
মোহাম্মদ আলম ফরিদ: আজকের বিশ্বের রাজনীতি যেন অদ্ভুত এক মঞ্চ—যেখানে ক্ষমতার আলো ছড়ালেই ছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকে মৃত্যু। ডোনাল্ড ট্রাম্পের ওপর হত্যাচেষ্টাই প্রমাণ করে—এটা কোনো তৃত্তীয় বিশ্বের কল্পগল্প নয়; পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপত্তা-বেষ্টিত মানুষও টার্গেট হতে পারে এক সেকেন্ডের ভুলে। আর যে দেশগুলোর রাজনৈতিক ভিত্তি দুর্বল, যেখানে রাষ্ট্রযন্ত্র দলীয়করণে ডুবে আছে, সেখানে এই ঝুঁকি আরও কয়েকগুণ বেশি।
বাংলাদেশ সেই কঠিন বাস্তবতার ওপর দাঁড়িয়ে আছে এখন।
খালেদা জিয়াকে যে ভাবে ধীরে ধীরে নিঃশেষ করা হলো—সেটা শুধু একজন নেত্রীর ওপর নির্যাতন নয়; সেটা ছিল একটি রাজনৈতিক বংশধারাকে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা। হাসিনা তার নিজের পথেই শেষ হয়ে গেল—তার সন্তানরা রাজনীতি করার নৈতিক অবস্থান রাখে না; আর তাদের দল আওয়ামী লীগ তো ইতিহাসের সামনে দাঁড়াতেই পারে না। গণহত্যা, দমন-পীড়ন—এ সব নিয়ে কোনো গণতান্ত্রিক দেশে ফিরে আসা যায় না।
তাহলে থাকে কে? শুধু তারেক রহমান।
বাংলাদেশের রাজনীতি আজ এক অদ্ভুত সমীকরণে আটকে আছে—একজন মানুষকে বাদ দিলে পুরো রাষ্ট্রটাই নেতা-শূন্য হয়ে যাবে। জিয়াউর রহমানকে হত্যা করেছে ভারত—এই অভিযোগ অর্ধশতাব্দী ধরে ঘুরে বেড়ায়। শেখ মুজিবের হত্যার পেছনে বিদেশি ছায়া ছিল—এটা এখন আর গোপন কথা না। ইতিহাস আমাদের শিখিয়েছে: বাংলাদেশে বড় নেতার মৃত্যু কখনোই স্বাভাবিক হয় না।
তারেকের ক্ষেত্রে ঝুঁকি তাই কাগজে-কলমে বিশ্লেষণের বিষয় নয়—এটা বাস্তবতার অংশ।
তবে সত্যি কথা হচ্ছে—এ যুগ আর ১৯৭৫ বা ১৯৮১ নয়। আজ কোনো রাজনৈতিক হত্যা ঢাকা যাবে না, লুকানো যাবে না, বরং মুহূর্তে আন্তর্জাতিক আদালতের সামনে দাঁড়াতে হবে। যে তাকে মেরে ফেলতে চাইবে, সে জানে—বাংলাদেশ নয়, পুরো অঞ্চলটাই অস্থিতিশীল হয়ে পড়বে। ভারতও সেটা জানে, পশ্চিমাও জানে।
কিন্তু তারপরও—ঝুঁকি আছে। কারণ বাংলাদেশকে নেতৃত্বশূন্য করলে কে লাভবান হবে, সেটা আর বিশ্লেষণের বিষয় না; সেটা এখন আন্তর্জাতিক রাজনীতির ওপেন সিক্রেট।
এই পুরো পরিস্থিতি আমাকে একটাই সত্য মনে করিয়ে দেয়—বাংলাদেশের রাজনীতি এখন একদম ট্রাম্পের সেই হত্যাচেষ্টার মতো অবস্থায়: সবকিছু হচ্ছে সামনে সামনে, দিনের আলোয়, মানুষের চোখের সামনে—কিন্তু সবাই জানে, এক সেকেন্ডের ভুল, এক ভুল সিদ্ধান্ত, এক ভুল হিসাব—সবকিছু বদলে দিতে পারে। এটাই আজকের বাংলাদেশ। ভয়াবহ, অনিশ্চিত, আর এক মানুষকে কেন্দ্র করে দাঁড়িয়ে থাকা রাজনৈতিক ভাগ্যরেখা।
International Crisis Group-এর রিপোর্টও এই সম্ভাব্য রাজনৈতিক শূন্যতা সম্পর্কে সতর্ক করছে। তারা বলছে, শেখ হাসিনার রায়ের ফলে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বশূন্য হলে দেশীয় রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিপন্ন হবে এবং আন্তর্জাতিক নজরদারি আরও বৃদ্ধি পাবে।
আওয়ামী লীগ আজ এক ভয়ংকর ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। তাদের শীর্ষ নেতৃত্বের উপর গণহত্যার বিচার চলছে। বিচারে তাদের মূল নেতার মৃত্যুদণ্ডের সাজা হয়েছে। প্রায় সকল জাতীয়, মধ্যম ও স্থানীয় নেতারা ভারতে বা বিদেশে পলাতক। আওয়ামী লীগের কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছে। সুতরাং আওয়ামী লীগের হাতে খুব বেশি অপশন নেই।
আমি মনে করি—আওয়ামী লীগের বাংলাদেশের রাজনীতিতে ফিরে আসার সম্ভাব্য পথ মাত্র দুটি।
এক: গণহত্যার জন্য ক্ষমা চাওয়া এবং পুরো রাজনৈতিক দলটিকে পুনর্গঠন করা। দলের ভেতরে কারা অপরাধী—সে সিদ্ধান্ত বিচারব্যবস্থাকে নিতে দিতে হবে। আওয়ামী লীগকে তাদের মূল রাজনৈতিক দর্শন, অর্থাৎ আওয়ামী মুসলিম লীগ পর্যায়ে ফিরে যেতে হবে, যেখানে তারা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রতিনিধিত্ব করবে এবং সংখ্যালঘুদের প্রতি ন্যায্যতা দেখাবে। সেই সঙ্গে ভারতকে ‘বড় ভাই’ হিসেবে মাথায় বসিয়ে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে দেওয়া বন্ধ করতে হবে।
দুই: এটা আসলে কোন অপশন না। এটা যদি আওয়ামী লীগ প্রথম অপশন করতে ব্যর্থ হয় তাহলে – আওয়ামী লীগকে তাদের মাতৃভূমি ভারতে ফিরে গিয়ে নিজেদের জন্য ভারতের ভেতরেই একটি ‘আওয়ামী হোমল্যান্ড’ রাজ্য দাবি করতে হবে।
বাংলাদেশের ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য ভবিষ্যৎ এখন এক অদ্ভুত মোড় নিয়েছে। জামাতে ইসলামী যদি তারা নিজেদের দার্শনিক নেতা মওদুদীর আদর্শ এবং আক্বিদার ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরতা বজায় রাখে, তাহলে তাদের রাজনৈতিক প্রভাব সীমিত থাকবে। কারণ, মওদুদীর যুগের রাজনৈতিক বাস্তবতা আজ আর নেই; বাংলাদেশের জনগণ, শিক্ষিত যুবক সমাজ, এবং আন্তর্জাতিক নজরদারী এখন সম্পূর্ণ অন্য পরিস্থিতি তৈরি করেছে।
তবে জামাতে ইসলামী যদি তারা তাদের ঐতিহ্যবাহী ইসলামী চিন্তাধারাকে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে রেখে, অন্য ধর্মনিরপেক্ষ এবং আধুনিক রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জোট গড়ে, তবে একটি নতুন রাজনৈতিক সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে। এটি হবে শুধুমাত্র রাজনৈতিক পুনর্জাগরণ নয়, বরং দেশকে একটি ভারসাম্যপূর্ণ দিকনির্দেশনা প্রদানের সুযোগ। ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলোকে এখন আরও দায়িত্বশীল হতে হবে—তাদের লক্ষ্য শুধুমাত্র ধর্মীয় প্রভাব বিস্তার নয়; বরং দেশের সমগ্র রাজনৈতিক কাঠামোতে স্থিতিশীলতা এবং মানবাধিকার রক্ষা করতে হবে।
এটি যদি সম্ভব হয়, তবে বাংলাদেশের রাজনীতি কেবল দুই পরিবারের লড়াই বা একক নেতা নির্ভরতা থেকে বের হতে পারবে। জামাতে ইসলামী এবং অন্যান্য ইসলামী দলগুলোর যৌথ কার্যক্রম দেশের রাজনৈতিক বহুত্ববাদে নতুন মাত্রা যোগ করবে, যেখানে ধর্মীয় চিন্তাধারা এবং আধুনিক নাগরিক অধিকার একসাথে চলবে।
সব সম্ভাবনার মূল কেন্দ্রবিন্দু হবে জেনজিদের নতুন রাজনৈতিক দলের। তাদের শক্তি, উদ্যোগ এবং আদর্শের ওপর আগামী বাংলাদেশের রাজনীতি নির্ভর করবে। যারা ২৪-এর বিপ্লবের আদর্শ ধারণ করতে পারবে—যা ভারতীয় আধিপত্য থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা, সামাজিক বৈষম্য রোধ, সকল ধর্ম ও জাতির মানুষের সমানাধিকার, এবং সর্বপ্রথম বাংলাদেশী পরিচয়ের প্রতি অটল বিশ্বাস—তারা আগামী রাজনীতিকে পরিচালনা করবে।
ছাত্র নেতৃত্ব ও নতুন দল গঠনের প্রয়োজনীতা আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতার দৃষ্টিকোণ থেকে প্রাসঙ্গিক: “ICG বলছে, নতুন রাজনৈতিক নেতৃত্ব স্থিতিশীলতার জন্য অপরিহার্য।”
তাই বাংলাদেশে নতুন দল – জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)- এর উত্থান হলো এক ধরণের রাজনৈতিক সংস্কৃতির সংস্কার। তারা হবে দেশকে নেতৃত্বশূন্যতার ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার অন্যতম শক্তি। যারা ২৪ এর বিপ্লবের আদর্শ গ্রহণ করতে পারবে না, তারা ধীরে ধীরে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট থেকে বিলীন হয়ে যাবে। ছাত্র শক্তি কেবল নতুন নেতাদের জন্ম দেবে না; বরং এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, নতুন নৈতিক মানদণ্ড এবং নতুন কৌশলগত দিশা স্থাপন করবে।
এই ছাত্র নেতৃত্ব হবে দেশের একমাত্র সম্ভাব্য রাজনৈতিক পুনর্গঠনের কৌশল, যা শুধু ক্ষমতা অর্জনের জন্য নয়—বরং দেশের সব মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করে একটি সমানাধিকারপূর্ণ, স্বাধীন এবং আধুনিক রাষ্ট্র নির্মাণের লক্ষ্য নিয়ে কাজ করবে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ এখন একদিকে ভয়াবহ, অন্যদিকে সম্ভাবনাময়। নেতাদের হত্যা, রাজনৈতিক নিপীড়ন, এবং ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ—সবই দেশের স্বাভাবিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে বিপন্ন করেছে। তবে দেশের নতুন নেতৃত্ব, ছাত্র শক্তি, এবং দৃষ্টান্তমূলক রাজনৈতিক পুনর্গঠন এই ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের পথ দেখাতে পারে।
এই রাজনীতি শুধু শক্তি ও ক্ষমতার লড়াই নয়—এটি এখন আদর্শ, নৈতিকতা এবং দেশের নাগরিকদের প্রতি দায়বদ্ধতার লড়াই। যারা এই আদর্শ গ্রহণ করবে, তারা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ গড়বে। আর যারা তা করতে পারবে না, তারা ইতিহাসের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে হারিয়ে যাবে।
এটাই আজকের বাংলাদেশ—একটি দেশ, যা ইতিহাসের ঘূর্ণিঝড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে, নতুন নেতৃত্বের জন্য অপেক্ষা করছে, এবং ছাত্রদের হাতেই সম্ভাব্য রাজনৈতিক পুনর্গঠন গড়ে উঠবে।