ফ্লোটিলা বহর ফিরে এলো মানবিকতার নতুন বার্তা নিয়ে

সুপ্রভাত সিডনি প্রতিবেদন : সম্প্রতি বিশ্বের প্রায় ৪৪টি দেশ থেকে মানবাধিকার কর্মী, সাংবাদিক, চিকিৎসক ও স্বেচ্ছাসেবীরা এক অভূতপূর্ব মানবিক অভিযানে অংশ নিয়েছেন। তারা সমুদ্রপথে যাত্রা শুরু করেছেন “ফ্লোটিলা বহর” নিয়ে, যার লক্ষ্য গাজায় নির্যাতিত -আটকে পড়া ও মানবিক বিপর্যয়ের মুখে থাকা লাখো নিরীহ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া খাবার, পানি, ওষুধ এবং চিকিৎসা সহায়তা। এ অভিযানের নেতৃত্ব দিচ্ছেন বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন ও শান্তিকর্মীরা, যারা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন, মানবতার উপরে কোনো রাজনৈতিক সীমারেখা নেই। গাজায় ইসরায়েলের অবৈধ অবরোধের প্রতিবাদে গত ৩১ আগস্ট স্পেনের বার্সেলোনা থেকে যাত্রা শুরু করে গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলার নৌবহর। তবে তারা গাজায় পৌঁছাতে পারেনি। পথে ইসরায়েলি নৌবাহিনী অভিযান চালিয়ে বিভিন্ন দেশের প্রায় ৪৫০ জন মানবাধিকার কর্মীকে আটক করে। এরই ধারাবাহিকতায়, গাজামুখী এই ত্রাণবাহী বহর গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা থেকে ৩৭ দেশের প্রায় ২০০ অধিকারকর্মীকে আটক করেছে ইসরায়েল।

এই বিশাল অভিযানের সঙ্গে যুক্ত আছেন অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপ, এশিয়া, আফ্রিকা, বাংলাদেশ, আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের ৪৪টি দেশের প্রতিনিধিরা। প্রত্যেকেই স্বেচ্ছায় তাদের সময়, শ্রম ও অর্থ ব্যয় করে এই যাত্রায় অংশ নিয়েছেন। তারা বলছেন, গাজার আকাশে যখন ড্রোন ও বোমার শব্দ, তখন মানবতার পক্ষ থেকে শান্তির কণ্ঠ তুলে ধরা জরুরি।

মানবিকতার আহ্বান ও ফ্লোটিলার উদ্দেশ্য

ফ্লোটিলা বহরের মূল উদ্দেশ্য গাজায় জরুরি ত্রাণ ও চিকিৎসা সহায়তা পৌঁছে দেওয়া। দীর্ঘ অবরোধ, খাদ্য সংকট ও চিকিৎসা ঘাটতিতে বিপর্যস্ত গাজাবাসীর জীবন আজ মৃত্যুর মুখে। হাসপাতালগুলোতে ওষুধ নেই, পানির সরবরাহ বন্ধ, খাদ্য মজুদ ফুরিয়ে গেছে। শিশু ও বয়স্কদের মৃত্যু প্রতিদিনের ঘটনায় পরিণত হয়েছে।

এই পরিস্থিতিতে বিশ্বের বিবেকবান মানুষরা চুপ করে থাকতে পারেননি। তারা নিজের জীবন ঝুঁকিতে ফেলে হলেও গাজায় সহায়তা পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এ ফ্লোটিলা বহরে রয়েছে ৩০টিরও বেশি জাহাজ, প্রতিটিতে বহন করা হচ্ছে খাদ্য, পানি, ওষুধ, ব্যান্ডেজ, সার্জিক্যাল যন্ত্রপাতি এবং অন্যান্য জরুরি সরঞ্জাম। বহরের প্রতিটি জাহাজে মানবাধিকার কর্মীরা ছাড়াও রয়েছেন সাংবাদিক ও চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ, যারা গাজায় পৌঁছে সরাসরি ত্রাণ তৎপরতায় অংশ নেবেন।

সাফল্যের বার্তা: সমুদ্রপথে ঐক্যের প্রতীক

এ পর্যন্ত ফ্লোটিলা বহরের অগ্রযাত্রা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এক বিরল ঐক্যের প্রতীক হয়ে উঠেছে। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, এবং লাতিন আমেরিকার কয়েকটি দেশ ইতোমধ্যে এই উদ্যোগকে “মানবিক সাহসের উদাহরণ” হিসেবে অভিহিত করেছে।

বিশেষ করে নরওয়ে, আয়ারল্যান্ড, তুরস্ক, দক্ষিণ আফ্রিকা, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও কানাডার মানবাধিকার সংগঠনগুলো একযোগে এই মিশনে যুক্ত হওয়ায় বিশ্বব্যাপী এক ধরনের সংহতির বার্তা ছড়িয়ে পড়েছে। এটি প্রমাণ করে, গাজার জনগণের প্রতি সহানুভূতি কোনো ধর্ম, জাতি বা ভৌগোলিক সীমানায় আবদ্ধ নয়; এটি এক আন্তর্জাতিক মানবতার ডাক।

ফ্লোটিলা বহরের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে গাজা ইস্যু আবারও আলোচনায় এসেছে। বহুদিন ধরে অবরুদ্ধ ফিলিস্তিনিদের দুরবস্থা, শিশুদের না খেয়ে মৃত্যু, এবং চিকিৎসা সংকটের ভয়াবহ চিত্র নতুন করে সামনে এনেছে এই অভিযান। বিশ্বের কোটি মানুষ এখন আবার গাজার পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানাচ্ছে।

কূটনৈতিক জটিলতা ও নিরাপত্তা ঝুঁকি

তবে এই সাহসী অভিযানের পথ একেবারেই মসৃণ নয়। ইসরাইলি নৌবাহিনী ইতোমধ্যে ঘোষণা দিয়েছে, তারা কোনো “অবৈধ প্রবেশ” মেনে নেবে না এবং প্রয়োজনে ফ্লোটিলা বহরকে আটক করবে। এতে সমুদ্রপথে সংঘর্ষের আশঙ্কা বাড়ছে।

এর আগে ২০১০ সালে “গাজা ফ্রিডম ফ্লোটিলা” নামের একটি বহরকে ইসরাইলি বাহিনী আক্রমণ করেছিল, যেখানে নয়জন মানবাধিকার কর্মী নিহত হন। সেই রক্তাক্ত ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির ভয় এখনো তাড়া করে বেড়াচ্ছে এই মিশনের অংশগ্রহণকারীদের।

কূটনৈতিক মহল বলছে, ইসরাইলের কঠোর অবস্থান এবং পশ্চিমা দেশগুলোর নীরবতা এ ধরনের মানবিক উদ্যোগের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তবে এবারকার ফ্লোটিলা বহরের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যাপক সহানুভূতি দেখা যাচ্ছে। কয়েকটি ইউরোপীয় দেশ ইসরাইলকে সতর্ক করেছে যাতে মানবিক বহরে হামলা না চালানো হয়।

গাজাবাসীর আশার আলো

গাজায় আটকে থাকা মানুষদের জন্য এই ফ্লোটিলা যেন এক নতুন আশার আলো। সামাজিক মাধ্যমে বহু ফিলিস্তিনি নাগরিক কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছেন বিশ্ব মানবাধিকার কর্মীদের প্রতি। তারা বলছেন, “আমরা জানি না এই সাহায্য পৌঁছাবে কি না, কিন্তু আমরা জানি, বিশ্ব এখনো আমাদের ভুলে যায়নি।”

ফ্লোটিলা বহরের যাত্রা শুরু হওয়ার পর গাজার শিশুদের মুখে হাসি ফুটেছে, মানুষের মনে জেগেছে আশার আলো। তারা বিশ্বাস করে, মানবিকতার এই জয়যাত্রা একদিন অবরোধ ভাঙবে, খুলে দেবে স্বাধীনতার পথ।

সমালোচনাও আছে

যদিও বিশ্বের অনেকেই এই উদ্যোগকে মানবতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বলে অভিহিত করছেন, তবু কিছু মহল এটিকে “রাজনৈতিক প্রদর্শনী” হিসেবেও দেখছে। সমালোচকদের মতে, ইসরাইলের নিরাপত্তা নীতি চ্যালেঞ্জ করার উদ্দেশ্যে ফ্লোটিলাকে ব্যবহার করা হচ্ছে রাজনৈতিক চাপের কৌশল হিসেবে।

তবে মানবাধিকার সংস্থাগুলোর জবাব স্পষ্ট “যদি মানবিক সহায়তা পৌঁছে দেওয়া অপরাধ হয়, তাহলে মানবতা বিপন্ন।” তাদের মতে, সমালোচনা নয়, সহযোগিতা ও সহমর্মিতাই আজ সবচেয়ে জরুরি।

স্থানান্তর ও গৃহবন্দি অবস্থান

আটক করা কর্মকাণ্ডীরা ইসরায়েলের একটি বন্দরের দিকে নেওয়া হয় এবং পরে ডেপোর্টেশন (বিভিন্ন দেশে ফেরত পাঠানো) কার্যক্রম শুরু হয়।

ডেপোর্টেশন

প্রবাসী সক্রিয়রা, যাদের মধ্যে কয়েকজন পরিচিত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও আলোচনাকারী ছিলেন, ইসরায়েল থেকে তাদের নিজ নিজ দেশে পাঠানো হয়। উদাহরণস্বরূপ, গ্রেটা থুনবার্গ, এডা কোলাউ, অস্ট্রেলিয়া  ইত্যাদি।

অভিযোগ

বেশ কিছু মানবাধিকার কর্মী বলছেন যে তাদের ওপর নির্যাতন,  মারধর, গ্রেফতারকালে শারীরিক অত্যাচার করা হয়েছে। তাদেরকে খাবার, ঔষধ ইত্যাদি দেয়া হচ্ছেনা। কেউ কেউ অভিযোগ করেছেন যে তাদের  মেট্রেস প্রদান করা হয়নি এবং ঘুমানো ব্যবস্থা অসম্ভব খারাপ ছিল।

আরও অভিযোগ রয়েছে যে কিছু নারীর হিজাব জোরপূর্বক খুলে নেওয়া হয়েছে, কিংবা পোশাক-বস্ত্র পরীক্ষা করা হয়েছে এমনভাবে যা হুমকির ছোয়া পেয়েছে। নারীদের শারীরিকভাবে লাঞ্চিত করা হয়েছে , যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে অনেক নারী।

উপসংহার: মানবতার নৌযাত্রা

“ফ্লোটিলা বহর” আজ শুধু কিছু জাহাজের নাম নয়; এটি বিশ্ব বিবেকের প্রতীক, যেখানে সাহস, সহমর্মিতা ও মানবতার জয়গান ধ্বনিত হচ্ছে। ৪৪টি দেশের মানুষ একসঙ্গে এগিয়ে এসে প্রমাণ করেছেন : মানুষ এখনো মানুষের জন্য বাঁচে।

রাজনৈতিক বিভাজন, সীমান্তের বেড়া কিংবা সামরিক শক্তি হয়তো কিছু সময়ের জন্য এই যাত্রা বাধাগ্রস্ত করতে পারে, কিন্তু মানবিকতার এই স্রোতকে থামানো সম্ভব নয়।

গাজার শিশুর চোখে যে আশার ঝিলিক জ্বলে উঠেছে, সেটিই হয়তো ভবিষ্যতের মানবসভ্যতার আলো। আর সেই আলো ছড়িয়ে দিতে যে ফ্লোটিলা সমুদ্রে ভেসেছে, সেটি ইতিহাসে স্থান করে নেবে “মানবতার নৌযাত্রা” হিসেবে।

ইসরায়েলি বাহিনী বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের মানবাধিকার কর্মীদের আটক করে অমানবিক আচরণ করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। মানবাধিকারকর্মীদের সঙ্গে এমন আচরণ গোটা বিশ্বকে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন ও ব্যথিত করেছে।

আটককৃতদের মধ্যে বাংলাদেশের বিশিষ্ট সাংবাদিক শহিদুল  আলমক অন্যতম। তাকে অন্যায়ভাবে আটক করার ঘটনাকে বাংলাদেশের সাংবাদিক সমাজ এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মহল তীব্র নিন্দা জানিয়েছে।

আমরা সাংবাদিক শহিদুল আলমসহ সকল মানবিক কর্মীদের আটকের ঘটনায় গভীর নিন্দা প্রকাশ করছি  যদিও ইতিমধ্যে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালের সফল ইউনুস সরকারের চাপের মুখে আলোকচিত্রী  শহিদুল আলমকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়েছে  এবং তিনি সসম্মানে দেশে ফিরেছেন।

অনেক দেশে, মানবাধিকার সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে, ইসরায়েল যদি আন্তর্জাতিক জলে (high seas / international waters) বহর আটকায়, তাহলে সেটি আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ হবে। ফ্লোটিলা বহর ইসরাইলে তখনো ঢুকেনি, আন্তর্জাতিক জলসীমারেখায় থাকাবস্থায় সন্ত্রাসী ইহুদীরা ফ্লোটিলা বহরকে আটকে দেয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *