বাংলাদেশে গণভোট আসন্ন?

ডঃ শফিকুর রহমান,  বিশেষ প্রতিনিধি: ডঃ ইউনুস কি গণভোটের পথে হাঁটছেন? বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে একটি পুরোনো কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন—আমরা কি এখন গণভোটের পথে হাঁটবো?

গত কয়েক বছরের রাজনৈতিক অস্থিরতা, প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন, বিরোধী দলের অংশগ্রহণহীনতা, এবং সাম্প্রতিক সময়ে সংস্কার, সব মিলিয়ে এখন একটি নতুন দাবি তুলেছেন বিশ্লেষক ও নাগরিক সমাজ—আমাদের প্রয়োজন সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বভিত্তিক (PR) নির্বাচন ব্যবস্থা এবং ঐকমত কমিশনের উদ্যোগে সংস্কারের বৈধতা, সেটি নির্ধারণে দরকার একটি গণভোট।

বর্তমান পদ্ধতিতে সমস্যা কোথায়?

আপনি জানেন নিশ্চয়ই, বাংলাদেশে আমরা এখন যে পদ্ধতিতে ভোট দেই—সেটা ‘প্রথমে আসলে যে প্রার্থী সবচেয়ে বেশি ভোট পান, তিনিই নির্বাচিত হন, এমনকি তিনি যদি অধিকাংশ ভোটারের ভোট নাও পান। ধরা যাক, ৭৪% ভোট কাস্ট হল। একজন প্রার্থী ২০% ভোট পেয়ে জয়ী হতে পারেন, যদি অন্য তিনজন প্রার্থী ১৭+১৮+১৯ ভোট পান। তাহলে ৫৪% ভোটারের ভোট অর্থহীন। এতে বড় একটি অংশের মতামত আসলে উপেক্ষিতই থেকে যায়।

অতীতের জাতীয় নির্বাচন গুলির দিকে তাকালে দেখতে পাই, অনেক আসনে প্রার্থীরা মোট ভোটের ২৫% – ৩০% পেয়েই জয়ী হয়েছেন। ফলে প্রশ্ন উঠেছে—এটা কি প্রকৃতপক্ষে গণতন্ত্র?

জামায়াত, এনসিপি সহ ৭টি দল পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন চাইছে।

সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (PR): কী এবং কেন?

PR পদ্ধতিতে ভোট দেওয়ার পর প্রতিটি দলের প্রাপ্ত মোট ভোট অনুযায়ী সংসদে তাদের আসন বরাদ্দ হয়। অর্থাৎ যদি কোনও দল মোট ভোটের ২৫% পায়, তাহলে তাদের সংসদেও ২৫% আসন থাকবে। এতে করে ছোট দলগুলোও সুযোগ পায়, এবং জনগণের মতামতের বাস্তব প্রতিফলন ঘটে।

ইউরোপের দেশগুলো—যেমন জার্মানি, সুইডেন, নেদারল্যান্ডস—বহু বছর ধরেই PR পদ্ধতি ব্যবহার করে। এমনকি আমাদের প্রতিবেশী শ্রীলঙ্কাও ১৯৭৮ সাল থেকে PR পদ্ধতি চালু করেছে, যার ফলে সেখানকার সংসদে বিভিন্ন মত ও দলের প্রতিনিধিত্ব বাড়ছে।

গণভোটের দাবি উঠলো কেন?

বিভিন্ন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও নাগরিক সংগঠন মনে করছেন, PR পদ্ধতিতে যাওয়ার আগে দরকার জনমত যাচাই। আর গণভোটই সে পথে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ও গণতান্ত্রিক মাধ্যম।

তাছাড়া, অনেক রাজনৈতিক দলই মনে করে, সংস্কার ছাড়া নির্বাচন হলে, যে দলটি ক্ষমতায় যাবে, সে সংস্কার প্রস্তাব বাতিল ও করে দিতে পারে।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর অন্যতম নেতা বদিউল আলম মজুমদার সম্প্রতি বলেছেন—

জনগণ কী চায়?  গণভোট সে প্রশ্নের উত্তর দিতেই পারে।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. তানভীর আহমেদও মত দিয়েছেন,

“গণতন্ত্রে জনগণের ইচ্ছা শীর্ষে। গণভোটের মাধ্যমে জনগণের ইচ্ছা প্রকাশ পেলে সেটা রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য একটি স্পষ্ট বার্তা হবে।”

তরুণদের কণ্ঠ আরও জোরালো

যারা নতুন প্রজন্ম—বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, তরুণ উদ্যোক্তা, সমাজকর্মী—তারা এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছে। অনেকেই বলছে, “আমার ভোট যেন বৃথা না যায়।” ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নিশাত ফারহানা বললেন—“আমরা প্রতিনিয়ত গণতন্ত্রের কথা শুনি, কিন্তু তা যদি সবার মতামতের প্রতিফলন না ঘটায়, তাহলে তো তা খালি কথাই রয়ে যায়।”

অনেকেই মনে করছেন, সংস্কার নিয়ে ঐকমত কমিশনের প্রস্তাবগুলির বৈধতা না দেয়া গেলে, তা  অনেকেই এই কমিশনের অশ্বডিম্ব প্রসব বলেই মনে করবেন।

আমরা কী শিখতে পারি অন্যান্য দেশ থেকে?

PR ব্যবস্থার ভালো দৃষ্টান্ত হলো জার্মানি। সেখানে নাগরিকরা জানেন, তাদের ভোট কখনোই ‘বর্জ্য’ হয় না। বড় দল যেমন সুযোগ পায়, ছোট দলও পায় তাদের অবস্থান। এমনই এক ভারসাম্য মূলক ব্যবস্থা আমাদের এখানেও দরকার।

এছাড়া, নিউজিল্যান্ড ১৯৯৩ সালে গণভোটের মাধ্যমে FPTP থেকে PR ব্যবস্থায় চলে যায়। তারা আগে জনগণের মত জানলো, তারপর পরিবর্তন করলো। বাংলাদেশেও সেই পথ অনুসরণ করা যেতে পারে।

পিআর ও সংস্কারের বৈধতা নিয়ে আন্দোলন শুরুঃ

জামায়ত, ইসলামী আন্দোলন সহ সাতটি দল এই দুটি সহ পাঁচটি দাবীতে দেশব্যাপী আন্দোলনের ডাক দিয়েছে। এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য বিএনপির উপর চাপ প্রয়োগ করে তাদেরকে পিআর মেনে নেয়া ও সংস্কারের বৈধতা দেয়ার দাবী মেনে নিতে বাধ্য করা। যদি বিএনপি এই দাবীতে একমত না হয়, তাহলে ডঃ ইউনুসের কাছে গণভোট দেয়া ছাড়া অন্য কোন বিকল্প থাকবে না।

উপসংহার: পথের দিশা কী?

বাংলাদেশ যদি সত্যিকার অর্থে অংশগ্রহণমূলক, অন্তর্ভুক্তিমূলক, এবং জবাবদিহিমূলক গণতন্ত্র চায়—তবে PR পদ্ধতির চিন্তা অত্যন্ত সময়োচিত। তবে তা চাপিয়ে দিয়ে নয়, বরং জনমতের মাধ্যমে আনতে হবে। গণভোট হতে পারে সেই উত্তরণের সেতুবন্ধন।

আমাদের সামনে এখন প্রশ্ন একটাই—আমরা কি শুধুই নির্বাচন চাই, নাকি চাই এমন এক ব্যবস্থা, যেখানে প্রতিটি ভোটের মূল্য আছে?

জুলাই আন্দোলনে ১৫০০ মানুষের জীবন বিসর্জন হয়তো অর্থহীন হয়ে যাবে, যদি সংস্কারের বৈধতা দেয়া না যায়।

তাই শেষ পর্যন্ত এই দুটি ইস্যু বাংলাদেশকে হয়তো গণভোটের দিকেই নিয়ে যাবে বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন।

📌 তথ্যসূত্র

  • ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (২০২৪)
  • সুজন গবেষণা প্রতিবেদন, ২০২৫
  • IDEA International: Electoral Systems Overview
  • UNDP Bangladesh: Democracy & Inclusion Report (2024)
  • নির্বাচন কমিশন অফিস, বাংলাদেশ

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *