সামসুল ইসলাম টুকু : প্রকাশ্যে, রাজপথে, জনারন্যে সংঘটিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন অপরাধ। সবল মারছে দুর্বলকে। গ্যাং দুর্বৃত্তরা লাঠি সোঠা, কাতা, ছুরি, চাপাতি চালিয়ে প্রতিপক্ষকে হত্যা করছে, জখম করছে, কাউকে পঙ্গু করে দিচ্ছ সারা জীবনের জন্য। ভাড়াটিয়া খুনিরা অর্থের বিনিময়ে সিন্ডিকেটের ইশারায় খুন করছে নির্দোষ মানুষকে। বিরোধী দলের রাজনীতি করায় সহপাঠীকে নির্যাতন করতে করতে হত্যা করছে। মেয়েদের শ্লীলতা হানী করার প্রতিবাদ করতে গিয়ে লাশ হতে হচ্ছে পিতা, ভাই ও স্বজনকে। রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে খুন হচ্ছে, গুম হচ্ছে। হিংসা,অর্থ সম্পত্তির লোভে, স্বার্থের ব্যাঘাত হলে, আধিপত্য বাজায় রাখতে, একজন আরেকজনকে খুন করছে। সাম্প্রদায়িক কারণে খুন হচ্ছে। প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে এসিড নিক্ষেপ করে সুন্দর চেহারাকে বিকৃত করছে, হত্যা করছে। ঠুনকো অজুহাতে গৃহকর্মীদের উত্তপ্ত লোহার ছেঁকা দিচ্ছে। নারী পুরুষের মেলামেশাকে কেন্দ্র করে খুন হচ্ছে। প্রভাবশালী সমাজপতিরা ওই নারী পুরুষদের গাছের সাথে বেঁধে উলঙ্গ করে পেটাচ্ছে। ছিনতাইকারীরা অর্থের লোভে পথচারীকে খুন করছে। যুবক যুবতীরা যেখানে সেখানে যৌনকর্ম করছে। গোবেচারা মসজিদের ইমামরাও সমকামিতা ও যৌনকর্ম করতে গিয়ে ধরা পড়ছে।
চলমান এই বর্বরতা আমরা দেখছি কিন্তু প্রতিকার করতে পারছিনা বা হচ্ছেনা। ঘটনাগুলো আমরা দেখে না দেখার ভান করছি। বরং অতিদ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করছি। যেন ঘাতকরা বুঝতে না পারে যে আমি তাদের দেখেছি বা চিনেছি। কোথাও কোনো বিচার সালিশ হচ্ছে। বুঝতে পারছি অন্যায় হচ্ছে। কিন্তু কিছু বলতে পারছিনা। প্রতিপক্ষের শত্রু হব ভেবে। আমার মত সবাই কাপুরুষ তা বলতে চাইনা বা ভাবিওনা। আজও সমাজে প্রতিবাদী মানুষ আছে, ভাল মানুষ আছে বলেই হয়তো সমাজে এখনো ভারসাম্য আছে। তবে অরাজকতা অব্যাহত আছে। সাধারণ মানুষ সঙ্কাহীন হতে পারছেনা। দাঁতে দাঁত চেপে নীরব দর্শক হয়ে থাকছে। এমনই দুঃসময় আমরা অতিক্রম করছি। সমাজের এবং মানুষের ভবিষ্যৎ পরিণতি সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা আসেনা মোটেই।
অন্যায়ের প্রতিবাদ করা,সত্যকথা বলা ধর্মের কাজ এবং দর্শনের কাজও বটে।কিন্তু কোনোটাই করিনা। কার কী হলো মুখ ফিরিয়ে দেখিনা। আমার কিছু না হলেই হলো। যাকে বলে আপনি বাঁচলে বাপের নাম। কোথাও একটা অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। একটা সত্য কথা বললে হয়তো দৃশ্যপটটাইবদলে যেতে পারে তবুও বলিনা। বরং সেখান থেকে সরে যাই। নিজেকে বাঁচিয়ে চলতে চেষ্টা করি। নিজের নিরাপত্তা খুঁজি। কেউ যদি বলে কি হচ্ছে ওখানে। তাহলে সত্যটা গোপন করে বলি, কি জানি ভাই কি হয়েছে বুঝতে পারিনি। সব দেখি,শুনি, বুঝি কিন্তু নীরব থাকি ভাল মানুষের ভান করি।নৈতিকতা নামক জিনিসটা আমাদের মাঝ থেকে হারিয়ে গেছে। সত্য বলাটা বিপজ্জনক মনে করছি। মিথ্যার স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়েছি। সত্য বলা আর নৈতিকতা রক্ষা করাটা ধর্মের যে কোনো আচার অনুষ্ঠানের চেয়ে ভারী বলে সেটা বহন করছিনা।দুর্বল ঈমানের অনুসারী হয়ে বেঁচে আছি। সৃষ্টিকর্তার দেয়া বিবেকটা জাগ্রত নেই তাই প্রতিবাদ করতে যাইনা। হয়তো সুপ্ত অবস্থায় আছে তাই ন্যায় অন্যায় সত্য মিথ্যা বুঝতে পারি। আর যাদের বিবেকটা লুপ্ত হয়ে গেছে তারাতো খুন, জখম, প্রতারণা, ধর্ষণসহ সব অপরাধ করে যাচ্ছে নির্বিকার চিত্তে। তারা বুঝতেই পারেনা যে তারা অপরাধ করছে।
নৈতিকতার সাথে সামাজিক দায়বদ্ধতা বলে আরও একটা জিনিস আছে। সেটাও গুরুত্ব পায়না যদি সে কাজে ঝুঁকি থাকে। তখন বলি এটা আমার কাজ নয়। সমাজের কাজ, সমাজ করুক। এমন বোধ নিয়ে বেঁচে আছি। প্রতিপক্ষের আঘাতে মুমূর্ষু ব্যক্তি পথে পড়ে আছে, অসুস্থ মানুষ মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে, সাহায্যের জন্য হাত বাড়াচ্ছে, কাকুতি মিনতি করছে কিন্তু কর্ণপাত করছিনা। বরং দ্রুত এলাকা ত্যাগ করছি। অকারণে উটকো ঝামেলা ঘাড়ে চাপার ভয়ে। কেন এমন হলাম। বয়স ৭০ অতিক্রম করেছি, শরীরে শক্তি নেই,চোখে কম দেখি, তাই বোধহয় ভীরুর মত পালিয়ে যাই। আশেপাশে আগেপিছে চেয়ে দেখি কিশোর, যুবক, প্রৌঢ়, বৃদ্ধ সবাই আমাকে অনুসরণ করছে। তখন মনে হয় ভীরুর কাতারে আমি একা নই। সত্য কথা বলা, অন্যায়ের প্রতিবাদ করা, অসহায়কে সাহায্য করা আমাদের মন থেকে উবে গেছে। বোকার মত চেয়ে থাকাটাই অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।
এবার আসি নতুন প্রজন্মের কথায়। যখন ক্লাশ সেভেন এইটে পড়ি তখন আব্বা আমাকে হরিমোহন উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে নিয়ে যেতেন সকাল বেলায়।কয়েকবার মাঠ ঘুরে যখন বাড়ি ফিরতাম তখন আব্বা প্রায়ই বলতেন একটা শিশু যে সামাজিক অবস্থায় গড়ে উঠবে, বড় হবে সেটাকেই নিয়ম ও সত্য বলে বিশ্বাস করবে, চলমান সংস্কৃতিকে গ্রহন করবে। ফলে তার চাল চলন, গতি প্রকৃতি তেমনটাই হবে। অর্থাৎ শিশুটির আত্মীয় স্বজন, পাড়াপড়শী, সহপাঠী, বন্ধুদের আচার আচরণ, জীবনযাত্রা,নৈতিকতা যেমনটা দেখবে তার স্বভাব চরিত্র ওই রকমই হবে। যে রাজনৈতিক পরিবেশে মানুষ হবে তেমনই সে আয়ত্ব করবে। রাষ্ট্রের আইন কানুন যেভাবে প্রয়োগ হবে, যেমন গতিতে চলবে সেটাই সে অনুসরণ করবে। সমাজের খণ্ড খণ্ড চিত্র কী বলে। পাড়ায় পাড়ায় রাস্তাঘাটে বখাটেদের উপদ্রব, অত্যাচার,মাদকাসক্ত,মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা,ধর্ষণ করার যে প্রবণতা সেটাতেই সে আকৃষ্ট হবে। কারণ এই খারাপ আচরণগুলোর প্রতিকার হয়না এবং ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে রাজনীতির দাপাদাপি, ক্ষমতার অপব্যবহার, অপচর্চা,হিরো হবার আকাঙ্খা কিশোর কিশোরী যুবক যুবতীদের বেপরোয়া করে তুলে। তাস, ক্যারামবোর্ডে জুয়া খেলা, ফেসবুকে নগ্নচর্চা, গ্যাং তৈরি করা, ছিনতাই করা এখন স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে গেছে। মিথ্যাচার হয়ে গেছে মজ্জাগত। নতুন প্রজন্ম তাদের জন্মের পর থেকে ভাল সামাজিক অবস্থার সাথে পরিচিত হয়নি। হয়তো জানেও না। তাহলে তাদের কাছ থেকে নীতি, নৈতিকতা, সত্য, ন্যায় কীভাবে আশা করবো। আমার ওই সুপ্ত বিবেক প্রসূত কোনো উপদেশমূলক কথা বললে তারা বিরক্ত হয় এবং স্পষ্ট ভাবেই বলে আপনারা যে সমাজ রেখে গেছেন সেটাইতো অনুসরণ করছি মাত্র। তখন নিজেকে ভীষণ অপরাধী বলে মনে হয়।
এবার দেখা যাক আমাদের জাতীয় রাজনীতির অবস্থা কী। বাংলাদেশ দীর্ঘদিন সামরিক শাসনের অধীনে ছিল। সেসময় দেশের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলো আন্দোলন করতে গিয়ে জেল জুলুমের শিকার হয়েছে। গণতন্ত্র চর্চার সুযোগই পায়নি। পরবর্তীতে এসব দল ক্ষমতায় গেলেও তাদের মধ্যে সমন্বয় ছিলনা এবং তেমন উন্মুক্ত গণতন্ত্র চর্চার সুযোগ সৃষ্টি করেনি বরং গণতন্ত্রের নামে স্বৈরতন্ত্র চাপিয়ে দিয়েছে। স্বৈরতন্ত্র কোনো সমস্যার সমাধান দিতে পারেনি। গণতন্ত্রে মানবাধিকার, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, অন্যায়ের প্রতিবাদ করার অধিকার থাকলেও রক্ষী বাহিনী দিয়ে ত্রাস সৃষ্টি করে, একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করে, ক্লিনহার্ট অপারেশন করে বন্দুক যুদ্ধের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে, গুম করে, সংবাদ পত্রের স্বাধীনতা খর্ব করে,পুলিশ দিয়ে পিটিয়ে, আয়নাঘর তৈরি করে নৈরাজ্য সৃষ্টি করা হয়েছে। যৌক্তিক প্রতিবাদ, নায্য আন্দোলন করা যায়নি। ভিন্ন মত প্রকাশ করা যায়নি। মুক্ত চিন্তায় বিশ্বাসীরা মত প্রকাশ করতে পারেনি। তারপরেও নতুন প্রজন্ম কোটা বিরোধী আন্দোলন করেছে। নিরাপদ সড়ক আন্দোলন করেছে। তাদেরও নির্মমভাবে পেটানো হয়েছে বার বার। তারা থেমে থাকেনি। জুলাইয়ের সফল গণ অভ্যুত্থান করে ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন ঘটিয়েছে। এ এক অসাধ্য সাধন করেছে তারা। মানুষের মনে আশার সঞ্চার সৃষ্টি হয়েছে। তারা একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন নোবেল বিজয়ী ড, ইউনুসকে ক্ষমতায় বসিয়েছে ও উপদেষ্টা নির্বাচনে সহযোগিতা করেছে। এর বেশ কিছু সুফলও পেয়েছে দেশবাসী। অপরাধী খুনিদের আংশিক গ্রেপ্তার করা হয়েছে, কাঠগড়ায় দাড় করা হয়েছে। কিন্তু খুনী আসামিদের মত করে নয়। বরং ভিআইপি কায়দায় অহংকারের সাথে। তাই জাতি আশঙ্কামুক্ত হতে পারছেনা। ষড়যন্ত্র অব্যাহত আছে। গোটা জাতি কী করবে বুঝতে পারছেনা। আশা নিরাশার দোলায় দুলছে। রাজনৈতিক দলগুলোর গনবিমুখী ভূমিকার কারণে জাতি আজ বিভক্ত। নীরব নিশ্চুপ। দলগুলো জুলাই অভূ্ত্থানকারীদের বিভিন্নভাবে ছোট দেখানোর চেষ্টা চালাচ্ছে, বিভক্ত করা হচ্ছে নানামুখী রাজনৈতিক অপতৎপরতায়। ফলে দেশের নতুন প্রজন্ম বিভ্রান্ত, রাজনীতি বিমুখ। সত্য ও নৈতিকতার দর্শন তাদের কাছে নিষ্প্রাণ বস্তু। দুর্নীতি সীমাহীন হয়ে গেছে। সেদিকেই প্রলুব্ধ হচ্ছে। একে নিয়ন্ত্রণ করাই যাচ্ছেনা। দেশের অর্থনীতিতে ভীষণ ভারসাম্যহীনতা লক্ষণীয়। জনগণের অর্থ হরণকারীদের বিচার হচ্ছেনা এবং যাচ্ছেনা। এরচেয়ে বড় বিচারহীনতা আর কী হতে পারে। এছাড়াও সমাজের অভ্যন্তরে আরো কত বড় অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে তার অনেক কিছুই জানতে পারছেনা জাতি। আর প্রতিকারের তো প্রশ্নই উঠেনা। এসব প্রতিকারে দায়িত্ব ছিল আমাদেরই অর্থাৎ প্রবীণদের। যাদের চাওয়া পাওয়ার কিছু বাকি নেই। কিন্তু তারা আজ নীরব নিশ্চুপ। এই নীরবতার সংস্কৃতি আমাদের সমাজের গভীরে একদিনে প্রোত্থিত হয়নি। কয়েক যুগ পেরিয়ে গেছে। এমন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য কবি সুকান্তের লেখা ছাড়পত্র কবিতার কিছু অংশ মনে পড়ে গেল। তিনি লিখে গেছেন,
এই জীর্ণ পৃথিবীতে
ব্যর্থ মৃত্যু আর ধ্বংস স্তূপ পিঠে চলে
যেতে হবে আমাদের, চলে যাবো,
তবু আজ যতক্ষনদেহে আছে প্রাণ
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাবো জঞ্জাল
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাবো আমি
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার
অবশেষে সব কাজ সেরে আমার দেহের রক্তে
নতুন শিশুকে করে যাবো আশীর্বাদ
তারপর হবো ইতিহাস।
তারপরেও এই ইতিহাস সৃষ্টি করার প্রতিজ্ঞা বাস্তবায়নের ক্ষমতা যেন অবশিষ্ট নেই।শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। রক্তে তেজ নেই। তাই নির্লজ্জভাবে এ অপরাধ স্বীকার করে নতুন প্রজন্মকে দোয়া করে যেতে চাই তারা যেন তাদের উষ্ণ রক্ত দিয়ে জুলাইয়ের শক্তি পুঁজি করে সুন্দর গণতান্ত্রিক দেশ গড়তে পারে। যদি তা সম্ভব না হয় তবে আমরা একটা নীতিহীন জাতিতে পরিণত হব।