমান করা যায়। চিকিৎসা সুবিধা বঞ্চিত হতভাগ্য মানুষগুলো যখন তাদের সেবার প্রয়োজনে কোনো অভিজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন তখনও হয়রানির সীমা থাকেনা। সরকারি হাসপাতালগুলোতে দালালদের দৌরাত্ম্য, কমিশন বানিজ্য, নিম্মমানের চিকিৎসা সামগ্রী সহ পদেপদে হয়রানির শিকার হন সেবাপ্রার্থীরা। অন্যদিকে প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের আকাশ ছোয়া পরামর্শ ফি, টেস্ট বানিজ্য তো আছেই।
কিছু সংখ্যক রেজিস্টার্ড চিকিৎসক কর্মস্থলের চেয়ে নিজস্ব ক্লিনিক ও চেম্বারেই রোগী দেখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। কোনো কোনো ডাক্তারের আবার কমিশন এজেন্ট/দালালও রয়েছে, এরাই হাসপাতাল থেকে রোগীদের ভাগিয়ে ডাক্তারের নিজস্ব ক্লিনিকে নিয়ে যায়। সর্বপরি দেশের আপামরজনসাধারণের জন্য স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তি যেন সোনার হরিণ।
এবার আসি নকল ও ভেজাল ওসুধ প্রসঙ্গে –
বছরের পর বছর ধরে ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া ও পত্রিকাগুলো নকল, ভেজাল ও ক্ষতিকর ওষুধ সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তসহ হরেক রকম প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। দিন দিন যেন নকল, ভেজাল ও ক্ষতিকর ওষুধের দৌরাত্ম্য বেড়েই চলেছে, আর তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে মানুষের স্বাস্থ্য ও জীবনের নিরাপত্তাহীনতা। একটি ব্যাপার লক্ষ্যণীয়। অনেক ক্ষেত্রে নকল, ভেজাল ওষুধ ধরা পড়ছে, দুর্নীতিবাজ ও দুষ্কৃতকারীরাও আটক হচ্ছে। ১৯৪০ সালের ড্রাগ অ্যাক্টের আওতায় নগণ্য শাস্তিও দেওয়া হচ্ছে। অপরাধের তুলনায় শাস্তির মাত্রা এতই কম, তাতে অপরাধ ও অপরাধীর ওপর তেমন কোনো প্রভাব পড়ছে না।
নকল, ভেজাল ও ক্ষতিকর ওষুধ উৎপাদন ও বিক্রি করার মাধ্যমে মানুষ হত্যার শাস্তি এক বা দুই লাখ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে এক, দুই বা তিন মাস জেল গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এসব ক্ষেত্রে আইন-কানুন পরিবর্তন করে আরও কঠোর শাস্তির বিধান চালু করতে হবে, যাতে করে আর কেউ কোনো সময় নকল, ভেজাল ওষুধ উৎপাদন ও বাজারজাত করার সাহস না পায়।
সব মিলিয়ে আমাদের স্বাস্থ্য খাত আজ ভয়ংকর এক দুষ্টচক্রের কবলে পড়েছে। এখানে মানবিকতার জায়গা দখল করে নিয়েছে টাকা আর মুনাফার নেশা। দালাল চক্র, ভুয়া ক্লিনিক আর অ্যাম্বুলেন্স সিন্ডিকেট এতটাই শক্তিশালী হয়ে উঠেছে যে, তারা প্রতিদিন হাজারো সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে রাখছে। যদি এখনই এই দালাল ও সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য বন্ধ না করা যায়, তাহলে স্বাস্থ্যসেবা আর মৌলিক অধিকার থাকবে না—বরং ধনী মানুষের জন্য একটি বিলাসবস্তু হয়ে দাঁড়াবে। গরিব মানুষ তখন হাসপাতালের দরজা পর্যন্ত পৌঁছালেও চিকিৎসা পাবে না, শুধু প্রতারণা আর হয়রানির শিকার হবে।
অন্যদিকে, এত সর্বস্ব উজাড় করে বিপুল অর্থের বিনিময়ে প্রাপ্ত সেই চিকিৎসার মানের কোনো নিশ্চয়তা নেই। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এসব ক্লিনিকের নেই আধুনিক যন্ত্রপাতি, নেই যথাযথ দক্ষ চিকিৎসক। কিন্তু একবার দালাল সিন্ডিকেটের কবলে পড়লে আর রক্ষা নেই।
বিভিন্ন দেশে চিকিৎসায় অবহেলার প্রতিকার –
পার্শবর্তী দেশ ভারতে চারভাবে চিকিৎসায় অবহেলার প্রতিকার নিশ্চিত করা হয়েছে।
ফৌজদারি দায়বদ্ধতার অধীনে অবহেলা, দেওয়ানি দায়বদ্ধতার অধীনে অবহেলা, শাস্তিমূলক ব্যবস্থা এবং ভোক্তা সুরক্ষা আইনের অধীনে অবহেলা।
ভারতের ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধি অনুযায়ী, অবহেলাজনিত কারণে রোগীর মৃত্যু হলে দুই বছরের কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
একইসাথে আর্থিক ক্ষতিপূরণের জন্য যথাযথ সিভিল কোর্টে যাওয়ার বিধান রয়েছে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনের বিভিন্ন ধারায় ভুক্তভোগীকে এক কোটি থেকে দশ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ প্রদানের বিধান রয়েছে।
বাংলাদেশের মতোই ভারতে “ইন্ডিয়ান মেডিকেল কাউন্সিল” রয়েছে যারা চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়। চিকিৎসকদের লাইসেন্স স্থগিত বা বাতিল করতে পারে এই প্রতিষ্ঠান।
থাইল্যান্ডের চিকিৎসায় অবহেলার প্রতিকার –
বাংলাদেশের জনগণের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ প্রতি বছর চিকিৎসার জন্য থাইল্যান্ডে যায়। সে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় দুইটি আইনের কথা বলা হয়েছে।
থাইল্যান্ডের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট “দ্যা মেডিকেল কাউন্সিল অব থাইল্যান্ড” এ দুই আইনের কথা বলা হয়েছে।
চিকিৎসকরা কীভাবে প্রাকটিস করবে, রোগীদের সাথে কেমন ব্যবহার করবেন এবং চিকিৎসায় অবহেলার জন্য তদন্ত ও প্রমাণ সাপেক্ষে তাদের বিরুদ্ধে কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে তা বলা হয়েছে আইন দুইটিতে।
“দ্যা মেডিকেল কাউন্সিল রেগুলেশনস অন মেডিকেল এথিকস প্রিজারভেশন ২০০৬” এ চিকিৎসকরা কীভাবে প্র্যাকটিস করবেন, রোগীদের সাথে কেমন আচরণ করবেন, অন্য চিকিৎসক বা সহকারীদের সাথে কেমন আচরণ করবেন প্রভৃতি বিষয়ে বিস্তারিত বলা হয়েছে।
এই আইনের কয়েকটি অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, চিকিৎসকরা স্বাভাবিকের চাইতে অতিরিক্ত মজুরি নিতে পারবেন না।
নিজের সুবিধার জন্য চিকিৎসক রোগীদের কোনো চিকিৎসা নিতে প্ররোচিত করতে পারবেন না।
একজন চিকিৎসককে অনুরোধ করা হলে এবং তার সামর্থ্যের মধ্যে থাকলে গুরুতর অসুস্থ ব্যক্তিকে প্রত্যাখ্যান করতে পারবেন না।
“দ্যা মেডিকেল প্রফেশন অ্যাক্ট – ১৯৮২” এর মুখবন্ধে বলা হয়েছে, জনগণের সঠিক চিকিৎসা সেবা পেতে থাইল্যান্ডে চিকিৎসার প্র্যাকটিস আইন ও প্রবিধান দ্বারা চিহ্নিত করা হয়েছে।
এই আইনে বলা হয়েছে, চিকিৎসা নৈতিকতা না মেনে চিকিৎসা করায় কোনো চিকিৎসকের দ্বারা কেউ যদি ভুক্তভোগী হয় সেক্ষেত্রে ওই চিকিৎসকের বিরুদ্ধে মেডিকেল কাউন্সিলে অভিযোগ করার অধিকার যে কোনো ব্যক্তির রয়েছে।
তবে, ঘটনার এক বছরের মধ্যে এ ধরনের অভিযোগ দায়ের করতে বলা হয়েছে আইনে। অভিযোগের প্রেক্ষিতে ঘটনার তদন্তে কমিটি গঠন করা হবে।
এখন প্রশ্ন খুবই সোজা—এই দেশ কি সত্যিই সরকারের নিয়ন্ত্রণে চলছে, নাকি সিন্ডিকেটের হাতে জিম্মি হয়ে আছে? সময় এসেছে এই অমানিশার অন্ধকার ভেঙে দেওয়ার। সময় এসেছে দালাল চক্র ও সিন্ডিকেটকে আইনের আওতায় আনার। স্বাস্থ্যসেবা কোনো ব্যবসা নয়—এটি প্রতিটি মানুষের অধিকার। এই অধিকার নিশ্চিত করতে হলে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে, না হলে সাধারণ মানুষ চিরকাল এই অমানবিক সিন্ডিকেটের খপ্পরেই বন্দি হয়ে থাকবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *