গাজা যুদ্ধের দুষ্টচক্র এবং অস্ট্রেলিয়ান পররাষ্ট্রনীতিতে বিপুল পরিবর্তন

ডা. সৈয়দ সাইফুদ্দিন আহমদ: গাজার সর্বশেষ যুদ্ধ শুরু হয় ২৩ অক্টোবরের হামাস আক্রমণের পর, যখন নিরীহ ইসরায়েলি নাগরিকদের ওপর হামলা চালানো হয়। এতে প্রায় ১,২০০ মানুষ নিহত হয় এবং অনেককে জিম্মি করে নিয়ে যাওয়া হয়। ইসরায়েল এ ঘটনাকে তাদের নাইন ইলেভেন বলে আখ্যা দেয়। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক সঙ্গে সঙ্গেই তেল আভিভে উড়ে যান সব ধরনের সমর্থন নিয়ে। ইউরোপের দেশ ফ্রান্স, জার্মানি এবং অন্যরা সমর্থন জানায়। অস্ট্রেলিয়া, ইসরায়েলের দৃঢ় একটি মিত্রদেশ, তারাও ইসরায়েলের সাথে থাকে। এরপর যা ঘটল, তা ইতিহাসে নজিরবিহীন। জিম্মিদেরকে মুক্ত করার নামে ইসরায়েল গাজার অধিকাংশ অংশে বোমাবর্ষণ করে এবং ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে।

কাতার, মিশর এবং মূল মদদদাতা যুক্তরাষ্ট্র, এ দেশগুলো কয়েক দফা শান্তিচুক্তি করানোর চেষ্টা করে। কিন্তু নেতানিয়াহু সবসময়ই শান্তিচুক্তি এড়ানোর জন্য কোনো না কোনো অজুহাত খুঁজে নেয়। এদিকে ইসরায়েল হামাসের সব নেতাকে এবং তাদের হিজবুল্লাহ সমর্থকদের হত্যা করে। যুদ্ধের মোড় ঘুরে যায় যখন ইসরায়েল ইরানের ওপর হামলা চালায়; আমেরিকাও ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা ধ্বংস করতে হামলা চালায়। সব কূটনৈতিক প্রোটোকল ভেঙে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিফ মুনিরকে হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রণ জানান। তিনি কী বলেছেন, তা আমরা অবশ্য জানি না। কিন্তু এটিই একমাত্র মুসলিম দেশ যার কাছে পারমাণবিক ওয়ারহেড আছে।

এই পত্রিকার সচেতন পাঠকেরা হয়তো জানেন, পাকিস্তানের পারমাণবিক যুদ্ধাস্ত্র ধ্বংস করার একটি পরিকল্পনা ইসরায়েলের ছিল, যা তারা ভারতকে পাশে নিয়ে বাস্তবায়ন করতে চেয়েছিল। যখন পাকিস্তানের এক মন্ত্রী সিএনএন-এ সরাসরি এই পরিকল্পনার কথা বলেন, ইসরায়েল ও ভারত সেই পরিকল্পনা থেকে সরে আসে।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় আমেরিকা জাপানি আক্রমণ থেকে অস্ট্রেলিয়াকে উদ্ধার করেছিল। জাপানি যুদ্ধবিমান ডারউইনে বোমা ফেলেছিল, সিডনি হারবারে আক্রমণ হয়েছিল। মহান মার্কিন জেনারেল ম্যাকআর্থার ছিলেন প্রশান্ত মহাসাগরীয় নৌবহরের সর্বাধিনায়ক। তিনি ফিলিপাইনকে জাপান থেকে উদ্ধার করেন; তাঁর বিখ্যাত উক্তি “We will come back” কিংবদন্তি হয়ে আছে। এই মহৎ জেনারেলের কংগ্রেসের দুই কক্ষকে উদ্দেশ করে দেওয়া ভাষণ এখনো আইকনিক। তাঁর ভাষণে ছিল এই লাইন: “Old soldiers never die, they just fade away.” তাঁর বক্তৃতার পর এক কংগ্রেসম্যান আবেগে আপ্লুত হয়ে এমন বাড়াবাড়ি একটি কথা বলেছিলেন যা অনেকটা ধর্মদ্রোহীসুলভ শোনায় – “আজ আমি ঈশ্বরের কণ্ঠ শুনেছি।”

অথচ ক্ষমতার শীর্ষে থাকা এই মহান জেনারেল ও আমেরিকান সেনাবাহিনীর প্রধানকে প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান বরখাস্ত করেন, কারণ তিনি মার্কিন প্রতিরক্ষা নীতির সমালোচনা করেছিলেন। প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান বলেছিলেন, তিনি (ম্যাকআর্থার) আমাকে অসম্মান করতে পারেন, কিন্তু তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টকে অসম্মান করতে পারেন না। পরে যখন জেনারেল আইজেনহাওয়ার প্রেসিডেন্ট হন, তিনি জেনারেল ম্যাকআর্থারকে তাঁর সম্মান ফিরিয়ে দেন।

জাতিসংঘের অতীত রেজোলিউশনগুলো, তা নিরাপত্তা পরিষদ হোক বা সাধারণ পরিষদই হোক, দেখলে দেখা যাবে ইসরায়েল–প্যালেস্টাইন ইস্যুতে অস্ট্রেলিয়া সবসময় যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষেই ভোট দিয়েছে। কিন্তু বর্তমান লেবার সরকার, অ্যান্থনি আলবানিজের নেতৃত্বে, প্যালেস্টাইন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে খানিকটা দূরে সরে গেছে। শেষ ধাক্কাটি আসে যখন অস্ট্রেলিয়া প্যালেস্টাইনের রাষ্ট্রত্বকে স্বীকৃতি দেয়, যা নেতানিয়াহুকে ভীষণ ক্ষুব্ধ করে। কয়েকজন বিশেষজ্ঞের মধ্যে অস্ট্রেলীয় প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রথম সাক্ষাৎ নিয়ে উদ্বেগ ছিল। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এই বিষয়টি তোলেননি। এভাবেই পরিণত সম্পর্ক কাজ করে, যার মূলমন্ত্র হলো “We agree to disagree on this.” দশকের পর দশক ধরে থাকা এএনজাস প্রতিরক্ষা চুক্তি এবং সাম্প্রতিক অকাস সাবমেরিন চুক্তি অটলই আছে।

ইসরায়েল এখন বিশ্বমঞ্চে একঘরে হয়ে পড়েছে; এটি বদলাতে পারে কেবল তখনই, যখন তাদের মাঝে আবার আইজ্যাক রবিনের মতো কোনো উদারপন্থী নেতা আসবে।

 

* লেখক সিডনি, অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসরত একজন চিকিৎসক ও ধর্মতাত্ত্বিক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *