কর্মজীবী নারীদের কর্মঘণ্টা কমানোর প্রস্তাব – কতটা বাস্তব সম্মত?: একটি পোস্টমর্টেম

 

প্রফেসর ডঃ শফিকুর রহমান

ভূমিকাঃ  জামায়াত আমীর বলেছেন, প্রেগন্যান্ট কর্মজীবী নারী এবং যাদের শিশু সন্তান রয়েছে, তাদের কাজের সময় পাঁচ ঘণ্টা করা হবে, কিন্তু বেতন থাকবে আট ঘণ্টার মতো। বাকিটা সরকার ভর্তুকি দেবে। এটি জাতিসংঘ ঘোষণাপত্র, WHO নির্দেশনা এবং অনেক উন্নত দেশের মতো মায়ের ও শিশুর অধিকার রক্ষার উদ্যোগের পক্ষে।  বাংলাদেশের শুধু এডিপি বাস্তবায়নে দক্ষতা বাড়ালে এ ধরনের ভর্তুকি দেওয়া সম্ভব। বিরোধীরা ও কিছু এলিট নারীবাদীরা রাজনৈতিক স্বার্থে ভুল ব্যাখ্যা দিচ্ছেন, কিন্তু অনেক কর্মজীবী নারী এ প্রস্তাবকে সমর্থন করেছেন। সঠিকভাবে মূল্যায়ন করলে এটি বাস্তবসম্মত ও শিশুদের ভবিষ্যতের জন্য উপকারী হতে পারে।

জামায়াত আমীর যা বলেছেনঃ সম্প্রতি জামায়াতে ইসলামীর আমীর বলেছেন যে সকল কর্মজীবী নারী সন্তান গর্ভে ধারণ করছেন ও তাদেরকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছেন, সন্তান লালন পালন করছেন, তাদেরকে তার স্বামীর তুলনায় অনেক বেশী কাজ করতে হয়। তাই আমরা যদি ক্ষমতায় যেতে পারি, তাহলে তাদের কর্ম ঘণ্টা কমিয়ে দিব, যাতে সন্তানের হক আদায় হয়। তিনি পাঁচ ঘণ্টা কাজ করলেও আটঘণ্টার বেতনই পাবেন। তার সরকার নিয়োগ কর্তাদের ৩ ঘণ্টার টাকা ভর্তুকি দিবে, যা পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করা হবে। উনার বক্তব্য বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়ঃ এটি প্রেগন্যান্ট ও ছোট সন্তানদের মায়েদের জন্যে প্রযোজ্য, সকলের জন্যে নয়।

তাছাড়া, জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্রের ২৫(২) ধারা অনুযায়ীঃ “মাতৃত্ব ও শিশুকাল বিশেষ যত্ন ও সহায়তার অধিকারী”। এটি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ১৯৪৮ সালে গৃহীত হয়। অর্থাৎ জামায়াত আমীরের ঘোষণা জাতিসংঘের মানবাধিকারের ঘোষণাপত্রকেই সমর্থন করে। তাছাড়া এই ধরনের সুবিধা/ভর্তুকি  উন্নত বিশ্বের অনেক দেশেই আছে। যেমন অস্ট্রেলিয়াতে একক অভিভাবক (সিঙ্গেল প্যারেন্ট), নানী/দাদী যারা নাতি-নাতনির দেখাশোনা করেন, অথবা যেসকল দম্পতির একজন মূল উপার্জনকারী হন, তাদেরকে প্রতিমাসে সরকারী ভর্তুকি দেয়া হয়। সুরা বাকারায় বলা হয়েছে, নারীগণ তাদের সন্তানদের দুই বছর বুকের দুধ পান করাবে। WHO পরামর্শ দেয় যে প্রথম ৬ মাস শুধু মায়ের দুধ খাওয়াতে হবে। এরপর উপযুক্ত শক্ত খাবার শুরু করে ২ বছর বা তার বেশি সময় পর্যন্ত মায়ের দুধ চালিয়ে যেতে হবে।

এই প্রস্তাব কি বাস্তব সম্মত?  ২০২৫-২৬ অর্থ বছরে বাংলাদেশের বাজেট প্রায় ৪৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, উন্নয়ন বাজেট ২০ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। বাংলাদেশের অতীত রেকর্ড অনুযায়ী দেশটির উন্নয়ন বাজেট/পরিকল্পনা (এডিপি) বাস্তবায়নের সক্ষমতা ৮০ – ৮৫% বেশী নয়। বাংলাদেশের উন্নয়ন পরিকল্পনা (এডিপি)পূর্ণ বাস্তবায়নের প্রধান পাঁচটি বাঁধা নিম্মরুপঃ

১. প্রকল্প অনুমোদনে দেরি ২. কর্মকর্তাদের দক্ষতার অভাব ও জনবল সংকট ৩. টেন্ডার ও ক্রয় প্রক্রিয়ায় সমস্যা ৪. ভূমি অধিগ্রহণে জটিলতা ৫. দুর্বল নজরদারি ও সমন্বয়ের অভাব। তাই শুধুমাত্র দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমেই জামাত বর্তমান বাজেট থেকে ২ বিলিয়ন ডলার সমপরিমাণ অর্থ সাশ্রয় করতে সক্ষম হবে। প্রশ্ন হচ্ছে, জামাতের দক্ষতা কতটা? জামায়েত সমর্থিত ছাত্র সংগঠন ডাকসুতে ছয় মাসে যে কর্মকাণ্ড সফল করে দেখিয়েছে, অন্য সকল ছাত্র সংগঠন ও অতীত ডাকসু বিগত ৫৩ বছরেও তার সমান করতে পারেনি। তেমনি ভাবে অতীতে জামাতের দুই মন্ত্রী নিয়ন্ত্রিত মন্ত্রণালয়ে সততার ও দক্ষতার উদাহরণ হয়ে আছেন। সুতরাং, জামায়াত যদি ক্ষমতায় আসে, তাহলে যেসকল কর্মজীবী নারী প্রেগন্যান্ট, কিংবা যাদের শিশু সন্তান রয়েছে, তাদের চাকুরিদাতাদের ৩ ঘন্টার ভর্তুকি দেয়া খুবই সম্ভব।

এই প্রস্তাবের বিরোধীরা কি বলছেনঃ অভিযোগ ১) জামায়াত নারীদের কর্মঘণ্টা কমিয়ে তাদেরকে ঘরে বসিয়ে রাখতে চাইছে। এই অভিযোগ অসত্য। জামায়াত আমীরের প্রস্তাব সকল নারীদের জন্যে নয়, কেবলমাত্র প্রেগন্যান্ট নারী, কিংবা যাদের ছোট শিশু রয়েছে, তাদের জন্যে প্রযোজ্য। অভিযোগ ২) জামায়াত নারীদের চাকুরীতে যোগদানের বিরোধী, এটাও অসত্য। জামায়াতের প্রায় সকল নেতা তাদের নিজ নিজ পেশায় প্রতিষ্ঠিত, এবং তাদের অনেকেরই স্ত্রীরা কর্মজীবী। অভিযোগ ৩) এই প্রস্তাব বাস্তবায়ন অযোগ্য, এটাও সঠিক  নয়। দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জত সমাজে সৎ নেতৃত্বের মাধ্যমে দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরতে পারলে এবং বাংলাদেশের বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে দক্ষতা বৃদ্ধি করতে পারলে জামাত আমীরের এই প্রস্তাব খুবই বাস্তবায়ন যোগ্য।

আসল রহস্যঃ জামাতের আমীরের প্রস্তাবের যারা বিরোধিতা করছেন তাদের মধ্যে দুই শ্রেণীর মানুষ রয়েছেনঃ ১) জামাত বিরোধী রাজনীতিবিদ –  যারা জামায়ত আমীরের এই প্রস্তাবের বিপরীতে এর চেয়ে ভালো কোন প্রস্তাব দিতে পারেন নাই, কিংবা এই প্রস্তাবটি ভোটের মাঠে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে নির্বাচনের মাঠে জামায়াতকে ভূমিধ্বস বিজয় দিতে পারে এই আশঙ্কা করেছেন। ২) এক ধরনের এলিট নারীবাদী – যারা কোন ভাবেই সাধারণ নারীদেরকে প্রতিনিধিত্ব করেন না। তার প্রমাণ মিলবে হাতে নাতে। বাংলাদেশের কর্মজীবী নারীদের বহু সংখ্যক ইতিমধ্যেই সোশাল মিডিয়ায় এই কর্মঘণ্টা কমানোর প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছেন।

উপসংহারঃ এক শ্রেণীর রাজনীতিবিদ ও এলিট নারীবাদীদের বিরোধিতা স্বত্বেও আগামী নির্বাচনে জামায়াত আমীরের এই প্রস্তাব জামায়াতের জন্যে ট্রাম্প কার্ড হয়ে উঠতে পারে। জামায়াত যদি সরকার গঠন করতে পারে এবং কর্মজীবী নারীদেরকে (যারা প্রেগন্যান্ট ও যাদের ছোট শিশু রয়েছে) এই সুযোগ প্রদান করে, সম্ভবত ১০০% নারীই এই সুযোগ সানন্দে গ্রহণ করবে। বর্তমানে কর্মজীবী অনেক মায়েরা কাজের ব্যস্ততার কারণে সন্তানদের যথাযথ সময় দিতে পারছেন না। এই অবস্থায় অনেকেই শিশুদের ডে কেয়ারে রেখে যান বা অন্য কারো হাতে তুলে দেন। মা থেকে শিশুর যে স্নেহ, মমতা, ভালোবাসা ও আবেগের বন্ধন পাওয়া যায় তা ডে কেয়ার বা অন্য কারো পক্ষে পূরণ করা সম্ভব নয়। এই প্রেক্ষাপটে, জামায়াত আমীরের প্রস্তাবটিকে ইতিবাচক ভাবে গ্রহণ করে, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থে ঐক্যমত্য কমিশন বা কিংবা সকল অংশীজণের সমন্বয়ে একটি জাতীয় কমিশন গঠন করে, প্রস্তাবটিকে অধিকতর যাচাই বাছাই করে বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। অন্য দিকে জামায়াতের উচিৎ বিষয়টি তৃনমূল পর্যায়ে আলোচনার মাধ্যমে এই বিষয়ে সকল ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটানো।

লেখক : বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, সাবেক অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক বিশেষজ্ঞ (যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস, ঢাকা), অস্ট্রেলিয়ায় প্রবাসী, সুপ্রভাত সিডনীর বিশেষ প্রতিনিধি।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *