বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে কিছু সময়ঃ এক অদ্ভুদ অনুভূতির সম্মিলন

প্রফেসর শফিকুর রহমান, বিশেষ প্রতিনিধি, সুপ্রভাত সিডনী

পূর্ব কথাঃ 

গত ১৫ অক্টোবরে সিডনী থেকে দশ দিনের জন্যে বাংলাদেশে যাই ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি ও ইন্টারন্যাশনাল ওপেন ইউনিভার্সিটির যৌথ সম্মেলনে যোগ দিতে। এই সুযোগে বাংলাদেশ ভ্রমণে আসা ওপেন ইউনিভার্সিটির ডেপুটি ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর আহসানের সাথে জাতীয় জাদুঘরে কিছু সময় কাটিয়েছি, এ এক অসাধরন অনুভূতি। বাংলাদেশে বড় হয়ে উঠেছি, অনেক সময় জাতীয় জাদুঘরের সামনে দিয়ে প্রায় প্রতিদিনই ধানমণ্ডিতে গিয়েছি। কিন্ত কোনদিনই জাতীয় জাদুঘরে যাওয়া হয়নি। তাই আমার জাতীয় জাদুঘর দর্শন, অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।

ভূমিকা

আমরা আমাদের ঘর, পরিবার, ভাষা এবং সংস্কৃতির মাধ্যমে যে পরিচয় বহন করি, তার মূলে রয়েছে আমাদের অতীত। অতীতকে ভুলে গেলে জাতি হিসেবে আমরা দিকহীন হয়ে যাই। বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর সেই দিশারি, যেখানে আমাদের ইতিহাস, সংগ্রাম, সৃজনশীলতা এবং পরিচয়ের শিকড় সংরক্ষিত রয়েছে। ঢাকার শাহবাগে অবস্থিত এই জাদুঘর শুধু একটি ভবন নয়—এটি অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যতের মধ্যে এক সেতুবন্ধন। ১৯১৩ সালে যাত্রা শুরুর পর থেকে আজ পর্যন্ত জাদুঘরটি বাংলাদেশের আত্মপরিচয়কে বহন করে চলেছে। ১৯৮৩ সালে পুনর্গঠিত হওয়ার পর এটি ‘বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর’ নামে নতুন পরিচয়ে আত্মপ্রকাশ করে। দেশের জন্ম, ভাষা, সংস্কৃতি, সংগ্রাম এবং শিল্পকলার যে গল্প আমাদের বলে, তা এক ঝলকে দেখতে চাইলে এখানেই আসতে হয়।

জাদুঘরের ইতিহাস: দীর্ঘ পথচলার গল্প

ঢাকা জাদুঘর থেকে শুরু করে আজকের জাতীয় জাদুঘর—এই যাত্রা নিছক নাম পরিবর্তন নয়। এটি বাঙালি জাতির মানসিক বিকাশ, সংগ্রাম এবং পরিচয়ের পরিপূর্ণ প্রতিফলন। স্বাধীনতা যুদ্ধ, ভাষা আন্দোলন, শিল্প-সাহিত্য, ধর্মীয় ঐতিহ্য এবং লোকজ সংস্কৃতি—সবকিছুই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এখানে জড়ো হয়েছে। আজ বাংলাদেশের শিশুরা যেমন বুক ভরে ইতিহাস জানতে এখানে আসে, তেমনি বিদেশি গবেষকরাও জানে—বাংলাকে বোঝার সেরা ঠিকানা এই জাদুঘর।

ভবনের বিন্যাস: প্রতিটি ইট যেন গল্প বলে

জাদুঘরের বিশাল চার তলা ভবনে প্রবেশ করলেই মনে হয়, আমরা এক সময়যন্ত্রে প্রবেশ করলাম। প্রতিটি গ্যালারি যেন দরজা খুলে দেয় আরেকটি কালের পটে। এখানে রয়েছে ৪০টিরও বেশি গ্যালারি—একেকটি যেন একেকটি নাট্যমঞ্চ, যেখানে ইতিহাস নিদর্শন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

এ গ্যালারিগুলি আমাদের হাজার বছরের প্রাচীন সভ্যতার শিকড় তুলে ধরে। পাহাড়পুরের বৌদ্ধ বিহার, মহাস্থানগড়ের প্রত্নবস্তু, পাল-সেন আমলের ভাস্কর্য—এসব দেখে বোঝা যায়, আমরা কোনো অগোছালো জাতি নই। বরং গভীর শিকড়, সমৃদ্ধ ইতিহাস এবং বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক যাত্রার পথিক। এ গ্যালারিতে দাঁড়ালে আপনার বুক কেঁপে উঠবে। শহীদ মিনারের প্রতীক, ২১ ফেব্রুয়ারির দলিল, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের রেকর্ড, মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যবহৃত অস্ত্র—এসব নিদর্শন শুধু জিনিস নয়, এগুলো আমাদের আবেগ, অশ্রু এবং গর্বের গল্প।

নৃ-বৈচিত্র্য গ্যালারি

বাংলাদেশ শুধু বাঙালির দেশ নয়—এটি বহু জাতিগোষ্ঠীর মিলনভূমি। পাহাড়ি পোশাক, বাদ্যযন্ত্র, ধর্মীয় উপকরণ, ঘরবাড়ির প্রতিরূপ—সব মিলিয়ে বোঝা যায়, সংস্কৃতি কারও একার নয়; এটি সবাই মিলে তৈরি করা এক রঙিন বুনন।

শিল্পকলা গ্যালারি

বাঙালির হাতে গড়া সূক্ষ্ম শিল্পকর্ম, নকশিকাঁথা, চিত্রকর্ম, লোকশিল্প, পোশাক এবং ঐতিহ্যবাহী কারুশিল্প—এসব দেখে অবাক হতেই হয়। প্রতিটি জিনিস যেন বলে—আমরা স্বপ্ন দেখি, তৈরি করি, এবং স্মৃতি রেখে যাই।

শিক্ষা, গবেষণা ও সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র

বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর শুধু নিদর্শন দেখানোর জায়গা নয়; এটি শেখার জায়গা। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা এখানে আসে শুধু দেখার জন্য নয়, উপলব্ধি করার জন্য। বিভিন্ন কর্মশালা, সেমিনার, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, ঐতিহাসিক আলোচনা—এসব আয়োজন তরুণদেরকে ইতিহাসের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় জীবন্তভাবে। গবেষকরা এখানকার নথি, দলিল এবং প্রত্নতত্ব নিয়ে কাজ করেন, নতুন তথ্য খুঁজে বের করেন, আবার পুরোনো ইতিহাসের ভুলগুলো সংশোধন করেন। এভাবে জাদুঘর ভবিষ্যতের জ্ঞান তৈরিতেও ভূমিকা রাখছে।

পর্যটনে অবদান: শাহবাগের সাংস্কৃতিক কেন্দ্র

ডিজিটাল যুগে জাদুঘরও পিছিয়ে নেই। আধুনিক সংরক্ষণ কৌশল, ডিজিটাল আর্কাইভ, অনলাইন প্রদর্শনী, এবং ভবিষ্যতে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি গ্যালারি—সব মিলিয়ে এটি সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে চলেছে। এখন কেউ চাইলে পৃথিবীর অন্য প্রান্ত থেকেও বাংলাদেশের ইতিহাস দেখার সুযোগ পাবেন। প্রতিদিন হাজারো মানুষ, দেশি-বিদেশি পর্যটক এখানে আসে। অনেকেই বলেন—জাদুঘর ঘুরে না দেখলে ঢাকা শহরের আসল ঐতিহাসিক স্বাদ পাওয়া সম্ভব নয়। শাহবাগ বইপাড়া, চারুকলা, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা—সব মিলিয়ে এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক এলাকা।

যে হারানো ইতিহাস আর ফিরবে না

তবে সবকিছুর মাঝেই একটি বেদনাদায়ক সত্য রয়েছে—অনেক মূল্যবান নিদর্শন, বিশেষ করে প্রাচীন সামগ্রী, মৃৎপাত্র, নথি, শিল্পকর্ম এবং যুদ্ধকালীন কিছু অস্ত্র ও দলিল আজ আর জাদুঘরে দেখা যায় না। আগের দর্শনার্থীরা এসব নিদর্শন দেখেছেন, কিন্তু এখন সেগুলো গায়েব। কারণ হিসেবে অনেকেই বলেন—সংরক্ষণের অভাব, পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকা, প্রশাসনিক দুর্বলতা এবং কখনও কখনও অনিয়মের কারণে এসব নিদর্শন নষ্ট, ক্ষতিগ্রস্ত বা হারিয়ে গেছে। কেউ কেউ অভিযোগ করেন—কিছু নিদর্শন ব্যক্তিগত সংগ্রহে চলে গেছে বা চোরাচালানের মাধ্যমে বিদেশে বিক্রি হয়েছে। এই অভিযোগগুলো এখনো স্পষ্টভাবে প্রমাণিত না হলেও প্রশ্ন থেকেই যায়—যে জাদুঘর আমাদের অতীত রক্ষার কথা, সে কি সব দায়িত্ব পালন করতে পেরেছে?

সবশেষে 

বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর আমাদের স্মৃতির ভান্ডার। এটি বাঙালির হাসি-কান্না, ত্যাগ-সংগ্রাম, জয়-পরাজয়ের সাক্ষী। একটি জাতি তখনই উন্নত হয়, যখন সে নিজের অতীতকে ভুলে যায় না।

জাদুঘর সেই দায়িত্বই পালন করে—নিদর্শনের ভাষায় আমাদেরকে বলে দেয় আমরা কোথা থেকে এসেছি এবং কোথায় যেতে চাই। এই জাদুঘর আছে বলেই আমরা নিশ্চিত—আমাদের ইতিহাস হারাবে না, আমাদের সন্তানরা জানতে পারবে বাঙালি হওয়ার গৌরব কাকে বলে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *