মেশকাতুন নাহার: সভ্যতার ইতিহাসে আইন, ন্যায়বিচার ও মানবিকতা—এই তিনটি স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়েই একটি সমাজ এগিয়ে চলে। কিন্তু যখন এই স্তম্ভগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে, তখন সমাজের ভেতর জন্ম নেয় এক ধরনের অন্ধ শক্তি, যার নাম মব। মব কোনো সংগঠিত প্রতিষ্ঠান নয়, বরং এটি একটি মানসিক অবস্থা—যেখানে ব্যক্তি তার বিবেক, যুক্তি ও মানবিকতা বিসর্জন দিয়ে ভিড়ের অংশ হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক বাস্তবতায় এই মব সংস্কৃতি ক্রমেই ভয়ংকর সামাজিক সংকটে রূপ নিচ্ছে।
মবের সবচেয়ে বিপজ্জনক দিক হলো—এটি মানুষকে মানুষ হিসেবে নয়, সংখ্যার অংশ হিসেবে কাজ করতে শেখায়। এখানে ব্যক্তির নৈতিক দায়বদ্ধতা লোপ পায়, কাজ করে কেবল ‘সবাই করছে’ মানসিকতা। চুরির সন্দেহ, ধর্মীয় গুজব কিংবা রাজনৈতিক উত্তেজনা—যে কোনো উপলক্ষেই মুহূর্তের মধ্যে উত্তেজিত জনতা গড়ে ওঠে, আর সেই জনতাই হয়ে ওঠে বিচারক, সাক্ষী ও কার্যকরকারী। ফলে সত্য-মিথ্যার পার্থক্য ঘুচে যায়, আর নিরপরাধ মানুষও হয়ে পড়ে নির্মম সহিংসতার শিকার।
এই সংকটের পেছনে অন্যতম বড় ভূমিকা রাখছে গুজব ও ভুল তথ্যের অবাধ বিস্তার। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যাচাইহীন সংবাদ, বিকৃত ভিডিও কিংবা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত পোস্ট মুহূর্তেই হাজারো মানুষের কাছে পৌঁছে যায়। বাস্তবতা যাচাই করার আগেই আবেগ ও উত্তেজনা মানুষকে সহিংসতার দিকে ঠেলে দেয়। ডিজিটাল যুগে এক ক্লিকের ভুল সিদ্ধান্ত একটি জীবনের অপূরণীয় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
তবে মব সংকটের মূল শিকড় আরও গভীরে—আইনের প্রতি আস্থাহীনতায়। যখন মানুষ মনে করে বিচার পেতে সময় লাগে, অপরাধী শাস্তি পায় না, কিংবা প্রভাবশালীরা আইনের ঊর্ধ্বে থাকে—তখন তারা নিজেরাই আইন হাতে তুলে নিতে চায়। কিন্তু এই তথাকথিত ‘মব জাস্টিস’ আসলে ন্যায়বিচার নয়; এটি এক ধরনের সামাজিক অরাজকতা। এখানে অপরাধ প্রমাণের আগেই শাস্তি কার্যকর হয়, আর ন্যায়বিচারের মৌলিক নীতিগুলো পদদলিত হয়।
প্রশ্ন হলো—এই ভয়ংকর প্রবণতা থেকে উত্তরণের উপায় কী?
প্রথমত, আইনের কার্যকারিতা ও দৃশ্যমান ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে। দ্রুত, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থা জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারে। মানুষ যখন দেখবে অপরাধীর শাস্তি হচ্ছে, তখন নিজের হাতে বিচার করার প্রবণতা কমবে।
দ্বিতীয়ত, গুজব প্রতিরোধে শক্তিশালী সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ প্রয়োজন। ভুল তথ্য শনাক্ত ও প্রতিরোধে প্রযুক্তিগত ব্যবস্থা যেমন জরুরি, তেমনি নাগরিকদের ডিজিটাল সাক্ষরতা বাড়ানোও অপরিহার্য। মানুষকে শেখাতে হবে—শেয়ার করার আগে যাচাই করা দায়িত্বের অংশ।
তৃতীয়ত, শিক্ষা ও সামাজিক সচেতনতার মাধ্যমে মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত করা প্রয়োজন। পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যমকে সম্মিলিতভাবে সহনশীলতা, সহমর্মিতা ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ গড়ে তুলতে হবে। কারণ মানবিকতা ছাড়া আইনও কার্যকর হয় না।
সবশেষে বলতে হয়, মব কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়—এটি সমাজের ভেতরের দুর্বলতার প্রতিফলন। যদি আমরা এই সংকটকে কেবল সাময়িক উত্তেজনা হিসেবে দেখি, তবে ভবিষ্যতে এর ভয়াবহতা আরও বাড়বে। কিন্তু যদি আইন, ন্যায়বিচার ও মানবিকতাকে আবার সমাজের কেন্দ্রে ফিরিয়ে আনতে পারি, তবে মব নয়—মানুষই আবার রাষ্ট্রের শক্তি হয়ে উঠবে।