বিড়াল পোষা: পশু প্রীতি নাকি জুলুম?

 

মুজাম্মেল হোসেন, অটোয়া: বিড়াল আমাদের বাড়ীর আঙ্গিনার একটি পশু।  চতুষ্পদী এই পশু ঘরের মধ্যে রাখলে নাকি মানসিক চাপ কমে, একাকীত্ব দূর হয়, হৃদরোগের ঝুঁকি কমে এবং মস্তিষ্ক  ও মনকে শান্ত রাখে। শুধু কি তাই? এতে ঘরময় ছড়িয়ে পড়ে স্বর্গীয় আবেশ! এখানেই শেষ নয়, বিড়াল পালার ফজিলত এতই বেশী যে আমাদের নবী (সা) এবং তারঁ একজন বিশিষ্ট সাহাবী আবু হুরাইরা (রা) তাঁদের ঘরে বিড়াল পুষতেন! বিড়ালের মহব্বতে বিশ্বনবী (সা) ঐ সাহাবীকে  আদর করে আবু হুরাইরা উপাধী দিয়ে ধন্য করেছিলেন।  এমন গাল-গল্প ও কল্প কাহিনী আমরা কম শুনিনি। এবারের লেখায় এই বিড়াল নিয়েই কথা বলবো।

আধুনিক বিজ্ঞানের  দৃষ্টিতে বিড়ালের ভয়ঙ্কর সংস্পর্শঃ খাল কেটে কুমির

সাম্প্রতিক এক গবেষণা বলছে, ঘরে বিড়াল পুষলে তা হতে পারে স্কিজোফ্রেনিয়া (Schizophrenia) নামক মস্তিষ্কের এক জটিল মানসিক ব্যাধির  সংক্রমন যা সহজে নিরাময়গোগ্য নয়। স্কিজোফ্রেনিয়া হলো একটি দীর্ঘস্থায়ী এবং গুরুতর মানসিক রোগ যা ব্যক্তির চিন্তাভাবনা, অনুভূতি, আচরণ এবং বাস্তবতাকে উপলব্ধি করার ক্ষমতাকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করে। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা হ্যালুসিনেশন (বাস্তবে নেই এমন কিছু দেখা বা শোনা), ডিলিউশন (কল্পিত বিশ্বাস), অসংলগ্ন কথাবার্তা, এবং অস্বাভাবিক আচরণ প্রদর্শন করতে পারে। শারীরিক সমস্যা হিসেবে হঠাৎ বুক ধড়ফড় করা, কখনোবা শ্বাসকষ্ট কিংবা দুঃস্বপ্ন দেখাও এই রোগের অন্তর্ভূক্ত। অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় উঠে এসেছে এমনই ভয়াবহ তথ্য। গত ৪৪ বছর ধরে ১৭ টি গবেষণার ব্যাপক বিশ্লেষণ করে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মতো ১১টি দেশের তথ্য নিয়ে এই আশঙ্কার কথাই জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা।

স্কিজোফ্রেনিয়া রিসার্স জার্নালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “বিড়ালের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের স্কিজোফ্রেনিয়া হওয়ার সম্ভাবনা অন্যদের থেকে প্রায় দ্বিগুণ।” গবেষকরা মনে করছেন, পরজীবী ভাইরাস এই রোগের কারণ হিসাবে কাজ করতে পারে। টক্সোপ্লাজমা গন্ডি প্যারাসাইটের সংস্পর্শে আসাই এই রোগের কারণ হতে পারে। এই পরজীবীটি বিড়ালের কামড়, মুখের লালা, মলমুত্র থেকে নিঃসরিত বাতাস ইত্যাদির মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করতে পারে। নিঃশব্দে স্নায়ুতন্ত্রে ঢুকে  নিউরোট্রান্সমিটারগুলোকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা রয়েছে এই ভয়ংকর পরজীবীর। কিন্তু কোনও লক্ষণই সেভাবে আগে থেকে প্রকাশ পায় না এবং এই ভয়াবহ ব্যাধি স্কিজোফ্রেনিয়ার কোন সহজ নিরাময় নেই।

বিজ্ঞানীরা বিড়ালের মধ্যে এই পরজীবী জীবাণু খুঁজে পেয়েছেন যা থেকে মানুষ স্কিজোফ্রেনিয়া ও বাইপোলার ডিসঅর্ডারের মতো  দূরারোগ্য ব্যাধীতে আক্রান্ত হতে পারে। আশঙ্কার বিষয় হলো বেশির ভাগ বিড়ালের শরীরেই এই জীবাণু থাকতে পারে। ফলে পোষা বিড়ালের কাছ থেকে এমন মারাত্মক রোগে আক্রান্ত প্রবল হওয়ার আশঙ্কা থাকে শিশু-কিশোর-তরুনদের। যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীদের বরাত দিয়ে সম্প্রতি সংবাদ সংস্থা পিটিআই এ খবর জানিয়েছে।  বিড়ালের শরীর থেকে অনেক লোম ঝড়ে যার ফলে বাসার প্রায় সব জায়গায় সে লোম ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি অনেক সময় খাবারের মধ্যেও তা ছড়িয়ে পড়ে, ঘরের এমন কোন পোশাক বা জায়গা থাকবে না যা বিড়ালের লোম মুক্ত। ‘টক্সোপ্লাজমা গনডি’ নামের এই পরজীবী জীবাণুটি প্রায় সব বিড়ালের শরীরেই বাসা বাঁধতে পারে বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে টেক টাইমস। মানুষের মধ্যে সহজে এই ‘টক্সোপ্লাজমা গনডি’ জীবাণুর উপসর্গগুলো ধরা পড়ে না বলে প্রাথমিক অবস্থায় এ রোগ শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে।

দেখতে যেমনই হোক বিড়াল একটি পশু

অন্যান্য পশুর শরীরে যে ধরনের রোগ হতে পারে বিড়ালও তা থেকে মুক্ত নয়, তা ঘরে থাক আর বাইরে থাক।  আরো যেসব ব্যাধিতে আপনার ঘর আক্রান্ত হতে পারেঃ

🧫১. টক্সোপ্লাজমোসিস (Toxoplasmosis)

এটি একটি পরজীবী সংক্রমণ (Toxoplasma gondii) যা বিড়ালের মলমূত্রের মাধ্যমে ছড়ায়।

গর্ভবতী নারী ও দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্য এটি বিশেষভাবে বিপজ্জনক, কারণ এটি গর্ভস্থিত শিশুর মস্তিষ্ক ও চোখের ক্ষতি করতে পারে।

😷 ২. অ্যালার্জি ও হাঁপানি

বিড়ালের লোম, ত্বক থেকে নির্গত প্রোটিন, ও লালার মাধ্যমে অনেকের মধ্যে অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।

লক্ষণ: হাঁচি, কাশি, চোখ চুলকানো, শ্বাসকষ্ট, বা হাঁপানির অবনতি।

🦠 ৩. ব্যাকটেরিয়াল ও ফাঙ্গাল সংক্রমণ

বিড়ালের আঁচড় বা কামড় থেকে Cat Scratch Disease (Bartonella henselae) নামের ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ হতে পারে।

বিড়ালের শরীরে থাকা ছত্রাক (ফাঙ্গাস) থেকে Ringworm (ত্বকের সংক্রমণ) ছড়াতে পারে।

🚽 ৪. পরিবেশ দূষণ ও দুর্গন্ধ

যদি বিড়ালের মল-মূত্র থেকে ঘরে দুর্গন্ধ, জীবাণু এবং কীটপতঙ্গের বৃদ্ধি ঘটে।

ঘরের বাতাস হয়ে যেতে পারে দুষিত, যা শিশু ও বৃদ্ধদের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।

👶 ৫. শিশুদের ঝুঁকি

শিশুরা বিড়ালকে আদর করতে গিয়ে সহজেই আঁচড় বা কামড়ে আক্রান্ত হতে পারে।

শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকায় সংক্রমণ দ্রুত ছড়ায়।

🧹 ৬. ঘরের পরিচ্ছন্নতা নষ্ট হয়

বিড়ালের লোম সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে – বিছানা, সোফা, কাপড়, এমনকি খাবারেও চলে যেতে পারে।

নিয়মিত ঝাড়ু, ভ্যাকুয়াম, ও জীবাণুনাশক ব্যবহারের মাধ্যমে এসব লোম পরিষ্কার করতে না পারলে এটি দূষণ ও কঠিন স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে।

⚠️ ৭. মানসিক প্রভাব

বিড়ালের যত্ন নেওয়া, খাবার, চিকিৎসা, টিকা ইত্যাদি ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ।

অনেকে মানসিক চাপ বা উদ্বেগে পড়েন যখন এটি সঠিকভাবে সামলাতে পারেন না।

 

একটি বিড়াল পুষতে আপনাকে যে মাশুল গুণতে হবেঃ

  • একটি বিড়াল আপনার জীবনের মূল্যবান সময়গুলোকে খেয়ে ফেলবে
  • নিত্য নতুন খরচের পালা যুক্ত হতে থাকবে
  • দৈনিক খাদ্য ও পানীয় দেয়ার জন্য থালা, ঘটি, বাটি
  • বিড়ালের নোংরা পায়খানা প্রস্রাব বমি পরিষ্কার করতে হবে নিজ হাতে
  • অপ্রয়োজনে আপনার জীবনকে করে তুলবে অধিকমাত্রায় ব্যাস্ত
  • বিভিন্নভাবে আপনার ঘরকে ময়লা আবর্জনার স্তুপে পরিনত করে ফেলতে পারে
  • আপনার বাসার শিশুদেরকে ধারালো নখের আচড় কেটে দিতে পারে, দেয়াল কিংবা ফার্নিচারগুলোতে দাগ লাগিয়ে দিতে পারে
  • বিড়ালের নখ ও লোম কেটে দিতে আপনার যথেষ্ট সময় দিতে হবে

একটি বিড়াল পুষতে যে খরচগুলো করতে হয়ঃ

এক জরীপে বলা হয়েছে বর্তমান বিশ্বে আনুমানিক ছয়শত মিলিয়ন বিড়াল রয়েছে, যার মধ্যে তিনশত মিলিয়ন পোষা বিড়াল বিভিন্ন বাসা বাড়ীতে মহারাজার হালে দিন কাটাচ্ছে।

ক্যানাডাতে একটি বিড়ালের জন্য প্রতিমাসে নূন্যতম যে পরিমান ডলার খরচ করতে হয়ঃ

  • খাবার ১৫০.০০
  • ঘটি বাটি ৩০.০০
  • চিকিৎসা ৫০.০০
  • পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা ৫.০০
  • খেলনা ১৫.০০
  • আনুসাঙ্গিক ৫০.০০
  • মোটি ২৫০.০০ ডলার

অর্থাৎ বাংলাদেশী মুদ্রায় এর পরিমান প্রতি মাসে প্রায় পচিশ হাজার টাকা! যা কোন পরিবারের ছয় মাসের বাজেট।  ঠিক এর বিপরীতে বর্তমান বিশ্বে মানুষের সংখ্যা প্রায় আট বিলিয়ন।  এদের মধ্যে ৭৩৩ মিলিয়ন আদম সন্তান টাকার অভাবে শরীরের সাধারন পুষ্টিও যোগাতে পারছে না।  আড়াই বিলিয়ন মানুষ প্রতিনিয়ত খাদ্য সংকটে অনিশ্চয়তায় দিন কাটাচ্ছে।  বিভিন্ন দেশের কমপক্ষে ৫০ কেটি মানুষ জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত কোন দিন পেট ভরে খাবার প্রহণ করতে পারে না।  এত কিছু জানা ও দেখার পরেও আমরা সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনে প্রতি মাসে আড়াইশত ডলার ব্যায় করছি একটি পশুর জন্য।  এই বাহুল্যতার কি বাস্তবতার কি ব্যখ্যা থাকতে পারে? অথচ এই পশুর রিজিকের ব্যবস্থা আল্লাহ নিজেই করে রেখেছেন।  খাওয়া পড়ার জন্য একমাত্র মানুষকেই কাজ কর্ম ও খাদ্য উৎপাদন করতে হয়। কোন পশুকে এ কাজ করতে হয় না।  আল কোরআন সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছে, ‘ভূপৃষ্ঠে বিচরণকারী এমন কোন প্রাণী নেই যার রিযিকের দায়িত্ব আল্লাহর ওপর বর্তায় না এবং যার সম্পর্কে তিনি জানেন না, কোথায় সে থাকে এবং কোথায় তাকে সোপর্দ করা হয়। এ সবকিছুই একটি সুস্পষ্ট কিতাবে লেখা রয়েছে।’  সূরা হুদ : ৬

এটি ভালবাসা নয় বরং একটি অবলা প্রাণীর প্রতি নির্মম জুলুম

একবার ভেবে দেখুন তো-আপনাকে কেউ জেলে বন্দী রেখে যতই ভাল খাবার আর পোষাক দেয়ার প্রস্তাব দিক না কেন আপনি কি এমন প্রস্তাবে কখনো রাজী হবেন?।  একটি জীবনের বেঁচে থাকার জন্য কেবল মুখের খাবারই যথেষ্ট নয়, সেই সাথে আরো প্রয়োজন প্রাণীটির নিজস্ব পরিবেশ, প্রতিবেশ, পরিমন্ডল ও মুক্ত বাতাস।  ভুলে যাবেন না, কোন বিড়াল পালার জন্য আপনাকে সৃষ্টি করা হয়নি, আপনাকে সৃষ্টির উদ্দেশ্য মানুষকে সেবা দেয়া, মানুষের কল্যাণে করার জন্য আপনি আল্লাহর খলিফা – (সূরা বাকারা ৩০)।  এই মানুষকে বাদ দিয়ে আপনার দৃষ্টি কিভাবে শিয়াল, কুত্তা আর বিড়াল পোষার জন্য নিবিষ্ট হয় তা ভেবে দেখুন। এমন আচরন কি চিন্তা ও রুচীর বিকৃতি নয়?  বাসায় বিড়াল এনে তাকে নির্বীর্য বা প্রজনন ক্ষমতাহীন করে রাখায় হয়- একটি বাকহীন নিরীহ প্রাণীর প্রতি কতটা জুলুম করা হচ্ছে তা কি ভেবে দেখেছি?

ঘরের মধ্যে বিড়াল রেখে অনেকেই বিড়ালের গল্প করা, ছবি দেখা, ফেইসবুক আল বিভিন্ন অনলাইন পোর্টালে এর কীর্তিগাথা ছড়িয়ে দিতে থাকে অনবরত।  কেবল তাই নয়, তারা প্রত্যাশা করে সবার মুখে মুখে তার এই বিড়ালের প্রশংসা ও কাহিনী ছড়িয়ে পড়ুক বিশ্বময়।  রাস্তায় কুকুর দেখলে যেভাবে অনেকে এর হায়ে হাত বুলিয়ে অভিনয়ের ঢঙ্গে আদর করে, বিড়ালের মাসীরাও অন্যদের থেকে এমনটিই আশা করে।  কেউ চায় তার বিড়ালের কিচ্ছা কাহিনী আর বীরত্ব সোহরাব রুস্তম কিংবা আলিফ লায়লার গল্পকেও কাহিনীকেও হার মানিয়ে যাক।  গোটা পৃথিবী যেন বিড়ালময় হয়ে যায়।  পোষা বিড়ালটিকে কোলে তুলে না নেয়ায় সংসার ভেঙ্গে যাওয়ার মত চরম অসভ্যপনার দুঃসংবাদও আমরা শুনেছি। ইদানিং নিজেরা বাচ্চা না নিয়ে বিড়ালের বাচ্চা পালনের উদ্ভট আকাংখাও অনেকের মাঝে দেখা যাচ্ছে।  তবুও বিড়াল পুষে  সবাইকে নিজেদের বড়লোকী স্ট্যাটাসের জানান দিতে হবে!

শুধু বিড়াল পালা নয়-কেউ শিয়াল কুকুর, বাঘ ভল্লুক পোষে, কেউবা কুমির কিংবা হাতি! কেউ বাজপাখি আবার কেউ চড়ুই।  লক্ষ লক্ষ টাকা এই অর্থহীন কাজে ব্যায় হচ্ছে। মনে রাখতে হবে, ঘরের মধ্যে কোন পশু পালনের জন্য আপনাকে সৃষ্টি করা হয়নি, বরং আপনাকে সৃষ্টির উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষকে লালন-পালন করা, তাদের হক্ব আদায়, ভালবাসা প্রদান এবং মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য।  অবশ্যই আল্লাহর সৃষ্টি সকল পশু পাখির উপরেই সুবিচার করতে হবে, অবিচার করা যাবে না; তবে এই ভালবাসার অর্থ তাকে ধরে খাঁচায় বন্দী করা নয় বরং পশু পাখির জন্য যে প্রাকৃতিক পরিবেশ আল্লাহপাক তৈরী করে রেখেছেন সেখানে অবাধে বিচরন করতে দেয়া।  একজন স্বাধীন মানুষকে জেলে বন্দী রেখে নিয়মিত সুস্বাদু খাবার দিয়েও যেমন তাকে সন্তুষ্ট করা যাবে না ঠিক তেমনি বনের পশু পাখিকে ধরে এনে যতই খাবার দেয়া হোক না কেন- তাকে ঐ প্রানীর অধিকার হরন করা ছাড়া আর কি বলা যেতে পারে? মনে রাখতে হবে সকল অধিকার হরনের জন্যই একদিন আল্লাহর দরবারে পাই পাই করে হিসেব দিতে হবে।

আমরা এতটাই ব্যাস্ত যে মহাগ্রন্থ আল কোরআনের কোন একটি তাফসীর থেকে একটি  ছোট্ট প্যারাগ্রাফ পড়ার সময় আমাদের হয় না, কিন্তু বিড়াল নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটাতে সময়ের কোন  অভাব হয় না।  মুসলিম সমাজে কুকর পুষতে এখনো কিছুটা চক্ষুলজ্জা অবশিষ্ট থাকলেও ঘরে ঘরে বিড়াল পালার সংক্রামন অনেককেই কাবু করে ফেলেছে। এ যেন আরেক করোনা সংক্রমন!  দেখে মনে হচ্ছে কুকুরের মুসলিম ভার্সন যেন বিড়াল! অন্যরা পরিবারকে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে আজ কুকুর বিড়াল নিয়ে সময় কাটাচ্ছে, মানুষের সাথে মেলা মেশার ধার তারা ধারে না, দুনিয়াতে জীবনকে উপভোগ করা ব্যতীত অন্য কোন দায়িত্ব আছে বলেও তারা মনে করে না; আমরা  মুসলমানরাও কি সে পথেই হাটছি? মানুষের পরিবর্তে বিড়ালকে বেশী ভালবাসা আদৌ কোন মানবীয় আচরন নয়।  বিড়ালের সাথে থেকে অনেকেই আজ মানুষ থেকে দূরে থাকতে পছন্দ করে – যা আল্লাহর সৃষ্টির বিপরীত।  এটি একটি কোন স্বাভাবিক আচরন নয় বরং মানসিক ব্যাধি।

রাসূল (সা) ও সাহাবীগন কি সত্যিই তাদের ঘরে বিড়াল পালতেন?

সবচেয়ে বড় কল্পকাহিনীটি বিশিষ্ট সাহাবী আবু হুরাইরাকে নিয়ে। আবু হুরাইরা (রা) এর ইসলাম গ্রহণের আগে নাম ছিলো আবদু শামস। ইসলাম গ্রহণের পরে মুহাম্মাদ (সা) তার নাম পরিবর্তন করে রাখেন আবদুর রহমান। আবু হুরায়রা নামটিতে একটি মজার কাহিনী রয়েছে। একদিন হযরত আবু হুরাইরা (রা) একটি বিড়াল ছানা সাথে করে রাসূলের (সা) দরবারে উপস্থিত হন। তা দেখে রাসূল তাঁকে রসিকতা করে- ‘হে বিড়ালের পিতা’ বলে সম্বোধন করলেন। এরপর থেকে তিনি আবু হুরাইরা নামে পরিচিতি পেলেন। আরবি ভাষায় হুরাইরা স্ত্রী লিঙ্গ আর হিররিন পুরুষ লিঙ্গ। হুরাইরাহ শব্দের অর্থ বিড়ালছানা। আবু হুরায়রা শব্দের অর্থ বিড়ালছানার পিতা।

আরেক দিনের ঘটনা একবার আবু হুরাইরা (রা) মাটিতে শুয়ে আছেন।  তা দেখে রাসুল (সাঃ) বললেন, ওহে, আবু তুরাব মাটিতে শুয়ে আছ কেন? এর পর থেকে তার আরো একটি নতুন নাম সংযুক্ত হয় ‘আবু তুরাব’। এ নামেও তিনি পরিচিতি লাভ করেন। তুরাব শব্দের অর্থ মাটি।  রাসূলের দেয়া ডাক নামের কারনে বিড়াল পোষা এতই যদি জরুরী হয়ে পড়ে তাহলে সেই একই নবীর ‘তুরাব’ উপাধীর কারনে আপনারা কেন খাট পালংক ছেড়ে মাটিতে বিছানা পেতে ঘুমাননা?

আসুন জেনে নেই আবু হুরাইরা কে ছিলেন।  আমরা ক’জনে জানি যে, আবু হুরাইরা (রা) ছিলেন আসহাবুস্ সুফফার একজন সদস্য।  যাদের ছিলনা কোন ঠিকানা, না ছিল বাড়ী আর না ছিল কোন খাবার।    রাসূল (সা) যে খাদ্য হাদিয়া পেতেন, প্রায় সময়ই তা আসহাবুস্ সুফফার মধ্যে বণ্টন করে দিতেন। হতদরিদ্র আবু হুরায়রার ভাগে যতটুকু পড়তো, অত্যন্ত অপর্যাপ্ত হলেও তা খেয়ে দিন কাটিয়ে দিতেন। সাহাবীগণ তাঁকে কখনও ক্ষুধায় কাতর দেখলে নিজের গৃহে ডেকে এনে আহার করাতেন। একবার জাফর ইবনে আবু তালিব তাঁকে সঙ্গে নিয়ে নিজের ঘরে আসেন; কিন্তু ঘরে কোন খাবার না থাকায় ঘি রাখার শূন্য পাত্রটি আবু হুরাইরার সামনে হাজির করলেন। আবু হুরাইরা তা-ই চেটে কোন মতে ক্ষুধা নিবারনের চেষ্টা করলেন। অনেক সময় খেজুর আর পানি খেয়েই তিনি দিনের পর দিন কাটিয়ে দিতেন। কখনোবা পেটে পাথর বেঁধে মাটিতে শুয়ে থাকতেন; কিন্তু কোনো দিন কারো নিকট কিছু চাইতেন না। আসহাবে সুফফা বলতে মসজিদ নববীর উত্তর-পূর্ব কোণার উন্মুক্ত একটি কোনাকে বুঝায়।  ঠিকানা বিহীন দরিদ্র  সাহাবীগণ নিজেদের রুটি রুজি অন্বেষণের পরিবর্তে সার্বক্ষণিক রাসূলের (সা) যে কোন আদেশ পালনের জন্য প্রস্তুত থাকতেন।  বর্তমান সময়ের মিলিটারী স্ট্যান্ডবাই ফোর্স এর মত। সাহাবীদের মধ্যে আবু হুরাইরা (রা) সর্বাবস্থায় রাসূলের এত কাছাকাছি অবস্থান করার সৌভাগ্য লাভের কারনে তিনিই সর্বোচ্চ সংখ্যক হাদীস বর্ণনাকারী রাবীর মর্যাদায় অভিসিক্ত হয়েছেন, যার পরিমান প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার।  অথচ গুজব ছড়ানো হচ্ছে এই মহান সাহাবী নাকি বিড়াল পুষে তার মূল্যবান সময় নষ্ট করতেন।

আবু হুরাইরার জীবনের সহায় সম্বল বলতে যা ছিল তা হচ্ছে একটি থালা আর পানি খাওয়ার মগ! বিড়াল কোথায় পালতেন? যে সাহাবীর নিজের থাকার ঘর ছিল না, খাবার ছিল না, পড়নের ভাল কাপড় ছিলনা, তারা আবার বিড়াল পুষে রেখেছেন – বাহ যুক্তিই বটে!  আরবী হুরাইরা শব্দের অর্থ বিড়াল – এতটুকু ঠিক আছে, কিন্তু এর অর্থ ‘আমাদের ঘরে বিড়াল পুষতে হবে’ এমনটি হলো কিভাবে? নামের মধ্যে একটি শব্দ দেখা গেলেই কি তা ঘরের মধ্যে পুষতে হবে? মশা, মাছি, ফেরাউন, নমরুদ, গরু, হাতি, কুকুর, গাধা, পিপড়া, মাকড়শা, মৌমাছি ইত্যাদি সবই পরিত্র কোরআনের আছে- তাই বলে এসব ঘরে পোষার জন্য বলা হয়েছে?  আবু লাহাব আর ফেরাউন নামগুলোও আল কোরআনে এসেছে।  বানর এবং শুকর শব্দও ও পবিত্র কোরআনে রয়েছে? তাই বলে কি ঘরে বানর আর শুকর পুষতে হবে? অন্যরা পরিবারকে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে করে কুকুর বিড়াল নিয়ে সময় কাটাচ্ছে, মানুষের সাথে মেলা মেশার ধার তারা ধারে না, দুনিয়াতে জীবনকে উপভোগ করা ব্যতীতি অন্য কোন দায়িত্ব আছে বলেও তারা মনে করে না; আমরা মুসলমানরাও কি সে পথেই হাটছি? সূরা ক্বলম এর ৪৮তম আয়াতে হযরত ইউনুসকে (আ) ‘ছাহেবুল হূত’ অর্থাৎ মাছওয়ালা বলে সম্বোধন করে ডাকা হয়েছে।  এজন্য কি আমাদেরকে ঘরে মাছেল চাষ করতে হবে? আল কোরআনে বিভিন্ন নবীকে বিভিন্ন উপনামে ডাকা হয়েছে। যেমন বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদকে (সা) মুজ্জাম্মিল বা মুদ্দাসসির অর্থাৎ কম্বল মুড়ি দেয়া ব্যাক্তি বলে আয়াত নাজিল করেছেন! এর অর্থ কি আমাদেরকে কম্বলের ব্যবসা করতে হবে?

বিড়ালের প্রতি জুলুমের কারনে জাহান্নাম

عَنْ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ دَخَلَتْ امْرَأَةٌ النَّارَ فِيْ هِرَّةٍ رَبَطَتْهَا فَلَمْ تُطْعِمْهَا وَلَمْ تَدَعْهَا تَأْكُلُ مِنْ خَشَاشِ الأَرْضِ قَالَ وَحَدَّثَنَا عُبَيْدُ اللهِ عَنْ سَعِيْدٍ الْمَقْبُرِيِّ عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ عَنْ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم مِثْلَهُ

বিশ্বনবী (সা) বলেছেন, “এক নারীকে বিড়ালের প্রতি জুলুমের কারণে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হয়েছে। কারণ, সে একটি বিড়ালকে বেঁধে রেখে তাকে না খেতে দিয়েছিল এবং না ছেড়ে দিয়েছিল, যাতে সে নিজে খাবার সংগ্রহ করতে পারে।”  (সহীহ বুখারি: ৩৩১৮, সহীহ মুসলিম: ২২৪২)

আল্লাহর সর্বোত্তম সৃষ্টি মানুষের অধিকারের বদলে আজ চারিদিকে নয়া এক ক্রেজ সৃষ্টি হচ্ছে শিয়াল কুত্তা, বিড়াল আর কাঠবিড়ালীর অধিকারের কথা।

বিড়াল প্রীতি কখনো আপনাকে মানুষের থেকে দূরে সরিয়ে পশুর দিকে বেশি আকৃষ্ট করতে পারে।

প্রথমত, মনে হতে পারে বিড়ালের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কটি একধরনের নিঃস্বার্থ। বিড়াল আপনার সাথে মিথ্যা বলেনা, প্রতারনা করেনা, ঠকায় না।  অভিযোগ করে না, কিছু প্রত্যাশাও করেনা।  এখানে এক ধরনের নীরব সম্পর্ক গড়ে ওঠে, যেখানে আবেগ বিনিময় হয় খুব স্বাভাবিকভাবে। অনেক সময় মানুষ তার অতৃপ্ত আবেগীয় ভালবাসা বিড়ালের মাঝে খুঁজে পায়। ফলে বিড়ালের সঙ্গ করো কাছে অধিক শান্তি ও স্বস্তির উৎস বলে মনে হতে পারে। বিড়াল কোলে কিংবা মাথায় করে রাখা, বন্ধুদের সাথে সারাক্ষণ বিড়ালের গল্প করা এমনকি  নামাজের মধ্যেও বিড়ালকে কাধ তুলে রাখা এই রোগের লক্ষণ – এ কথা বুঝতে হবে।

দ্বিতীয়ত, মানুষের সামাজিক জীবনে নানা ধরণের চাপ, সম্পর্কের জটিলতা ও প্রত্যাশা থাকে। এই জটিলতা থেকে মুক্তি পেতে মানুষ অনেক সময় প্রাণীর সঙ্গকে বেছে নিতে পারে। মনে হয় মানুষের কি প্রয়োজন! বিড়ালইতো আমার সবকিছু।  তাই মানসিক প্রশান্তির খোঁজে কেউ কেউ ধীরে ধীরে প্রাণীর দিকে বেশি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। একটি পর্যায়ে মানুষের উপস্থিতি তাদের কাছে বিরক্তিকর মনে হতে পারে।  তখন কুকুর বিড়ালের সান্নিধ্যকেই তারা মনে করে প্রশান্তি।  তখন নিজেকে সে মানুষের পরিবর্তে প্রাণীগোত্রের একজন বলে ভাবতে শুরু করে।  এক পর্যায়ে তারা হয়ে পড়ে পরিবার ও সমাজ বিচ্ছিন্ন।  পাশ্চাত্যে এটি এখন ব্যাপক ও বিপজ্জনক হারে লক্ষনীয়।

ভুলে যাবেন না আপনাকে  তৈরী করা হয়েছে সমাজবদ্ধ থেকে, মানুষের কল্যানে কাজ করার জন্য, আল্লাহর ও বান্দার হক্ব আদায় করার জন্য, এসব বাদ দিয়ে আপনি বিড়ালের জন্য কেন মিছে মায়া কান্না করছেন? ওর খাবার পানি বাড়ী ঘর সব আল্লাহর দেয়া প্রাকৃতিক ব্যবস্থাপনার মধ্যেই রয়েছে, এ কথা কি বিশ্বাস হয় না?।

তথ্যসূত্রঃ

https://pubmed.ncbi.nlm.nih.gov/38041862/

https://inscript.me/having-a-pet-cat-could-increase-schizophrenia-risk-why

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *