
আয়শা সাথী (শিক্ষক ও গবেষক): যেকোন রাজনৈতিক বিপ্লবের পর একটি দেশের আর্থ-সামাজিক পরিবর্তন একটি নতুন সরকারকে নানামুখী চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড় করায়। বাংলাদেশ এর ব্যতিক্রম নয়। ২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলন পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকারের যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে কিছু প্রতিবন্ধকতা। অন্তর্বর্তী সরকার দেশ শাসন ক্ষমতা হাতে নেয়ার পর যেসকল গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপগুলো নিয়েছে তা হলো নির্বাচন ও নিরাপত্তা বিভাগে সংস্কার, মানবাধিকার ভিত্তিক আইন সংস্কার, দুর্যোগ-প্রশাসনে উন্নয়ন এবং সাংবাদিক স্বাধীনতার নিরাপত্তা। জুলাই–আগস্ট গণআন্দোলনের পর স্বনির্বাচিত অন্তর্বর্তী সরকার ‘স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন’ অনুষ্ঠানের প্রতিশ্রুতি দেয় যার ফলশ্রুতিতে ইতিমধ্যেই জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় নির্ধারণ করা হয়।
নির্বাচন কমিশন ও বিচার বিভাগে সংস্কার আনার লক্ষ্যে ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ তারিখে ১১টি ‘রিফর্ম কমিশন’ গঠন করা হয়। ১জুলাই–৫আগস্ট পর্যন্ত সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘন নিরূপণে সহায়তা করতে জাতিসংঘের মানবাধিকার কর্মকর্তাদের বাংলাদেশে আমন্ত্রণ জানানো হয় এবং OHCHR–এর মাধ্যমে তথ্য-নিরীক্ষা প্রক্রিয়া শুরু হয়। Human Rights Watch জানায়, নিরাপত্তা খাত থেকে হতাশাজনক অনিয়ম বন্ধ করার লক্ষ্যে নিরাপত্তা বিভাগ সংস্কারে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এতে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সহায়তা নিয়ে রোডম্যাপ প্রণয়ন শুরু করা হয়েছে। নাগরিক স্বাধীনতা উন্নত করতে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন ও সাইবার নিরাপত্তা আইন থেকে বেশ কিছু ধারা প্রত্যাহার করা হয়। UN Country Results Report, 2024–এ উল্লেখ রয়েছে যে, করোনা ও রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যেও স্বাস্থ্য, বন্যা প্রবৃদ্ধি, নারী–বর্ষজাতিক সমতা এবং জলবায়ু সহনশীলতায় ১৭০+ উন্নয়ন প্রকল্প সফলভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে।
অর্জনের সাথে সাথে অন্তর্বর্তী সরকারকে (Chief Adviser Muhammad Yunus নেতৃত্বে) বেশ কিছু রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও বিভাজনের মুখোমুখি হতে হয়েছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা, আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা, রাজনৈতিক দল নিষেধাজ্ঞা, নির্বাচনী বিরোধ, প্রশাসনিক দুর্নীতি, জন নিরাপত্তার ঘাটতি ও আন্তর্জাতিক নীতির দ্বন্দ্ব এগুলোকে বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দাঁড় করিয়েছে। বিএনপি–জামায়াত ও নতুন ছাত্র/যুবমঞ্চের মধ্যে ভোটের সময় ও সংস্কার নিয়ে তীব্র দ্বন্দ্ব চলছে। মে ২০২৫-এ আওয়ামীলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলে যা আরো তীব্র হয়। ভারতের কারিগরি–সামরিক সহায়তা বন্ধ ও ঢাকায় চীনের শক্তিশালী অবস্থান জাতিসংঘের পৃষ্ঠপোষকতা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতিতে কঠিন পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে। গুরত্বপূর্ণ ইস্যু যা নিয়ে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে যার মধ্যে প্রধান তিনটি ইস্যু ছিলো সংখ্যালঘু নির্যাতন, ছাত্র রাজনীতি ও নারী অধিকার।
ধর্মীয় সম্প্রতির দেশ বাংলাদেশে বরাবরই সকল ধর্মাবলম্বী মানুষের সমান সুযোগ সুবিধা ও অধিকার সংরক্ষিত ছিল। কিন্তু প্রত্যেকটি আন্দোলন পরবর্তী সময়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় রাজনৈতিক সুবিধার্থে রাজনৈতিক সহিংসতার নিশানা হন।
জুলাই–অক্টোবর ২০২৪ আন্দোলন পরবর্তী উত্তাল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিশেষ করে খুলনা, কুমিল্লা, সুনামগঞ্জ ও বরিশাল অঞ্চলে হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের বাড়িঘর, মন্দির, গির্জায় হামলা চালানোর অভিযোগ তোলা হয়। হিউম্যান রাইটস ফোরামের রিপোর্ট অনুযায়ী, আগস্ট–ডিসেম্বর ২০২৪ সময়কালে ৪৭টি সংঘাত/হামলার ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে, যার মধ্যে অধিকাংশই জমি দখল, ধর্মীয় উস্কানি ও গুজবপ্রসূত সহিংসতা (সূত্র: Human Rights Forum Bangladesh, 2025 Annual Brief)। একাধিক জায়গায় ‘গায়েবি দলিল’ দেখিয়ে জমি অধিগ্রহণ বা দখল করার অভিযোগ করা হয় যার প্রেক্ষাপটে United Nations OHCHR সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সহিংসতা এবং জমি দখলের ঘটনাগুলোর সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের দাবী করে। পরবর্তীতে সাংবিধানিক অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করে সরকার ২০২৪ সালের ডিসেম্বরের এক বিবৃতিতে সংখ্যালঘুদের ‘রাষ্ট্রীয় সমান মর্যাদা’ নিশ্চিত করার কথা পুনর্ব্যক্ত করে। সংখ্যালঘু কল্যাণ ট্রাস্ট–এর বরাদ্দ সামান্য বাড়ানো হয় এবং একটি ‘মাইনরিটি অ্যাফেয়ার্স কমিশন’ গঠনের প্রস্তাব আলোচনায় আসে। যদিও বাস্তবতায় এসব প্রতিশ্রুতি জেলাভিত্তিক প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তা, কখনো পক্ষপাতিত্বের কারণে আশানুরূপ কার্যকর হয়নি। এসকল ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে The Guardian, “Bangladesh Minorities fear repeat of past violence as political chaos grows” শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ করে (November,2024)।
জুলাই আন্দোলনের পরবর্তী সময়কালে বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনে ছাত্র রাজনীতি পুনরায় সক্রিয় হয়ে ওঠে। তবে এ সক্রিয়তা ছিল নিয়ন্ত্রণহীন ও সহিংসতায় ভরপুর। পুরাতন রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠন ও নতুন প্রগতিশীল সংগঠনের মধ্যে দ্বন্দ্ব শিক্ষার পরিবেশকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করে। শিক্ষক লাঞ্চিতের ঘটনাও ঘটে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে। সরকার প্রশাসনিকভাবে কিছু উদ্যোগ নিলেও বাস্তবতায় ছাত্রদের নিরাপত্তা ও মতপ্রকাশের অধিকার নিশ্চিত করতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হয়। জুলাই আন্দোলনের সময় ও পরে ‘বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ ও ‘নবগঠিত প্রগতিশীল ছাত্র ফ্রন্ট’ নামক সংগঠনগুলো বিশেষভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠে। পুরাতন দলীয় ছাত্র সংগঠন যেমন ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় এবং বিএনপির ছাত্র সংগঠন ছাত্রদল সীমিতভাবে ক্যাম্পাসে ফিরে আসার চেষ্টা করে- যদিও অনেক ক্ষেত্রে এদের ওপর নিষেধাজ্ঞা বলবৎ ছিল। এর ফলে একাধিক ক্যাম্পাসে সংগঠনগত নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাব বিস্তার নিয়ে সংঘর্ষ শুরু হয়। অনেক জায়গায় প্রিন্সিপাল ও শিক্ষকরা ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের আহ্বান জানান- কিন্তু সেটি বাস্তবে প্রয়োগ হয় না।
এরই প্রেক্ষিতে জানুয়ারি ২০২৫ -এ Human Rights Watch শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাজনীতি নিয়ে সংঘর্ষে নিরাপত্তাহীনতা ও শিক্ষার ক্ষতি বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে। OHCHR বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের নিরাপত্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে সরকারকে আহ্বান জানায় এবংThe Guardian ‘Campuses in Chaos: Bangladesh’s student wings battle for control’ শিরোনামে রিপোর্ট প্রকাশ করে (Novmer, 2024)।
আইন সংস্কার ও নীতিগত অগ্রগতি
নারী অধিকার রক্ষায় অন্তর্বর্তী সরকারের নীতিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক অগ্রগতি প্রশংসনীয়, বিশেষত আইন সংস্কার ও সামাজিক সচেতনতায়। তবে ইসলামি দলগুলোর কট্টর বিরোধিতা, ধর্মীয় অপব্যাখ্যা ও সামাজিক বিভ্রান্তি এ প্রক্রিয়াকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলছে।
নারী নিরাপত্তা আইনের খসড়া সংস্কার: ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে অন্তর্বর্তী সরকার ‘নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ আইন” আধুনিকায়ন শুরু করে। এতে ডিজিটাল মাধ্যমে হয়রানি, কর্মক্ষেত্রে বৈষম্য ও পারিবারিক সহিংসতার জন্য কঠোর শাস্তির বিধান রাখা হয়। সরকার ও UNDP–এর যৌথ প্রকল্পে ‘শত সহস্র নারী’ প্রকল্প চালু হয়, যেখানে নারী মালিকানাধীন উদ্যোগে প্রাথমিক অনুদান ও প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। সরকারি টেলিভিশন ও রেডিওতে ‘নারীর অধিকার ও শালীনতা’ বিষয়ক ধারাবাহিক প্রচার কার্যক্রম চালু হয় (জাতীয় সম্প্রচার বোর্ড, ২০২৫)। UN Women Bangladesh, 2024 থেকে জানা যায়, একাধিক মানবাধিকার সংগঠনের আহ্বানে সরকার মহিলা ও শিশু মন্ত্রণালয় মারফত উত্তরাধিকার, তালাক ও বিবাহ সংক্রান্ত ক্ষেত্রে লিঙ্গ-সমতা বজায় রাখতে শরিয়াভিত্তিক পারিবারিক আইন পর্যালোচনার ঘোষণা দেয়। তবে হেফাজতে ইসলাম ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ প্রকাশ্যভাবে নারী আইনে সংশোধনের বিরোধিতা করে। তারা দাবি করে, এসব পরিবর্তন ‘ইসলামী শরিয়াহর পরিপন্থী’ ও ‘পশ্চিমা এজেন্ডা’ দ্বারা প্রভাবিত। অক্টোবর ২০২৪–এ ঢাকা ও সিলেটে ‘নারী অধিকার সংস্কার’ বিরোধী বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। এতে নারীদের ‘উন্মুক্ত সামাজিক ভূমিকা’ ও আইনগত সমতা নিয়ে আপত্তি তোলা হয় (The Daily Star, Oct 2024)। কিছু ইসলামি দলের অনুগত মিডিয়া ও সামাজিক মাধ্যমে নারী আইন সংস্কারকে ‘ইসলামবিরোধী’ বলে মতবাদ ছড়ায়। Amnesty Bangladesh রিপোর্ট, ডিসেম্বর ২০২৪ জানায়, ইসলাম সমর্থিত দলগুলো থেকে ‘ইসলামী নারী আদর্শ’ নামে প্রচারণা চালানো হয় যাতে আধুনিক নারী অধিকারের ধারণাকে ‘বিদেশি নাস্তিকতা’ বলা হয়। জাতিসংঘ নারী (UN Women) বাংলাদেশে নারীর অধিকার অগ্রগতিতে অন্তর্বর্তী সরকারের পদক্ষেপকে ‘positive but fragile’ আবলে অভিহিত করে এবং ধর্মীয় প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় প্রতিরক্ষার আহ্বান জানায়। Human Rights Watch নারীর অধিকারে ইসলামী দলগুলোর প্রতিবন্ধকতাকে ‘fundamentalist blockade’ হিসেবে অভিহিত করে রাষ্ট্রকে ধর্মীয় সহনশীলতা বজায় রেখে আইন প্রয়োগের আহ্বান জানায়। বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসে সিলেটে ও ময়মনসিংহে নারী স্কুলে হামলার প্রতিবাদ জানায় এবং প্রশাসনকে আরও কঠোর পদক্ষেপের আহ্বান জানায়।
সংখ্যালঘু অধিকার, নারী অধিকার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র রাজনীতি অন্তর্বর্তী সরকারকে নানামুখী বিতর্কের সম্মুখীন করলেও আশা করা যায় সময়ের পরিক্রমায় এসকল চ্যালেঞ্জের সময়োপযোগী সমাধান করা সম্ভব। সংখ্যালঘু সমস্যা সমাধানে সকল রাজনৈতিক দলকে একত্রিত হয়ে বিদ্যমান সংবিধান ও আইন বাস্তবায়নে কঠোর নজরদারি এবং দায়বদ্ধতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে, হামলা ও সহিংসতার ঘটনার বিচার দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য আলাদা ট্রাইব্যুনাল বা ফাস্ট ট্র্যাক কোর্ট চালু করে আইনগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্র রাজনীতি হোক কিন্তু দলনিরপেক্ষভাবে। ক্যাম্পাসে অস্ত্র, সহিংসতা ও দখলদারিত্বে জড়িত ছাত্রদের বিরুদ্ধে দ্রুত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে সরকারকে। সম্প্রতী বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনুষ্ঠিত শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে ‘ছাত্রসংসদ’ নির্বাচন ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের সৃষ্টি করবে। নারী অধিকার রক্ষায় সরকার ও উন্নয়ন সহযোগীদের উচিত নারী বিষয়ক সংকট মোকাবেলায় ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে সংলাপ, আইনগত প্রয়োগ এবং সচেতনতা বাড়ানোর মধ্য দিয়ে একটি ভারসাম্যপূর্ণ উন্নয়ন কৌশল গ্রহণ করা। সর্বোপরি জাতিসংঘ ও মানবাধিকার সংগঠনের সুপারিশ বাস্তবায়ন না হলে জুলাইয়ের স্বপ্ন, রাজনৈতিক স্থায়িত্ব ও গণতান্ত্রিক সংস্কার নিশ্চিত করা কঠিন হবে।
লেখক – শিক্ষক ও গবেষক-বরগুনা।