সুপ্রভাত সিডনি প্রতিবেদন
জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে আওয়ামীলীগের সম্পৃক্ততা ও ভারতীয় প্রভাব প্রমাণিত !
২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারির পিলখানা ট্র্যাজেডি বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ সামরিক হত্যাকাণ্ড হিসেবে চিহ্নিত। ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাসহ মোট ৭৪ জনের নির্মম হত্যার সেই ঘটনা আজও জাতির বিবেককে নাড়া দেয়। দীর্ঘ ১৬ বছর পর অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশনের সদ্য প্রকাশিত প্রতিবেদন এই হত্যাকাণ্ডকে নতুনভাবে মূল্যায়নের সুযোগ এনে দিয়েছে এবং একই সঙ্গে সৃষ্টি করেছে গভীর উদ্বেগ, ভয়ঙ্কর সব তথ্য।
বিদ্রোহ নয়, পূর্বপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড
মেজর জেনারেল (অব.) আ ল ম ফজলুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিশন প্রায় ১১ মাস অনুসন্ধান শেষে সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে ৩৬০ পৃষ্ঠার চূড়ান্ত প্রতিবেদন হস্তান্তর করে। প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে,পিলখানার ঘটনা কোনো আকস্মিক বিদ্রোহ ছিল না; এটি ছিল সুপরিকল্পিত, সমন্বিত ও বহুপক্ষীয় হত্যাকাণ্ড। কমিশনের মতে, রাজনৈতিক সমন্বয়, গোয়েন্দা ব্যর্থতা এবং ইচ্ছাকৃত নিষ্ক্রিয়তা এই ট্র্যাজেডিকে ভয়াবহ রূপ দিয়েছে। হত্যার আগে ও পরে তদন্ত বাধাগ্রস্ত করা, গুরুত্বপূর্ণ রেকর্ড মুছে ফেলা এবং দায়ীদের পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া সব মিলিয়ে একটি সুসংগঠিত চক্রান্তের চিত্র উঠে এসেছে।
রাজনৈতিক বৈঠক ও পরিকল্পনার অভিযোগ
প্রতিবেদনে বলা হয়, ঘটনার কয়েক মাস আগে তৎকালীন সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস পিলখানায় বিডিআর সদস্যদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেন এবং সৈনিকদের অসন্তোষের তথ্য সংগ্রহ করেন। পরে তার বাসভবনে আওয়ামী লীগ নেতা শেখ ফজলুল করিম সেলিমের উপস্থিতিতে একাধিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
এই বৈঠকগুলোতে তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সোহেল তাজ, আওয়ামী লীগ নেতা জাহাঙ্গীর কবির নানক, মির্জা আজম, লেদার লিটন ও তোরাব আলীর উপস্থিতির কথা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। একটি বৈঠকে প্রথমে সেনা কর্মকর্তাদের জিম্মি করার পরিকল্পনা থাকলেও পরে তা পরিবর্তন করে সরাসরি হত্যার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বলে কমিশন জানিয়েছে।
বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার সম্পৃক্ততার অভিযোগ
সবচেয়ে সংবেদনশীল অভিযোগগুলোর একটি হলো, ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার সম্পৃক্ততা। কমিশনের প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, উক্ত বৈঠকে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার ২৪ জন সদস্য অংশ নিয়েছিলেন এবং সেখানেই সেনা কর্মকর্তাদের হত্যার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়। ব্যারিস্টার তাপসকে হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের নিরাপদে পালিয়ে যেতে সহায়তার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল বলেও অভিযোগ প্রমাণিত রয়েছে। একাধিক সাক্ষীর বরাতে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ঘটনার দিন পিলখানার ভেতরে হিন্দি ও ভিন্ন উচ্চারণে বাংলায় কথোপকথন শোনা যায়। এছাড়া, ঘটনার সময় ৮২৭ জন ভারতীয় পাসপোর্টধারীর বাংলাদেশে প্রবেশ এবং তাঁদের মধ্যে অন্তত ৬৫ জনের বহির্গমনের কোনো তথ্য না থাকার বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আলামত হিসেবে চিহ্নিত করেছে কমিশন।
‘সবুজ সংকেত’ ও নিরাপত্তা ব্যর্থতা
কমিশনের সূত্র দাবি করেছে, তৎকালীন স্বৈরাচারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে ‘সবুজ সংকেত’ পাওয়ার পরই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন শুরু হয়। বিদ্রোহ শুরুর পর পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত হওয়া সত্ত্বেও সময়মতো সেনা মোতায়েন না করায় হত্যাকারীরা নির্বিঘ্নে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পায়। প্রতিবেদনে সেনাপ্রধান জেনারেল মইন ইউ আহমেদসহ সামরিক বাহিনীর ১২ জন সাবেক কর্মকর্তা, র্যাবের চারজন, বিডিআরের তিনজন এবং পুলিশের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দায়িত্বহীনতা, অবহেলা ও সন্দেহজনক আচরণের অভিযোগ আনা হয়েছে। অনেকেই ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকেও কার্যকর ব্যবস্থা নেননি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে।
গণমাধ্যমের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন
তদন্ত কমিশন জানিয়েছে, ঘটনার সময় কিছু টেলিভিশন চ্যানেল ও গণমাধ্যম যাচাই-বাছাই ছাড়াই উত্তেজনাকর ও বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচার করে। এর ফলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে এবং বিদ্রোহীদের মনোবল বেড়ে যায়।
৪৯ জন অভিযুক্ত, পুনঃতদন্তের সুপারিশ
কমিশন মোট ৪৯ জনকে এই হত্যাকাণ্ডের জন্য বিভিন্ন স্তরে দায়ী করেছে। অভিযুক্তদের মধ্যে রয়েছেন রাজনীতিবিদ, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা, গোয়েন্দা সংস্থার সদস্য, র্যাব ও বিডিআর কর্মকর্তা, সাবেক ও বর্তমান আইজিপি এবং তিনজন সংবাদকর্মী। কেউ পরিকল্পনায়, কেউ উসকানিতে, কেউ সহায়তায় এবং কেউ দায়িত্বে অবহেলার মাধ্যমে এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
কমিশন পুনঃতদন্ত, বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বিচার এবং পুরো প্রতিবেদন জনসমক্ষে প্রকাশের সুপারিশ করেছে। কমিশনের সদস্য মো. শাহনেওয়াজ খান চন্দন জানিয়েছেন, আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন সম্ভব।
সরকারের অবস্থান ও জাতির প্রত্যাশা
সম্প্রতি সচিবালয়ে আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত বৈঠক শেষে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী জানিয়েছেন, সরকার এই বিশাল ভলিউমের প্রতিবেদন গুরুত্বসহকারে পর্যালোচনা করছে এবং সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হবে।
এদিকে, নিহত সেনা কর্মকর্তাদের পরিবার দীর্ঘ নীরবতার পর আবারও ন্যায়বিচারের দাবি তুলেছে। তাদের মতে, এই প্রতিবেদন শুধু একটি ট্র্যাজেডির সত্য উন্মোচন নয় বরং বাংলাদেশের রাজনীতি, সামরিক কাঠামো ও বিদেশি প্রভাব নিয়ে মৌলিক প্রশ্ন উত্থাপন করেছে।
উপসংহার
পিলখানার বর্বর হত্যাকাণ্ড কেবল অতীতের একটি অধ্যায় নয়; এটি রাষ্ট্রীয় দায়, বিচারহীনতা ও রাজনৈতিক জবাবদিহির প্রতীক। জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদন জাতির সামনে একটি স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে সত্য প্রতিষ্ঠা ও নিরপেক্ষ বিচার ছাড়া এই ক্ষত কখনোই শুকাবে না। এখন সময় এসেছে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত, স্বচ্ছ ও ন্যায়ভিত্তিক বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ইতিহাসের এই ভয়াবহ অধ্যায়ের পূর্ণাঙ্গ সত্য উদঘাটনের।
ফ্যাসিস্ট হাসিনা কখনোই সেনাবাহিনীর প্রতি সন্তুষ্ট ছিলেন না। তার আমলা ও মন্ত্রীরা সুযোগ পেলেই সেনাবাহিনীকে হেয় করতে কুণ্ঠাবোধ করতেন না। জনসমক্ষে নোংরা ও অবমাননাকর ভাষায় সেনাবাহিনীকে কটাক্ষ করতেন হাসিনা ও তার দোসররা। সেনাবাহিনীকে ধ্বংস করার নীলনকশা বাস্তবায়নে তিনি দীর্ঘদিন ধরেই ভারতের সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন।
এই ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে বিশেষভাবে চৌকস ও দক্ষ সেনা কর্মকর্তাদের বিডিআরে বদলি করা হয়। পরিকল্পিতভাবে একই দিনে সকল কর্মকর্তাকে একটি নিমন্ত্রণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে বাধ্য করা হয়। প্রধানমন্ত্রী নিজে উপস্থিত থাকবেন—এই বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া হয়, যাতে কেউ অনুপস্থিত না থাকেন। কিন্তু বাস্তবে সেটি ছিল ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার পরিকল্পনারই একটি অংশ।
টার্গেট করা সকল কর্মকর্তা উপস্থিত হওয়ার পর, পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী শেষ মুহূর্তে ঘোষণা দেওয়া হয় যে প্রধানমন্ত্রী উপস্থিত হতে পারবেন না। এরপরই নেমে আসে ভয়াবহ নৃশংসতা। ভারতীয় জঙ্গিরা বাংলাদেশের অমূল্য সম্পদ, সোনার ছেলেদের একজন একজন করে নির্মমভাবে হত্যা করে। অফিসারদের স্ত্রী ও কন্যাদের উপর চালানো হয় পাশবিক নির্যাতন। অনেকের দেহ ক্ষতবিক্ষত করা হয়, অনেকের মরদেহে পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।
প্রশ্ন জাগে: এই ভয়ংকর নৃশংসতার কারণ কী? কী অপরাধ করেছিলেন সেই ৫৭জন বীর সেনা কর্মকর্তা? কেন তাদের পাখির মতো গুলি করে হত্যা করা হলো? জানা যায়, প্রায় প্রতিটি অফিসারের স্ত্রীই তখন অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। আজ সেই অনাগত সন্তানরা অনেক বড় হয়েছে। জানা যাচ্ছে, তারাও সেনাবাহিনীর অফিসার হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে বেড়ে উঠছে।
দেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব ধ্বংসের এই নেপথ্য নায়িকা ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে অবিলম্বে ধরে এনে জাতির সামনে বিচারের মুখোমুখি করা সময়ের অমোঘ দাবি।